করোনার বিপক্ষে কেরালার সাফল্য1 min read
Reading Time: 3 minutesএকটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পরিস্থিতি বোঝানো যাক। ১২ মার্চ, ৩৩ বছরের একজন সেলসম্যান দুবাই থেকে নামলেন ভারতের মাটিতে। দক্ষিণ ভারতের কেরালার অধিবাসী তিনি। কেরালা রাজ্যের প্রায় দুই লাখ মানুষ তার মতোই ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। যাদের অনেকেই ফিরে আসছেন। কারণটা কোভিড-১৯ ভাইরাস।
আসার পথেই এই প্রবাসী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর, শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে পা রাখেন নিজের দেশে। বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দ্রুতই তাকে আলাদা করে ফেলেন আর সবার কাছ থেকে। করোনা পরীক্ষার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরালার ত্রিভান্দ্রাম শহরে।
পরীক্ষার পর তাকে পাঠানো হয় ৫৬৪ কিলোমিটার দূরে তার নিজের গ্রামে। কিন্তু কেরালা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিতে মোটেই দেরি করেনি। নিজ গ্রামে পৌছাতেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তাকে আইসোলেশনে পাঠান। দেশে ফিরে স্ত্রী সন্তানদের মুখ দেখার আগেই তাকে আলাদা জীবন শুরু করতে হয়। শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য। ৬ দিন পর টেস্ট থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে তার শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। কিন্তু এরইমাঝে তিনি আইলোশনে থাকায় তার মাধ্যমে অন্য কেউ আক্রান্ত হননি। টেস্টের ফলাফল আসার পর তাকে হাসপাতাল নেয়া হয় এবং চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরালা এভাবেই সতর্ক ছিল। যার কারণে সমগ্র ভারতে আতঙ্কে থাকলেও কেরালায় কোভিড ১৯ এখনো কোন ভয়াবহ পর্যায়ে আসেনি।
“আমরা একেবারে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে একটা ঝড় আসতে চলেছে। তাই আমরা আমাদের নিজস্ব উপায়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিলাম।“ নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে বলছিলেন ২৩ সদস্যের স্থানীয় কাউন্সিলের প্রধান শাহিনা সেলিম। অথচ বিশ্বের অন্যতম বিশাল গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সরকার ব্যবস্থার একেবারেই নিম্ন পর্যায়ের সদস্য শাহিনা সেলিমের দল। অথচ ভারত সরকারের অনেক আগেই নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তারা।
গত মাসে শাহিনা সেলিমের অধীনস্থ চেঙ্গালা অঞ্চলে ২২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণের খবর এসেছে এবং প্রায় ৪০০ জনের অধিক মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এছাড়া মোট ২০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে ফিরেছেন।
কেরালার স্থানীয় গ্রাম্য কাউন্সিলাররা স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং আইসলেশনে থাকা রোগীদের জন্য একটি কমিউনিটি কিচেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসী এং ভাসমান শ্রমিক মিলিয়ে এই রান্নাঘর থেকে প্রতিদিন ১২০০ জনের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়। আর স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিশ্চিত করছেন রোগীরা নিয়মিত তাদের ওষুধ গ্রহণ করছেন কিনা।
একটি স্থানীয় হেল্পলাইন এবং দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে প্রশাসন নিশ্চিত করছে জনগণ আইসোলেশনে থাকা মানুষদের সাথে কোনরকম অন্যায় আচরণ করছে কিনা। যাদের ঘরে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই তাদের জন্যও কাজ করে চলেছেন কেরালার এসব কাউন্সিলর। সাধারণ জনগণও তাদের প্রতি যথেষ্ট ইতিবাচক। প্রায় দুই ডজন পরিবার নিজেদের আশ্রয় সামাজিক এই কাজের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। প্রত্যেক করোনা পজেটিভ রোগীকেই ২৮ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে রেখেছে প্রশাসন।
অনেকের মতে কেরালাই ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে রোল মডেল হবে। সবশেষ তথ্যমতে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চৌদ্দ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত কেরালায় ৪০৭ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যা ভারতের প্রবাসী অধ্যুষিত অন্যান্য অনেক এলাকা থেকে অনেকখানিই কম। এমনকি সমগ্র ভারতের তুলনায় হিসেব করলেও কেরালা বেশ ভালভাবেই করোনা পরিস্থিতি সামলে যাচ্ছে। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ভারতে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত করা হয় এই কেরালা রাজ্যেই এবং তা বেশ দ্রুত বাড়তে থাকে।
কিন্তু বিষ্ময়কর হলেও সত্য, মহামারী ছড়িয়ে পড়ার দুই মাস পর কেরালায় প্রায় ৩৭০ জন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয় এবং বর্তমানে তা মাত্র ৪০৭। সবমিলিয়ে বর্তমানে কেরালায় প্রায় ১ লাখ মানুষ আইসোলেশনে রয়েছেন। এবং অনেকের মতেই করোনা আক্রান্তের গ্রাফে ভারত যখন উর্ধ্বমুখী তখন কেরালা রাজ্য আছে সমান্তরাল অবস্থানে। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ উজাড় যেমন করেছেন, সেই সাথে এখন পর্যন্ত কাউন্সিলরদের কাছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার ফোন কল এসেছে সাহায্যের জন্য। কেরালার সরকার সেসব ইস্যুতেও ধৈর্যের সাথে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।
এমনও নয় যে, কেরালায় করোনা পরীক্ষা কম হচ্ছে বিধায় কম রোগী শনাক্ত হচ্ছে। পুরো রাজ্যে ১২ টি স্থানে প্রতিদিন নমুনা শনাক্তের মাধ্যমে পরীক্ষা চলছে। প্রতিটি কেন্দ্রে দিনে প্রায় ৮০০ জনের নমুনা নেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেরালায় এমন পরিস্থিতির মূলে রয়েছে কার্যকরী চিকিৎসাসেবা এবং তাদের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত তৃণমূলের রাজনীতি ব্যক্তিত্বরা। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের কাউন্সিলরদের সেবামূলক মনোভাব।
অর্থনীতিবিদ জ্যাকব জন তার গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানান, কেরালার তিন স্তরের গণস্বাস্থ্য প্রকল্প আছে, এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালের সেবাও উল্লেখ করার মতো। এছাড়া, ভারতের বাকি সব রাজ্যের মাঝে কেরালাই শিক্ষা এবং চিকিৎসা খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে। যার সুফল তারা পাচ্ছে এই মহামারীর সময়ে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কেরালায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের গড় বয়স ৩৭ বছর এবং তাদের প্রায় সবাই আরব সাগরের তীরবর্তী বিভিন্ন দেশে শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন।
কেরালার চিকিৎসক ডাঃ ইকবাল জানান, “আমাদের রাজ্যে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশ দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। এটি ভারতের এমন একটি রাজ্য যেখানে প্রায় ১২ শতাংশ নাগরিকের বয়স ৬০ বছরের অধিক।“ এখানে উল্লেখ করা দরকার, কেরালা ভারতের সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সেইসাথে ভারতে অন্যান্য যেকোন দেশের তুলনায় কেরালায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং যকৃত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া বর্ষণ প্রবণ এই অঞ্চলে বর্ষা মৌষুমে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু সহ অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবও থাকে অনেক বেশি।
এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় সমগ্র ভারতের তুলনায় অনেক বেশিই সফল অবস্থানে রয়েছে কেরালা রাজ্য। চীনের পর কেরালা রাজ্যই সারা বিশ্বের কাছে করোনার বিরুদ্ধে রোল মডেল হিসবে কাজ করছে। তবে তা থেকে বাদবাকি বিশ্ব কতটা শিক্ষা নিতে পারে তা কেবল ভবিষ্যতই জানে।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ