ইতিহাস

ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্যময় মূর্তিরা1 min read

এপ্রিল ২০, ২০১৯ 4 min read

author:

ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্যময় মূর্তিরা1 min read

Reading Time: 4 minutes

দূর থেকে দেখছেন সবুজ শ্যামল দ্বীপ, দূরত্ব কমতেই দেখলেন একরাশ মানুষ আপনার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রবার্ট লুই স্টিভেনস বা হেনরি রাইডারের কোন উপন্যাসের মঞ্চ যেন। কাছাকাছি আসতেই ভুল ভাঙলো। আরে যে মানুষ নয়, নিরেট পাথরের মূর্তি। কিন্ত এত বিশালাকার মূর্তি এই দ্বীপে এলো কোথা থেকে? কারাই বা এর নির্মাতা?

হ্যাঁ, বলছি দক্ষিণপূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত চিলির অধীনস্থ দ্বীপইস্টার আইল্যান্ডে কথা। এখনাকার মূল আকর্ষণই হলো এই বিশালাকৃতির সব পাথরের মূর্তি। যার টানে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

নামকরণের ইতিহাস

১৭৭২ সালের এপ্রিল, ডাচ নৌ সেনাপতি জ্যাকব রোগেভেনের জাহাজবহর  ভেড়ে চিলি থেকে একটু দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপের তীরে। স্থানীয় পলিনেশিয়ান ভাষায় দ্বীপটার নামরাপা নুইঅর্থাৎবড় রাপা কিন্ত সে বছরের ইস্টার সানডেতে যখন এই দ্বীপের আবিষ্কার, সে অনুসারে নামটাও হয়ে গেলইস্টার আইল্যান্ড

বর্তমানে এই দ্বীপের নামটা স্প্যানিশ Isla de Pascua হলেও অর্থ একই। তবে প্রথমে এর নাম ছিল ‘Te Pito O Te Henua’ যার অর্থপৃথিবীর নাভি নামখানা অস্বস্তিকর লাগছে? তাহলে এই নামটা শুনুন, Mata-Ki-Te-Rani , এর অর্থস্বর্গে নিবদ্ধ দৃষ্টি তবে শেষমেশ এসব নাম টেকেনি। টিকেছে ইস্টার আইল্যান্ডই।

অনেকেি জানেন না মাটির নিচে আছে মোয়াইদের বিশাল বপুও;
Image Source: Lonely Planet

মূর্তি নির্মাণের গল্প

পুরো দ্বীপজুড়ে আছে ৮৮৭ টি মূর্তি , যা মোয়াই নামে পরিচিত। এগুলো নির্মিত হয়েছিল ১২৫০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে। ধারণা করা হয়, স্থানীয় অধিবাসীরাই এসবের নির্মাতা। মোয়াই স্থানীয় শব্দযার অর্থতাঁর অস্তিত্বের জন্য

মোয়াই বা মূর্তিগুলো চিলির এই আদিবাসী গোত্রদের দলপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আদলে তৈরি। মৃত্যুর পরেও যেন তাঁরা এই মূর্তির মধ্য দিয়ে গোত্র তথা দ্বীপের অভিভাবক হিসেবে দেখাশোনার দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারেন এবং সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারেনএই বিশ্বাস থেকেই এগুলোর নির্মাণ।

মোয়াইগুলোর মধ্যে ৮৩৪ টিই আগ্নেয়গিরির ছাই অর্থাৎ টাফ এবং পাথর দিয়ে তৈরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জন শ্রমিকের এক বছরের সাধনায় তৈরি হতো একেকটি মূর্তি। এসব মূর্তি তৈরিতে ব্যাসল্ট পাথরের বাটালি ব্যবহার করা হতো। মূর্তিগুলো ব্যাসল্ট, রেড রক, স্কোরিয়া, ট্রাকাইট প্রভৃতি পাথর কেটেই নির্মিত। তবে এর মধ্যে শুধু তুকুতুরিইপুনা পাউনামক বিশেষ পাথর দিয়ে সৃষ্টি।

বৃহদাকার মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা ৩৩ ফুট ( ১০ মিটার) এবং এর ওজন ৮২ টন। মোটামুটি সবগুলো মূর্তির শুধু মাথার অংশেরই গড় উচ্চতা ১০ ফুট এবং গড় ওজন ১৪ টন। এর মধ্যে আবার অসমাপ্ত একটি মূর্তিও আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মূর্তিটি সম্পূর্ণ করা হলে এর ওজন হতো ২৭০ টন। আর উচ্চতা? ৬৯ ফুট বা ২১ মিটার!

অদ্ভুত গঠনের কাহিনী

প্রথম দেখাতে মনেই হতে পারে মোয়াই বা মূর্তিগুলো মুণ্ডুসর্বস্ব। তবে সে ভুল প্রথম ভাঙে ১৯১৪ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়িতে। এই বিশালাকার মাথার নিচে মাটিচাপা পড়ে আছে দৈত্যাকার দেহ। তবে সেই দেহের চাইতে মাথার মাহাত্ম্যই বোধকরি বেশি প্রচারিত, নইলে এই ২০১৯ সালে এসেও লোকেইস্টার আইল্যান্ড হেডসহিসেবেই চেনে ওই জায়গাকে।

মোয়াইদের চেহারার ভিন্নতা সর্বাগ্রে চোখে পড়বে আপনার। প্রশস্ত নাক , চারকোণা কান, শক্ত আর উদ্ধত চিবুক, ভারি ভুরু আর চোখের বাঁকা কোটরের তির্যক দৃষ্টিএসব বৈশিষ্ট্যই জানান দেবে মোয়াইদের অস্তিত্ব। এই মূর্তিগুলোর ঘাড়গুলো খুব প্রকাশিত নয়। তবে নাকের গর্তটা খেয়াল করলে চোখে পড়বে প্যাঁচালো নকশা। মাটির নিচেও আছে এর অনেকটা অংশ। শরীরটা বড়সড় হলেও পাটা বেশ ছোটই এদের। মাথার সাতেহ শরীরের অনুপাত ৩ঃ৮। তাহলে ভেবে দেখুন কী অবস্থা!

সবকিছু ছাড়িয়ে, মোয়াই আছে দাঁড়িয়ে;
Image Source: Unsplash

ভোজবাজির কাণ্ড

এত ভারি এই মূর্তিগুলো তৈরির কারিগরি নিয়ে রহস্যের পাশাপাশি এগুলোকে সারা দ্বীপে ছড়িয়ে সাজানো নিয়েও আছে জল্পনা কল্পনা। বিজ্ঞানীদের মতে কাঠের স্লেড গাড়ি, রশি আর লগ রোলারের সাহায্যেই ১৮ কিলোমিটারের এই দ্বীপের একস্থান থেকে অন্যস্থানে বহন করা হতো এই মোয়াইদের। তবে এর কোন যথাযথ প্রমাণ নেই।

অধিকাংশ মূর্তিই সাজানো হয়েছে গ্রামের দিকে মুখ করে। স্থানীয়দের বিশ্বাসমতে, মূর্তিতে রক্ষিত আত্মারা তাদের গ্রামের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। তবে একটি মাত্র মূর্তির মুখই সমুদ্র অভিমুখে। এর পেছনে রয়েছে আরেক বিশ্বাস। আহু আকিভি নামক স্থানে রাখা মূর্তিটিকে ধরা হতো সমুদ্র থেকে আসা যেকোনো বালাই কিংবা শত্রুর হাত থেকে রক্ষাকারী হিসেবে।

তবে জ্যোতির্বিদ্যায় যে প্রাচীন রাপা নুইরা বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন সেটা বোঝা যায় ১৮ টি মূর্তির অবস্থান পর্যালোচনা করলেই। দ্বীপে ১৮ টি মূর্তি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন  ২২ সেপ্টেম্বর এবং ২০ মার্চ (পৃথিবীতে দিন রাতের দৈর্ঘ্য সমান) দুইদিনে আড়াআড়িভাবে সূর্যের আলো পড়ে এগুলোর উপর।

অন্যরকম তুকুতুরি

এতগুলো মোয়াইয়ের ভিড়ে একজন একটু আলাদা। সে হলো তুকুতুরি। অন্যদের চাইতে আকারে বেশ ছোট এই মূর্তির দাঁড়ানোর ভঙ্গিও কিন্তু ভিন্ন। অনেকটা হাঁটু ভাঁজ করে অবস্থাতেই আছে পুনা পাউয়ে নির্মিত এই অদ্ভুতুড়ে মূর্তি। অবশ্য এর পেছনের কারণটা কারুরই জানা নেই।

তুকুতুরি- যেন এক অভিমানী মোয়াই
Image Source: G Planet

ডাক দেয় লুকানো ইতিহাস

প্রাচীন অধিবাসীদের জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা সংরক্ষিত হতো রঙ্গোরঙ্গো নামক বিশেষ লেখন পদ্ধতিতে। স্থানীয় রঙ্গোরঙ্গো শব্দের অর্থ হলোমহান বার্তার পাঠ।  রাপা নুইদের নেতা হতু মাতুর সময়ে এই বার্তাগুলো লেখা হয়েছিল কাঠের ফলকে খোদাই করে। পর্যন্ত ৬৭ টি ফলক উদ্ধার করা হয়েছে যেগুলোর মূল বিষয়জ্যোতির্বিদ্যা এবং নৌবিদ্যা। তবে এর মর্মোদ্ধারে খুব একটা সফল হয়নি বর্তমানের প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তাছাড়া বর্তমান রাপা নুইরা অবশ্য এই ভাষা সম্পর্কে পুরোটাই অজ্ঞ।

ভিন্ন ভাবনার অবতারণা

মোয়াইদের অদ্ভুত মুখায়বয়বের পেছনের ভিন্ন এক তত্ত্ব তুলে ধরেছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইকিয়াট্রির সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আনেলিস পন্টিয়াস। তাঁর গবেষণামতে, কোন এক সময়ে এই গোত্রে লিপ্রোসি নামক এক চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ে মহামারী আকারে। এর ফলে মুখের বিশেষত নাক ঠোঁটের আকৃতি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের। সম্ভবত সেই মহামারী থেকে রক্ষা পেতেই এমন অদ্ভুত দর্শন অতি নিখুঁত সৌন্দর্যের মূর্তি নির্মাণ।

টুরিস্টের কান্ড

২০০৮ সালে ফিনল্যান্ডের এক টুরিস্ট করে ফেললেন বিশাল বোকামি। মার্কো কুলজু নামক ওই ব্যক্তি স্রেফ আগ্রহের বশেই এক মূর্তির কান কেটে নেন স্যুভেনির হিসেবে। তবে স্থানীয়দের সহায়তায় শীঘ্রই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে এবং জরিমানা করে ১৭ হাজার ডলার! তবে এতেই শেষ নয়। মার্কোকে গৃহবন্দিও রাখা হয় কিছুদিন। চিলির এক পত্রিকার মাধ্যমে জনতার কাছে ক্ষমাও চান তিনি।

মূলত এই ঘটনার পর থেকেই ইস্টার আইল্যান্ডে নামে কড়াকড়ির বহর। বেশ বাছাই করেই এখন অনুমতি দেয়া হয় টুরিস্টদের।

বৈশ্বিক উষ্ণতার গ্রাসে আছে ইস্টার আইল্যান্ডও;
Image Source: Lonely Planet

ইস্টার আইল্যান্ডও বৈশ্বিক উষ্ণতার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত নয়। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি খরাও দেখা দিয়েছে এই অঞ্চলে। ইতোমধ্যেই আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে পড়া অঞ্চলের বিখ্যাতস্মিথসোনিয়ান তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে মোয়াইদের এই দ্বীপ।

লেখক- সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *