ইসলামিক স্টেট(IS)- এর ইতিকথা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট1 min read
Reading Time: 3 minutesআইএসআইএস (ISIS) এর পূর্ণরূপ হলো ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া। এটি ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক একটি সংঘটন যা বিভিন্ন দেশে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে নানা অপকর্ম করে আসছে। বর্তমানে আইএস সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
আইএস কি তা বুঝতে হলে আমাদেরকে একদম গোড়ায় যেতে হবে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের একনায়ক সরকারকে রক্ষা করার জন্য সরকার বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে। তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য রুখে দাঁড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের একদল তরুণ বিদ্রোহী। সেই যুবকদের মধ্যে একজন ছিলেন সৌদির শিক্ষিত যুবক ওসামা বিন লাদেন। তারা এ বিদ্রোহকে ধর্মীয় সংগ্রাম বলে আখ্যা দেয় ফলে এ আন্দোলনে যুক্ত হয় অন্যমাত্রা।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে তখন অবস্থান করছিল আবু মুসাব যারক্বী নামের একজন স্বল্প শিক্ষিত যুবক। তার আদি নিবাস জর্ডানে। সেখানে সে রাস্তায় রাস্তায় চুরি-ডাকাতি করতো। তার সাথে লাদেন মিলিত হয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে যার নাম দেয় আল-কায়েদা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৯ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের বিধিনিষেধ তুলে নেয়। ফলে আরবের প্রতিবাদী জনগণও তাদের ঘরে ফেরে।
কিন্তু বিন লাদেনের আল-কায়েদার কার্যক্রম বন্ধ হয় নি। বরং তারা এ সংঘটনের সীমা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। তারা বিশ্বে ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস করার নামে হামলা করতে থাকে। যারক্বী নিজেও একটি গ্রুপ তৈরি করে কিন্তু সেটা বেশিদিন টিকে নি। কিছুদিন পর লাদেন ও যারক্বী আফগানিস্তানে ফিরে আসে এবং তালেবান জঙ্গি গোষ্ঠীতে নাম লেখায়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে বোমা হামলার মাধ্যমে আল-কায়েদা আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমন করে। তখন ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। যারক্বী তখনও পর্যন্ত লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। সেও সুযোগ বুঝে ইরাকের এক প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান নেয়।
দুই বছর পরে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরিকল্পনা করে ইরাক আক্রমণ করে। তারা ইরাকের ধর্মনিরপেক্ষ নেতা সাদ্দাম হোসেনের একনায়কতন্ত্র বিনষ্ট করে এবং ইরাকে সেনাবাহিনী নিষিদ্ধ করে। চাকরিচ্যুত হয়ে হাজার হাজার সৈন্য রাগে, ক্ষোভে, বেকারত্বের অভিশাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। জিহাদী ও সুন্নীরা যুক্তরাষ্ট্রের এ আক্রমনকে সোভিয়েত আক্রমণের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখে। তাই তারাও এই যুদ্ধে নেমে পড়ে। তাদের সাথে যারক্বীও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যারক্বীর গ্রুপ ইরাকের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্রুপে পরিণত হয়। তারা মূলত শিয়া জাতিকে আক্রমণ করে। যখন এটি সহ্যসীমার বাইরে চলে যায় তখন সুন্নী-শিয়া গৃহযুদ্ধ চরম রূপ নেয়।
২০০৪ সালের মধ্যে যারক্বী নামকরা জিহাদী হয়ে যায়। এদিকে লাদেনের গ্রুপ আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন ও দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই লাদেনও যারক্বী গ্রুপের সাথে মিলিত হয়ে নতুন আল-কায়েদা বাহিনী গঠন করে। এদিকে ২০০৬ সালে ইরাকের সুন্নীরা যারক্বীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আর তখনই যুক্তরাষ্ট্রের এক বিমান হামলায় যারক্বী নিহত হয়।
যারক্বীর মৃত্যুর পর আল-কায়েদা বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে নি। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল হয়ে যায়। সেসময় আরব বসন্ত সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় তখন বাশার আল আসাদ বিক্ষোভকারীদের উপর হিংস্র হয়ে ওঠায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আসাদ এতে ভয় পেয়ে যান। কারণ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ তার বিপক্ষে যেতে পারে। তাই সে কৌশলে জিহাদীদের সিরিয়ার কারাগার থেকে মুক্তি দেয় এবং অন্য দেশে গিয়ে যাতে আর কোন আক্রমণ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করে।
আল-কায়েদার কিছু জিহাদী তখনও ইরাকে রয়ে যায় যারা পরবর্তীতে ইসলামিক স্টেট নামে নতুন সংঘটন তৈরি করে। এ সংঘটন আবু বকর আল বাগদাদী দ্বারা পরিচালিত হয়। ২০১২ সালের গোড়ার দিকে বাগদাদী গ্রুপ নতুন করে কার্যক্রম শুরু করে। তারা ইরাকের কিছু কারাগারে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। সেখান থেকে পুরনো জিহাদীদের মুক্ত করে নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বাগদাদী ঘোষণা করে যে, এখন থেকে আল-কায়েদা তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং যেহেতু এটি ইরাক ও সিরিয়ায় বিস্তৃত তাই এর নতুন নাম হবে আইএসআইএস (ISIS)। ২০১৪ সালে বাগদাদীকে ক্ষমতা থেকে প্রত্যাহার এবং নির্বাসিত করা হয়।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের আশ্রয়ে ISIS সিরিয়ায় বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ২০১৪ সালে তারা সেখানে তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী তৈরি করে। অপরদিকে, ইরাকে সুন্নী গোষ্ঠী দূর্বল হয়ে পড়ায় সেখানেও ISIS প্রভাব বিস্তার করে। ISIS এর লক্ষ্য হলো তারা আল-কায়েদার চেয়ে আরো ধ্বংসাত্মক হবে এবং বিশ্বের সকল মুসলমানকে তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করবে। তাদের ধারণা, তারা ধর্ম রক্ষার মতো পবিত্র আন্দোলন করছে। তাদের এসব কথা শুনে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে হাজারো মুসলিম তাদের দলে যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছে এ গোষ্ঠী অন্য একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে।
ISIS ইরাক ও সিরিয়ায় কুর্দী অঞ্চলে হামলা চালায়। কিন্তু সেখানে কুর্দী সেনাবাহিনী আরও বেশি শক্তিশালী হওয়ায় তারা খুব বেশি কাবু করতে পারে নি। উপরন্তু তাদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের জেমস ফলি নামের এক সাংবাদিক খুন হন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়ে আইএস এর উপর আক্রমণ করে। এতে ISIS তাদের সাম্রাজ্যের প্রায় এক পঞ্চমাংশ হারায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইএস আইএস বিদেশে হামলা শুরু করে। তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো কুয়েত সিটি, সিনাই, বৈরুত, এমনকি প্যারিস হামলা ও অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় হামলা। কিন্তু দিনকে দিন এই জঙ্গি সংঘটন দূর্বল হতে থাকে। হয়ত একসময় এটি তার সাম্রাজ্য হারাবে। কিন্তু সংঘটনটি আবার যেকোন সময় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে যেমনটি পূর্বে হয়েছিল।
লেখক- নিশাত সুলতানা
আরও পড়ুন- সিআইএ (CIA) ইসলামিক স্টেট (আইএস) সৃষ্টি করেছে- জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ