বিশ্ব

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস1 min read

মে ২৪, ২০১৯ 6 min read

author:

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস1 min read

Reading Time: 6 minutes

বেশ কিছুদিন থেকে কানাঘুষা চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আলাদাভাবে জানিয়েছেন, তারা যুদ্ধ চান না। কিন্তু তারা আবার এটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, স্বার্থ রক্ষার বেলায় কোন আপস নয়। মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের এই বিপরীতমুখীতা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। কালের পরিক্রমায় বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকে তাদের এই মুখোমুখি অবস্থান।

সময়ের সাথে এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নানাভাবে এগিয়ে চলেছে। তাদের সম্পর্কের টানাপোড়ন যদি কিছু ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখানো যায় তাহলে চিত্রটা আরো পরিষ্কার হবে।

আগস্ট ১৯, ১৯৫৩— যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সহায়তায় ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুনরায় ইরানের স্বৈরাচারী শাসক রেজা শাহ পাহলভী ক্ষমতয় আসেন।

ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯৫৫— ইরান যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান করে যা স্যান্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (স্যান্টো) নামে পরিচিত।

১৯৫৭— যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার উপর একটি চুক্তি সাক্ষর করে।

১৯৬৪— শাহের তীব্র সমালোচক এবং কঠোর ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনিকে ১৪ বছরের জন্য ইরাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৬৭— যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে তেহরান রিসার্চ রিয়্যাকটর (TRR) সরবরাহ করে যা ৫ মেগাওয়াট পারমাণবিক  চুল্লীর একটি আগ্নেয়াস্ত্র। এর জ্বালানির ৯৩ শতাংশই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ।

১৯৬৮— ইরান পারমাণবিক শক্তির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ (NPT) শীর্ষক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরের দুই বছর পর আবার চুক্তি অনুযায়ী তাকে পারমাণবিক কর্মসূচী গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে।

১৯৭৯— ১৬ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট শাহ ইজিপ্টে পালিয়ে যান। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে খামেনি ইরাকের নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন এবং ইরানে নতুন সরকার গঠন করেন। ইরানের নবগঠিত সরকার পূর্ণ ধর্মানুরাগী। খামেনি বাগদাদ চুক্তির ইতি টানেন। নভেম্বরের ৪ তারিখে ইরানের ছাত্ররা শাহকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে তেহরানে অবস্থিত আমেরিকার দূতাবাসের ৬৩ জনকে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখে। ফলস্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তাদের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

১৯৮০— যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেই থেমে থাকেনি তারা ইরানের সাথে বেশিরভাগ বাণিজ্য চুক্তি বানচাল ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইরানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নির্দেশে একটি বিমান ইরানে জিম্মি মার্কিন কর্মকর্তাদের মুক্ত করার জন্য রওনা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে বিমানটি দূর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং ৮ জন কর্মী নিহত হন। সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বরে পশ্চিমা ভাবধারাপুষ্ট ইরাক ইরানে আক্রমণ করে। এ যুদ্ধ ৮ বছর স্থায়ী হয়।

১৯৮১— এ বছরের ২০ জানুয়ারি অবশিষ্ট ৫২ জন মার্কিন জিম্মিকে ইরান মুক্তি দেয়। সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রোনাল্ড রিগ্যান।

১৯৮৪—  যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সন্ত্রাসবাদের আস্তানা বলে ঘোষণা করে।

১৯৮৫-৮৬— যুক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়াকে গোপনে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে কারণ তখন ইরান ও নিকারাগুয়ার মধ্যে সংকট চলতে থাকে। আর নিকারাগুয়া হলো কমিউনিস্ট বিরোধী রাষ্ট্র।

১৯৮৮— পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ভুলবশত ইরানের একটি বিমানে আক্রমণ করা হয়। ফলে ২৯০ জন আরোহীর মৃত্যু হয়। জুলাই মাসের ৩ তারিখে এ ঘটনাটা ঘটে।

১৯৯১— উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরান নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে।

১৯৯৫— যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ইরানের উপর তেল ও অন্যান্য বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান করেন। তবে তিনি অভিযোগ করেন, তেহরান সন্ত্রাসীদের পুষছে আর গোপনে অস্ত্র ব্যবহার করে বড় ধরণের ক্ষতি করার চিন্তা করছে।

১৯৯৬— ক্লিন্টন এক বছরে ইরানে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার চেয়েও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং ইরানের সাথে বাণিজ্যনীতি আরো জোরদার করেন।

১৯৯৭— ইরানের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ইউএস নেটওয়ার্ক টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মার্কিন নাগরিকদের সাথে সংলাপের জন্য আহবান জানান।

২০০০— ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে ইরানের নবনির্বাচিত সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র তেল চুক্তি সম্পন্ন করে। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে ততকালীন মার্কিন স্টেট সচিব মেডেলিন অলব্রাইট  ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল খারাজির সাথে সাক্ষাৎ করেন। এটি ছিল ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো দুদেশের মধ্যে কোন সফল বৈঠক।

২০০১— এই বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, সৌদি আরবে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উপর বোমা হামলায় ইরান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সেপ্টেম্বর মাসে সিআইএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে এবং চীন ও রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আমদানি করছে।

২০০২— যুক্তরাষ্ট্রের ততকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জানুয়ারির ২৯ তারিখে ঘোষণা দেন ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়া হলো “অ্যাক্সিস অব এভিল”। সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের বুশেহর নামক স্থানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ান প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মিত হয় পারমাণবিক চুল্লী। ইরান সরকার বিরোধী একটি গ্রুপ সিআইএকে জানায়, ইরান আরো আগে থেকেই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে দুটি জায়গায় পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ করে। যার একটি হলো নাতানজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্ল্যান্ট, আর অন্যটি আরাক নামক স্থানে হ্যাভি ওয়াটার-মডারেটেড পারমাণবিক চুল্লী।

২০০৩— সিআইএ কর্তৃক এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) ইরানের অত্র দুই এলাকা পরিদর্শন করে বলে, ইরান এ প্রকল্প তৈরি করেছে ভবিষ্যতের জ্বালানি মজুদ রাখতে। এরপর জাতিসংঘ ইরানের এই পারমাণবিক প্রকল্পগুলো আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে এবং ইউরেনিয়াম প্রকল্প বাতিল করে। IAEA এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, ইরান প্লুটোনিয়াম তৈরি করছে ঠিকই কিন্তু সেখানে আণবিক বোমা তৈরির কোন আলামত মেলে নি। ২০০৩ সালে ইরানে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ দুর্যোগে প্রায় ৫০০০০ ইরানি নাগরিক প্রাণ হারান। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র জনবল দিয়ে ইরানকে সাহায্য করে।

২০০৪— ইরান ইউরোপে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে।

২০০৫— ইরানের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য) বাণিজ্য নিয়ে বৈঠক করে। সেখানে তারা ইরানকে স্থায়ীভাবে ইউরেনিয়াম প্রকল্প বন্ধ করার আহবান জানায়। সে বছর মার্চে প্রেসিডেন্ট বুশ তাঁর কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাণিজ্যে প্রচুর সুবিধা দিবে যদি তারা ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ভণ্ডুল করতে পারে। তিনি আরো বলেন, ইরান যদি তার অবস্থান থেকে সরে না আসে তাহলে তাকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ থেকে এক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে। ইরানের তখনকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আহমাদিনেজাদকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে। তাদের মতে, তিনি ১৯৭৯ সালের জিম্মি সংকটের মূল নেতা ছিলেন।

২০০৬— যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানের গোপন পারমাণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে যে অবরোধ তৈরির কথা উঠে তা ওয়াশিংটন অস্বীকার করে। ইরান এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে অভিযোগ করে এবং জানিয়ে দেয় ইরান যে কোন হামলার উপযুক্ত জবাব দেবে। ইরান এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি আলোচনার আমন্ত্রণ জানালেও পরে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ইউরেনিয়াম প্রকল্প বন্ধ করার শর্তে ইইউতে আলোচনার আহবান জানায়।

২০০৭

জানুয়ারি— ইরানের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ইরাকের যুদ্ধে জড়িত থাকায় ইউএস বাহিনী তাদের আটক করে। কিছুদিন পর বলা হয় ইরানে আল-কায়েদা অবস্থান করছে।

মে— ইজিপ্টের সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনুচেহের মুত্তাকীর সাথে মার্কিন স্টেট সচিব  কন্ডোলিজা রাইসকে অল্পস্বল্প কথা বলতে দেখা যায়।

সেপ্টেম্বর— ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ খ্যাত টুইন টাওয়ার পরিদর্শন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন সামরিক দ্বন্দ্ব তৈরি করছে না।

অক্টোবর— যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারী কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস হাসান কাজেমী ক্বওমীকে ইরানের বিপ্লবীদের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনেন।

নভেম্বর— ইরাকে ইউএস বাহিনী ২০ জন ইরানি নাগরিককে মুক্তি দেয়। IAEA প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, ইরান অতীতের পারমাণবিক কার্যক্রমের স্বচ্ছ বিবরণ দিয়েছে। তবে বর্তমান কর্মসূচি পরিষ্কার নয়।

ডিসেম্বর— আমেরিকার এক গোয়েন্দা সংস্থা জানায় ২০০৩ এর আরও পূর্ব থেকে এখনও পর্যন্ত ইরান ইউরেনিয়াম প্রকল্প বহাল রেখেছে। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যদি ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম সবার সামনে প্রকাশ না করে তাহলে ইরানকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট গেটস বাহরাইনের এক সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট করা সত্ত্বেও ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের হুমকিস্বরূপ।

ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পারমাণবিক গবেষণায় গুপ্তচরবৃত্তির প্রতিবাদে একটি অফিসিয়াল চিঠি পাঠায়।

২০০৮— ইউএস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তাঁর স্টেট সচিব বিল বার্নসকে দিয়ে ইরানের কাছে প্রথমবারের মতো একটি অফিসিয়াল চিঠি পাঠান। তাতে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র জেনেভায় ইরানের সাথে সরাসরি পারমাণবিক সমঝোতা নিয়ে আলোচনা করতে চায়।

২০০৯— যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। তিনি ইরানের নেতৃবৃন্দেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক। তবে ইরানকেও নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে না।

ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইউএস ঘোষণা করে, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্রকল্প নির্মাণ করছে। ইরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলে, অভিযুক্ত সেই স্থানটি জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি পর্যবেক্ষণ করে গেছে। ২০০৯-১২ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়।

২০১২— যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোর সব ব্যাংক এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, তারা যেন ইরানিয়ান তেল আমদানি না করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ চেষ্টা সফল হয়। ফলে ইরানের তেল বাণিজ্য হু হু করে নিম্নমুখী হতে থাকে। ইরান পড়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিউক্লিয়ার ইস্যুকে নিয়ে আলোচনা ২০১৩ সালের দিকে এসে আরও গভীরতর হতে থাকে।

২০১৩— বাস্তববাদী নেতা হাসান রুহানি ইরানের সাথে বিশ্বের সুসম্পর্ক তৈরি ও ইরানের অর্থনীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

২৮ সেপ্টেম্বরে ওবামা ও রুহানির মধ্যে ফোনালাপ হয় যা বিগত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ফোনালাপ। নভেম্বরের ২৩ তারিখে বিশ্বের ছয় পরাশক্তির উপস্থিতিতে ইরান-ইউএস গোপন বৈঠক হয়। সবাই মিলে একটা চুক্তি সাক্ষর করে যেটা জয়েন্ট প্ল্যান অব অ্যাকশন (JPOA) নামে পরিচিত। ইরান চুক্তি অনুযায়ী নিউক্লিয়ার ইস্যু কিছু শর্তের বিনিময়ে নমনীয় করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ছয় পরাশক্তিগুলো হলো : যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি ও রাশিয়া।

২০১৫— জুলাইয়ের ১৪ তারিখে ছয় পরাশক্তিকে নিয়ে ইরান আরেকটি চুক্তি সাক্ষর করে যা ইতিহাসে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA) নামে পিরিচিত। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরান আরাকের প্রধান পারমাণবিক চুল্লীটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ বিনষ্ট করবে বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের বিরুদ্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে।

২০১৬— জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে ইরান তাদের জলসীমার ভিতর থেকে দুটি ছোট নৌকাসহ ১০ মার্কিন নাবিককে গ্রেপ্তার করে। তাদের ইরানের হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৬ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান নিজেদের মধ্যে জেল বিনিময় চুক্তি ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী ইরান চার জন আমেরিকানকে মুক্তি দেয় বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রও কয়েকজন ইরানিকে মক্তি দেয়।

পরবর্তীতে IAEA এটা নিশ্চিত করে যে, ইরান JCPOA চুক্তি অনুযায়ী তার পারমাণবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের উপর থেকে পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ২০১৯ সালে এসে দৃশ্যপ্ট আবার পাল্টাতে শুরু করে। এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আবার উত্তেজনা তৈরি হয়। কারণ ১২ ও ১৩ মে এর মধ্যে পারস্য উপসাগরের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের চারটি জাহাজে রহস্যজনকভাবে অন্তর্ঘাতী হামলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে এ আক্রমণ ইরান অথবা ইরান সমর্থিত কেউ করেছে। ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেটা হরমুজ প্রণালীর খুব নিকটে। হরমুজ প্রণালী দিয়ে সাড়া বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ তেল সরবরাহ করা হয়। গত মাসে ইরান হুমকি দিয়ে বলেছিল, ইরানি তেল আমদানিকারক দেশগুলোতে যদি আবার মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, তাহলে ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে। এমন হুমকিতে যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরের ঐ এলাকায় বিমানবাহী জাহাজ, উভচর জাহাজ ও বোমারু বিমান স্থাপন করেছে।তাহলে কি এটি কোন যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি? উত্তরটা সময়ই বলে দেবে।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

আরও পড়ুন- ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতার শুরু যেভাবে

আরও পড়ুন- সৌদি-মার্কিন বন্ধুত্বের একাল সেকাল

আরও পড়ুন- আমেরিকা-কিউবার সরল গরল সম্পর্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *