ইতিহাস বিশ্ব

ইরান জিম্মি সংকট: ৪৪৪ দিন স্থায়ী যুক্তরাষ্ট্র-ইরান টানাপোড়ন1 min read

ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০ 4 min read

author:

ইরান জিম্মি সংকট: ৪৪৪ দিন স্থায়ী যুক্তরাষ্ট্র-ইরান টানাপোড়ন1 min read

Reading Time: 4 minutes

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দা-কুমড়া সম্পর্কের ইতিহাসে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইরান জিম্মি সংকট। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৪৪ দিন ইরান ৫২ জন মার্কিন কূটনীতিক ও নাগরিককে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে বন্দী করে রাখে। এটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না এ ঘটনাটি দুদেশের বৈরি সম্পর্কের আগুনে নতুন উত্তাপ যোগ করে। তবে কোন একটি নির্দিষ্ট কারণে এ ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছে এমনটি বললে হয়তো ভুলই বলা হবে। এই ঘটনাটির প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের আরও পেছনে ফিরে যেতে হবে।

রেজা শাহ পাহলভি ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব

ইরানের তেল উত্তোলনের শুরু থেকেই শাহ রাজ পরিবারের ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অনায্য সুবিধা নিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের স্বার্থে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমা দেশ থেকে শিক্ষা অর্জন করা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। মোসাদ্দেক ১৯৫১ সালে ইরানের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন সাহসী এবং শিক্ষিত। নিজ দেশের তেল সম্পদের ওপর অন্য দেশের প্রভাব বন্ধ করতে তিনি তেল সম্পদকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তে ইরানের জনগণ খুশি হলেও, যুক্তরাজ্য  ও যুক্তরাষ্ট্র ছিল নারাজ। এই দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও এমআই-৬ মিলিত হয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা আঁটে।

১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সমর্থিত এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরানের ক্ষমতায় বসে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের বন্ধু রেজা শাহ পাহলভি। কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক সাহায্যের লোভে রেজা শাহ ইরানের মজুতকৃত তেলের ৮০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের হাতে তুলে দেন।

রেজা শাহ পাহলভি

রেজা শাহর দুঃশাসন ও ইসলামী বিপ্লব

রেজা শাহ ক্ষমতায় বসে নিজেকে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিরুদ্ধ কণ্ঠ রোধ করতে শাহ “সাভাক” নামে তার একটি গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন। শাহের অপশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খোলা হাজার হাজার ইরানি নাগরিককে সাভাকের অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হয়।

ইরানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গোলানো এমনিতেই ইরানিরা ভালো নজরে দেখতেন না। তার উপর আবার শাহ নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অস্ত্র কিনতে থাকেন। ইরানের অর্থনীতির বাজে অবস্থার মধ্যে শাহ’র এমন সব কাজ ইরানিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। সাভাক বাহিনীর নির্যাতন উপেক্ষা করে ইরানি নাগরিকরা শাহ’র বিরুদ্ধে এক হতে শুরু করে। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে  শুরু হয় ইসলামি বিল্পব। তীব্র জনরোষের মুখে ১৯৭৯ সালে জানুয়ারিতে ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন রেজা শাহ। ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে ইরানের ক্ষমতায় বসেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তিনি ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেন।

আরও পড়ুন- ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: যেভাবে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়েছিল ইরান এয়ার ফ্লাইট ৬৫৫

জিম্মি সংকটের টানাপোড়ন

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি সব স্বাভাবিক হতে চললেও ইরানি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভের রেশ তখনও বিরাজ করছিল। এদিকে ইরান থেকে বিতাড়িত রেজা শাহ এক দেশ থেকে আরেক দেশে আশ্রয় খুঁজছিলেন। এমন অবস্থায় রেজা শাহ চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোয় আবার নতুন করে ইরানিদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।

রেজা শাহ ১৯৭৯ সালের ২২ অক্টোবর চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্ক হাসপাতালে পৌছান। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার জানতেন রেজা শাহ’কে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারটি ইরান স্বাভাবিকভাবে নেবে না। কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার, ডেভিড রকফেলারের মতো বাঘা আমেরিকান কূটনীতিকদের চাপের মুখে তিনি শাহ’কে আশ্রয় দিতে বাধ্য হন।

মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিপ্লবী ইরানি ছাত্রদের অবস্থান

এর ফলাফলে ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর ইরানের একদল ছাত্র তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে প্রবেশ করে ৬৩ জন মার্কিন নাগরিককে জিম্মি করে ফেলে। একই দিন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অবস্থান করা আরও তিন মার্কিন নাগরিক পরবর্তীতে এই তালিকায় যোগ হলে মোট জিম্মির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৬ জনে।

এই ঘটনার ১৩ দিন পরে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নির্দেশে ১৩ জন জিম্মিকে মুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় আরও একজন জিম্মি মুক্তি পান। সবশেষে বন্দী থাকেন ৫২ জন জিম্মি।

ইরান এই বন্দীদের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রেজা শাহ’কে ফিরিয়ে দিতে বলে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে রাজি না হওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলা হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক চেষ্টা করে সমাধানে আসতে ব্যর্থ হলে ইরানের উপর নানা রকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইরানের কোটি কোটি ডলারের পণ্য বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু তাতেও কোন সমাধান মেলে না।

আরও পড়ুন- ইরান-যুক্তরাষ্ট্র শত্রুতার শুরু যেভাবে

আরও পড়ুন- ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস

অপারেশন ঈগল ক্ল

সব ধরণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরানে বন্দী জিম্মিদের উদ্ধার করতে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ঈগল ক্ল নামের একটি সামরিক অপারেশন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলিট ফোর্সের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ একদল প্রশিক্ষিত সেনা ইরানে গিয়ে জিম্মিদের উদ্ধার করবে- এই ছিল কার্টার প্রশাসনের পরিকল্পনা। কিন্তু এই অপারেশন পরিচালনা করার পুরো পরিকল্পনাটি ছিল অতি মাত্রায় জটিল এবং ভুলে ভরা।

ইরানের মরুভূমির বালু ঝড় এবং অপারেশনে ব্যবহৃত হেলিকপ্টারগুলির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রেসিডেন্ট কার্টার এই অপারেশন বাতিল করতে বাধ্য হন। উপরন্তু এই অপারেশনে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ সেনা নিহত হন এবং সেই সাথে বিধ্বস্ত ও ফেলে আসা হেলিকটারগুলি ইরানের মাটিতেই থেকে যায়। এই ঘটনায় কার্টার প্রশাসন ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে।

ইরানের মাটিতে বিধ্বস্ত হওয়া অপারেশন ঈগল ক্ল’তে ব্যবহৃত মার্কিন হেলিকপ্টার

জিম্মি সংকটের দৃশ্যপটে কানাডার বীরত্ব

তেহরানের যেদিন ইরানি বিদ্রোহী ছাত্ররা মার্কিন দূতাবাসের দখন নেয়, সেদিন ছয় জন আমেরিকান কূটনীতিক পালাতে সক্ষম হন। তারা তেহরানের কানাডিয়ান কূটনীতিক জন শেয়ারডাউনের বাসায় আশ্রয় নেন। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জো ক্লার্ক বিশেষ বিবেচনায় সেই ছয় মার্কিন কূটনীতিকে কানাডার পাসপোর্ট নিয়ে ইরান ত্যাগ করতে সাহায্য করেন। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনাটি “কানাডিয়ান কেপার (Canadian Caper)” নামে জায়গা করে নিয়েছে।

জিম্মি সংকটের সমাধান

অপারেশন ঈগল ক্ল’ এবং জিম্মি সংকটের ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে ১৯৮০ সালের মার্কিন নির্বাচনে জিমি কার্টার চরমভাবে পরাজিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রোনাল্ড রিগ্যান। অপরদিকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে ইরানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। সেই সাথে ইরানের অর্থনীতির চাকাও স্থবির হয়ে পড়ে।

সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইরান তাদের ওপর আরোপিত সকল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে হবে এমন শর্তে জিম্মিদের মুক্ত করতে সম্মত হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে রোনাল্ড রিগ্যানের শপথ গ্রহণের কয়েক ঘন্টা পরেই ৫২ জন জিম্মিকে মুক্ত করে দেয় ইরান। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৪৪৪ দিনের দীর্ঘ জিম্মি নাটক।

লেখক- হাসান উজ জামান 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *