ইরফান খান: স্বচ্ছ সলিলের মতো জীবন ছিল যার 1 min read
Reading Time: 9 minutes‘মানুষের জন্মই হয় অজানাকে জয় করবার জন্য। এছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য বড় হতে পারে না।‘
বিনয় পাঠকের সাথে আলাপচারিতায় এভাবেই জীবনের বিশাল সমীকরণকে কয়েক শব্দে বেঁধে দিয়েছিলেন ইরফান।
সর্বশেষ ছবির প্রচারণায় দর্শককে আহ্বান জানিয়েছিলেন শিল্পের কদরে এগিয়ে আসতে, ঠাট্টা করেছিলেন নিজের শরীরে বাসরত কর্কট রোগকে নিয়েও। ক্যান্সারের সাথে বোঝাপড়া কিছুটা সময় দিলেও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছিলেন। কদিন আগে ভর্তি হয়েছিলেন মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানী হাসপাতালে। গত ২৯ এপ্রিল সকালে কোলন ইনফেকশন কেড়ে নেয় এই সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের জীবন।
পিচ থেকে রিলে
১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি রাজস্থানের জয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন শাহেবজাদা ইরফান আলী খান। মুসলিম পশতুন পরিবারের গোড়া কিন্তু টংকে। ব্যবসায়ী বাবা জাগিরদার খান ছিলেন ভীষণ মেজাজি, প্রায়ই বন্দুক হাতে বেরিয়ে পড়তেন শিকারে। বন্দুকের প্রতি ইরফানেরও ছিল অমোঘ আকর্ষণ। কিন্তু প্রাণবধের ভাবনাটা বিচ্ছিরি মনে হতো অল্প বয়সেই। সম্পূর্ণ মন পড়ে থাকতো নীল আকাশে ছুটে চলা ঘুড়ির সুতোয়।
‘বাবা বলতেন পাঠানের ঘরে ব্রাহ্মণ জন্মেছে। বাবা চাইতেন শিকার করি, কিন্তু আমার মন ছিল আকাশে, ঘুড়ির সাথে।‘ এতদিন বাদে যেন ঘুড়ি ওড়াবার সেই বৃহৎ আকাশেই ঠাই হলো তাঁর।
রাজস্থানের টংকেই শৈশবের দুরন্তপনায় আস্কারা পেতেন। নানীর কাছেই ছিল রাজ্যের আবদার আর শাসনহীনতার বিশাল অরণ্য।
বন্ধুদের সাথে প্রাণের যোগ বরাবরই ইরফানকে শিখিয়েছে নতুনের পথে এগুতে। সতীর্থ সতীশ শর্মার প্রেরণাতেই ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছিলেন। এমনকি ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সিকে নাইডু টুর্নামেন্টে অনূর্ধ্ব ২৩ দলেও জায়গা মিলেছিল। তবে পারিবারিক সিদ্ধান্ত আর অর্থাভাবে খেলার জগত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
ভাগ্যদেবী সহায় হয়েছিলেন এর কিছু পরেই। জয়পুরের রায়সান কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে পাশ করার পর জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগেও ভর্তি হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। এর মাঝে রবীন্দ্র মঞ্চে নাটকের সুবাদে অভিনয়ের ভূত চাপে মাথায়। ওদিকে তখন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার নামডাক উচ্চস্বরেই বাজছিল ইরফানের কানে। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরীর মঞ্চ কাঁপানো অভিনয় দেখার জন্য হলেও একবার সেখানে যাওয়া চাই!
এই জেদে চেপেই ১৯৮৪ সালে এনএসডিতে বৃত্তিও লাভ করেন। তবে এর পেছনে মাকে ছোট্ট মিথ্যেও বলতে হয়েছিল তাঁকে। মা সাইদা খান অবশ্য ধীর জীবনকেই প্রাধান্য দিতেন সবসময়। ছেলে অধ্যাপক হবে- এই বিশ্বাসে এনএসডিতে পাঠান বড় ছেলেকে।
ইরফান তখন বেপরোয়া, জয়পুরের পাট চুকাতে সে ব্যস্ত। অভিনয়ের নেশায় ডিপ্লোমার পরপরই পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে।
নায়কের ভিড়ে অভিনেতা
সিনেমার পথ একেবারেই মসৃণ ছিল না তাঁর জন্য। প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও মন ভেঙেছে বারবার। ১৯৮৮ সালে মিরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বাই’য়ে ছোট চরিত্রে সুযোগ পেয়েছিলেন। দুই মাস কর্মশালার পর জানতে পারেন সেই চরিত্র বাদ পড়বে চিত্রনাট্য থেকে। পরে পত্রলেখকের চরিত্রে দুই মিনিটের জন্য অভিনয় করেছিলেন। নজরে পড়েননি তখন।
তবে জহুরির চোখকে ফাঁকি দেয়া কি এত সোজা! বাঙালি পরিচালক বসু চ্যাটার্জি ও তপন সিনহা ঠিকই সন্ধান পেলেন আগামীর তারকার। ১৯৮৯ সালে বাসুর ‘কমলা কি মউতে’ ছবিতে অজিত এবং ১৯৯০ সালে তপন সিনহার ‘এক ডাক্তার কি মউত’ ছবিতে ছোট কলেবরে গুরুত্ববহ চরিত্রে দেখা গেলো ইরফানকে। এর মধ্যে ‘এক ডাক্তার কি মউতে’ ছবিটি শাবানা আজমি, পঙ্কজ কাপুর অভিনীত। জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত এই ছবিতে সাংবাদিক রূপে পর্দায় আসেন ইরফান। রমাপদ চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয় এটি।
আর্ট ঘরানায় ইতোমধ্যেই পরিচিতি মিলে গেছে। সে সূত্রেই গোবিন্দ নিহালানির ‘দৃষ্টি’ তে ডাক পেলেন। শেখর কাপুর, ডিম্পল কাপাডিয়ার সাথে স্ক্রিন ভাগের সুযোগটা ক্যারিয়ারে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে ইরফানের জন্য।
ওদিকে মুম্বাইয়ে এক ঘরে কোনমতে কাটছিল দিন। এসি মেরামত, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেও ক্লান্তি ছিল না তাঁর। সুপারস্টার রাজেশ খান্নার ঘরেও মিস্ত্রির কাজ করেছিলেন একসময়।
ছোট পর্দায় বড় স্বপ্নবাজ
ভারতে টেলিভিশনের জমানা শুরু হয় আশির দশকে। দূরদর্শনে ছোট কিছু টেলিছবিতে কাজের ডাক পেতে থাকেন সেসময়ে। সেখানেই ‘কথাসাগর’ ধারাবাহিকে সুযোগ পেলেন প্রতিভা দেখাবার। আরেক নাটক ‘লাল ঘাস ওপর নীলে ঘোড়ে’-তে ভ্লাদিমির লেনিন চরিত্রে অভিনয় করেন। রুশ নাট্যকার মিখাইল শাতরভের ‘Blue Horses on Red Grass’ (১৯৭৯) অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল এটি।
রুশ সাহিত্যনির্ভর কাজে জড়াবার সূত্রেই চলুন জেনে আসি ক্যাম্পাস জীবনের অল্প কড়চা। সুদর্শন, সপ্রতিভ ছিলেন না বলেই হয়তো আর দশজনের মাঝে চোখে পড়তেন না মেধাবী এই তরুণ। কিন্তু অভিনয় নিয়ে পড়তে এসে হেলায় সময় হারাবার প্রবৃত্তিও ছিল না। সহপাঠীরা সবসময় ইরফানের হাতে দেখতে পেতেন একতাড়া স্ক্রিপ্টের কাগজ। বন্ধু কাম প্রেমিকা সুতপা শিকদারের বাড়িতে বন্ধুরা আড্ডা দিতে গেলেও ইরফানের মনোযোগ ছিল বইয়ের তাকে। রাজ্যের রুশ বই তাঁকে টানতো চুম্বকের মতো।
দূরদর্শন যুগের পরেই স্টার প্লাস, সোনির মাতম জাগে টেলিভিশনে। স্টার প্লাসের ‘ডর’ ধারাবাহিকে প্রধান খলচরিত্রে দেখা যায় ইরফানকে। কে কে মেননের বিপরীতে এতে একজন সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
আশির দশকে জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকোভারি অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ভিত্তিতে শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেন মেগা সিরিজ ‘ভারত-এক খোঁজ’। নীল বিদ্রোহের উপর নির্মিত এর ৪৪ তম পর্বে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভূমিকায় অভিনয় করেন ইরফান।
‘চাণক্য’, ‘সারা জাহাঁ হামারা’, ‘বনেগি আপনি বাত’, ‘চন্দ্রকান্তা’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘অনুগুঞ্জ’, ‘অধিকার’,’স্পর্শ’, ‘সফর’, ‘মোহব্বতে’, ‘নয়া দৌড়’, ‘শশশ্ কৌই হে’ ইত্যাদি নাটকে কাজের সুবাদে ছোটপর্দায় পরিচিত মুখ ছিল ভরাট চোখের এই তরুণ।
১৯৯১-৯২ অব্দি ডিডি বাংলার সমাদৃত ধারাবাহিক ‘কাহকাশান’ এ উর্দু কবি মাখদুম মহিউদ্দিনের ভূমিকাতেও মেলে ইরফানের খোঁজ। মার্ক্সিস্ট এবং ‘প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়ন’ এর স্থপতি চরিত্রে স্বভাবজাত সাবলীল অভিনয় করেন তিনি।
১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল অব্দি স্টার প্লাসে প্রচারিত স্টার বেস্টসেলার্স-এর কয়েকটি পর্বে অভিনয় করেন । হানসাল মেহতা, তিগমানশু ঢুলিয়া, ইমতিয়াজ আলী, অনুরাগ কাশ্যপ, শ্রীরাম রাঘবন প্রমুখের পরিচালনায় ৪০-৪৫ মিনিটের ধারাবাহিক ছিল এটি।
তারকায় পরিণত হবেন, স্বপ্নেও ভাবেননি। যেমনটা ভাবেননি কোনদিন হলিউডের মাটিতে পা রাখবেন। নিজের ভাবনা এভাবেই প্রকাশ করেন ইরফান, ‘ফিল্মে নেমেছি নিজের আনন্দে। ভারতীয় ফিল্মে ভালো কিছু করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। হলিউডের চিন্তা মাথাতেই আসেনি। কিন্তু এটাও ঠিক, এই হলিউডি ফিল্মগুলো দেখেই আমরা কাজ শিখেছি।‘
নতুন ধারার সূচনা
নিয়মিত কাজ করে গেলেও বলিউডের বড় কোন প্রজেক্টে ডাক পাননি নব্বইয়ে। টেলিভিশনে কাজ করলেও অর্থের বড় কোন সংস্থান ছিল না। এমনও দিন গেছে যখন ইরফানকে আধা পারিশ্রমিকে ফিরতে হয়েছে ঘরে।
১৯৯৫ সালে দীর্ঘদিনের প্রেমিকা চিত্রনাট্যকার সুতপা শিকদারকে বিয়ে করেন ইরফান। বাবিল ও আয়ান- এই দম্পতির দুই ছেলে। সুতপা হিন্দু হওয়ায় খানিকটা আপত্তির মুখে পড়েন বিয়ের সময়। ওদিকে সেই কিশোর বয়সেই ধর্ম সম্পর্কে বিচিত্র ভাবনা ঠাই নিয়েছিল ইরফানের মনে। সাক্ষাতকারের সূত্রেই বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় নামাজ পড়তে খুব ভালোবাসতাম, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আজানের। একটু বড় হয়ে বিস্তর পড়াশোনা করলাম। মনে হলো, ধর্ম আর ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ককে সবাই সওদাবাজিতে নিয়ে গেছে। আল্লাহকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি, কিন্তু তাঁর সাথে ব্যবসা? সে আমার কম্ম নয়।‘
প্রতিভার সহজাত পরিচয়
পাদপ্রদীপের আলো মেলে ২০০১ সালে আসিফ কাপাডিয়ার ব্রিটিশ- ইন্ডিয়ান ছবি ‘দ্য ওয়ারিয়র’ এর মধ্য দিয়ে। রাজস্থানি যোদ্ধার চরিত্র আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসা পায়। এরপরেই আসে বিশাল ভরদ্বাজের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘মকবুল’। মুখ্য ভূমিকায় ইরফানের অভিনয় বিস্মিত করে দর্শক-সমালোচকদের। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবির জন্য প্রথমে কে কে মেননকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিশাল, ভেবেছিলেন কমল হাসানকে নিয়েও। শেষে নাসিরুদ্দিন শাহের প্রস্তাবেই ইরফানকে নেন। এর আগে অবশ্য ‘হাসিল’ ছবির নেতিবাচক ভূমিকায় নজরে এসেছিলেন।
এর সাথে ‘রোগ’(২০০৫), ‘চকোলেট’(২০০৫), ‘রাজকুমারী’(২০০৫), ‘দুবাই রিটার্ন’(২০০৫), ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ (২০০৭), ’মুম্বাই মেরি জান’ (২০০৮), ’সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার ফির সে’ (২০১৩) , ‘নিউ ইয়র্ক’ (২০০৯), ‘দ্য কিলার’ (২০০৬), ‘কিসসা’ (২০১৪) ছবিগুলো ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ।
ব্যস্ত সময় পার করলেও সন্তুষ্টি মিলছিল না, তাই জয়পুরে ফিরে যাবার কথাও ভেবেছিলেন ইরফান। বন্ধু তিগমানশু ঢুলিয়ার বাধার মুখে ফের কাজ নামেন। তখনই সৃষ্টি হয় আরেক ইতিহাস। ২০১০ সালে অ্যাথলেট থেকে দস্যু বনে যাওয়া পান সিং এর ভূমিকায় ‘পান সিং তোমার’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। অনেকের মতে ইরফানের ক্যারিয়ারে তাঁর প্রতিভার সমতুল্য চরিত্র এটাই। এর কল্যাণে জাতীয় পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
নরসুন্দর হিসেবে ‘বিল্লু’ (২০০৯), নিখিল আদভানির ‘ডি-ডে’ (২০১৩) তে ওয়ালি খান, খুনসুটে রানা চরিত্রে সুজিত সরকারের ‘পিকু’ (২০১৫), সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধে ক্ষ্যাপাটে নির্মল ভূমিকায় ‘মাদারি’ (২০১৬), ঝানু সিবিআই কর্মকর্তা চরিত্রে মেঘনা গুলজারের ‘তালভার’ (২০১৫), বিশাল ভরদ্বাজের ‘হায়দার’ (২০১৪) এ রুহদার চরিত্রে বারবার নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
সাফল্যের সাথেই জীবনের শেষ কয়েক বছর কাটিয়েছেন ইরফান। ২০১৫ সালে ঐশ্বরিয়ার বিপরীতে ‘জাজবা’, ২০১৭ সালে সাবা কামারের সাথে ‘হিন্দি মিডিয়াম’ ও পার্বতী থিরুভোথুর নায়ক হিসেবে ‘কারিব কারিব সিংগেল’এ অভিনয় করে জয় করেন দর্শকের মন।
২০১৮ সালের দুই ছবি ‘কারওয়ান’ এবং ‘ব্ল্যাকমেইল’ বক্স অফিসে ব্যবসা না করলেও এর সচ্ছল গল্প ভালোবাসা আদায় করে নেয় অনেকের। ২০২০ সালেই শেষ হয় তাঁর দীপ্ত ক্যারিয়ার। এই মার্চেই মুক্তি পায় হোমি আদাজানিয়ার পরিচালনায় ‘আংরেজি মিডিয়াম’। রসিক অথচ স্নেহবৎসল পিতার চরিত্রে দর্শককে আবেগে ভাসিয়েছেন এখানেও।
হলিউডেও সমাদৃত তারকা
‘দ্য ওয়ারিয়র’ ছিল আন্তর্জাতিক সিনেমা। ২০০৪ সালে জার্মান পরিচালক ফ্লোরিয়ান গ্যালানবারজার ‘Shadows of Time’ এ কাস্ট করেন এই তুখোড় অভিনেতাকে। তবে সীমানার বাইরে বড় পরিসরে পা রাখেন ২০০৬ এ মীরা নায়ারের ‘দ্য নেমসেক’ এর বরাতে। ঝুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেন ইরফান। বাঙালি বাবু অশোকের চরিত্রের সাথে সহজাতভাবেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি। আটপৌরে জীবনের অভ্যাসই তাঁকে পর্দায় ‘গোগোলে’র বাবা হিসেবে সেঁটেছিল সফলভাবে।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ‘A Mighty Heart’, ওয়েস এন্ডারসনের ‘The Darjeeling Limited’ এ কাজ করেছেন তিনি। এন্ডারসন বরাবরই কাজ করতে চাইতেন ইরফানের সাথে, সেজন্যই স্বপ্রণোদিত হয়ে শুধু ইরফানের জন্যই ছোট চরিত্র লেখেন তিনি। ২০০৮ সালে ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ অস্কারজয় তাণ্ডবের অংশ ছিলেন এই অভিনেতা। ড্যানি বয়েলও ইরফানের সুললিত অভিনয় প্রতিভায় ছিলেন মুগ্ধ। ২০০৯ সালে ‘নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ’ ছবির মীরা নায়ারের অংশে নাটালি পোর্টম্যানের বিপরীতে কাজ করেন। ২০১০ এ অংশ নেন এইচবিওর ড্রামা সিরিজ ‘In Treatment’ এ।
২০১২ সালে হলিউডের আরেক প্রাসাদতুল্য ছবি ‘The Amazing Spiderman’ এ ডাক্তার রজিত রূপে আবির্ভূত হন। তবে আগের সব ইমেজ থেকে বেশি আকর্ষণ করেন অ্যাং লির ‘Life of Pi’ এ যুবক পাই প্যাটেল চরিত্রে।
‘আমার মনে হয়, দিনশেষে সবকিছুই শুন্যের কোলেই ছেড়ে দেয়াই নিয়ম। তবু বিদায় না বলার মুহূর্তটাই আজীবন ব্যথা দেয়।‘
ছবির শেষ অঙ্কের এই সংলাপে ইরফানের অতুল অভিনয় আপ্লুত করে দেয় বিশ্বের কোটি দর্শককে।
‘দ্য লাঞ্চবক্সে’র শান্ত, শীতল সাজানের ভূমিকায় ইরফান স্তম্ভিত করে দেন সকলকে। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল জয়ের পর সেই আগুনে ঘি পড়ে আরও।
২০১৫ তে ঘটে আরেক দৈব। ২২ বছর আগে মুক্তি পাওয়া যেই ‘Jurassic Park’ ছবির টিকিট ব্ল্যাকে কিনে দেখেছিলেন, তারই কিস্তি ‘Jurassic World’ এ সুযোগ পেয়ে যান অভিনয়ের। ২০১৬ সালে ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের ‘Inferno’ য় টম হ্যাংকসের সাথে কাজ করেন। হ্যাংকসের চোখে তখন থেকেই ইরফান ‘কুল গাই’!
‘The Puzzle’ (২০১৮) ছিল ইরফানের সর্বশেষ হলিউডি সিনেমা। কালজয়ী পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গের সাথে কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাখান করেছিলেন ইরফান। ‘Robocalypse’ এ স্কারলেট জোহানসেনের সাথে স্ক্রিন ভাগাভাগি প্রস্তাব পেলেও অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জেনেই সরে এসেছিলেন তিনি। এমনকি ম্যাট ড্যামনের সাথেও রসায়ন তৈরি হতে পারতো ‘দ্য মারশিয়ানে’, সুজিত সরকারের ‘পিকু’র স্বার্থে এটি ছেড়ে দেন তখন।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘ইন্টারস্টেলার’ অনন্য এক নাম। ইরফানের সাফল্যের ঝুলিতে থাকতে পারতো এটিও। কিন্তু এর জন্য টানা চার মাস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা ছিল বাধ্যতামূলক। ওদিকে রিতেশ বাত্রাকে আগেই শিডিউল দিয়ে রেখেছিলেন। ‘ইন্টারস্টেলার’ আর ‘দ্য লাঞ্চবক্সে’র ভেতর অবশেষে বেছে নিয়েছিলেন সাজান ফারনান্দেজকেই।
ক্রিস্টোফার নোলানকে ফিরিয়ে দেয়ায় আফসোস ছিল না বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তটি বেশ কঠিনই ছিল। রিডলি স্কটের ‘বডি অফ লাইস’ এ রাসেল ক্রো এবং লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর সাথে পাল্লা দিয়েই অভিনয়ের কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত বনিবনা হয়নি আর।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রেও পা রেখেছেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘ডুব’(২০১৭) এর মাধ্যমে।
৩৫ বছরের কর্মমুখর জীবনে ৫০টির বেশি দেশীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য গুণগ্রাহীর হৃদয় জয়ের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার-সহ অগণিত পুরস্কার অর্জন করেছেন।
২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতেও ভূষিত করে।
মায়ের কোলে ফেরা
‘ভীষণ দুবলা পাতলা ছিলাম, দেখতেও আহামরি কিছু না। কেউ বিশ্বাসই করতো না আমি অভিনেতা হতে পারি। কিন্তু আমার জেদটা ছিল তীব্র।‘
মা চাইতেন ছোটখাটো কাজের মধ্যেই ছেলে ডুবে থাকুক, অভিনয়ে সায় ছিল না তাঁর। নাখোশ ছিলেন মুম্বাই শহরের প্রতি, ভাবতেন এই শহরই কেড়ে নেবে সন্তানকে। মাতৃভক্ত ইরফানকে ছেড়ে সেই মা অনন্তলোকে পাড়ি জমান ২৫ এপ্রিল। লকডাউনের কারণে মাকে শেষ বিদায় জানাতে পারেননি তিনি।
মায়ের তীব্র অনুরাগী ইরফান মৃত্যুর পূর্বে ডেকেছেন সেই রত্নগর্ভাকেই। আধো বোলে তাঁর শেষ বাক্য ছিল, ‘আম্মা আমাকে নিতে এসেছে।‘
জীবনের হিসেব মেলাবার তাগাদা এসেছিল ২০১৮ সালের মার্চে। নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার ধরা পড়ে তাঁর। এই মারণ রোগের সঙ্গে সংগ্রামে ব্যস্ত হতে হয় সদা উৎসুক এই ব্যক্তিত্বকে। সর্বক্ষণের সাথী ছিলেন স্ত্রী সুতপা।
লন্ডনেও হয়েছিল চিকিৎসা। তখন ইরফান বলেছিলেন ‘সুতপাই আমার জোর। সবসময় আমার পাশে ছিল ও। আজ আমি যে অবস্থায় আছি, মনোবল ফিরে পেয়েছি, যেটুকু সুস্থ—-সবটায় ওঁর অবদান। ওর জন্যই এখন বাঁচতে চাই।’
মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও প্রবল মেধাবী এই অভিনেতার কর্মের প্রভাব রয়ে যাবে কোটি ভক্তের হৃদয়ে, চিরকাল।
লেখক- সারাহ তামান্না