আমেরিকা-কিউবার সরল গরল সম্পর্ক1 min read
Reading Time: 5 minutesরাজনৈতিক ক্ষমতায় পরম বলে কিছু নেই। কখন কার হাতে ক্ষমতা ধরা দেয় কিছুই অনুমান করা যায় না। তেমনি নিশ্চিত করে বলা যায় না রাজনীতির মাঠে কে কার শত্রু, কে কার মিত্র। সবাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি নিয়ে এ মাঠে খেলতে নামে। কিউবা-আমেরিকার বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটে নি। আমেরিকার কোলের উপর ছোট্ট এক রত্তি দেশ কিউবা। কিন্তু প্রায় ১০০ বছর ধরে তাদের মাঝে বিরাজ করছে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। তাদের এই সম্পর্ক সুমধুর করার জন্য অনেকবার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু কতটা সফল সে চেষ্টা তারই কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে উল্লেখ করা হলো।
আমেরিকা কিউবার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা দুই দেশের মধ্যে বিগত কয়েক যুগ ধরে চলা বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করবে। কিন্তু কেন এই সম্পর্কের চুক্তি, আর সেটি করতে কেন এতটা সময় লেগে গেল তা বুঝার জন্য আমাদেরকে দেড়শো বছর পূর্বে ফিরে তাকাতে হবে যেখানে এই বৈরিতার সূত্রপাত।
গল্পটার শুরু ১৮৫০ এর দশকে যখন আমেরিকা প্রো-দাসত্ব ও আ্যন্টি-দাসত্ব রাজনীতিতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিউবা সেই সময় স্পেনের দখলে। আমেরিকা কিউবাকে স্পেনের আধিপত্য থেকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে তাদের দাস রাষ্ট্র বানাতে চাইল। অন্যদিকে দাসপ্রথার বিরোধী রাজনীতিবিদরা এটার বিরোধিতা করে এবং কিউবাকে এক সাম্রাজ্যবাদ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।
অবশেষে ১৮৯৮ সালে কিউবানরা যখন দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল এবং স্পেনিশদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হলো তখন আমেরিকা আবার বেঁকে বসে। তারা ভিন্ন ধরণের যুক্তি উপস্থাপন করে। মার্কিন নেতারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে, তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়। তারা কি কিউবাকে স্পেনের নিকট হতে মুক্ত করে নিজেদের দখলে নিবে? নাকি স্বাধীনভাবে এগুতে দিবে। আবার কখনো ভাবে, তারা কি কিউবাকে সাম্রাজ্যবাদ ক্ষমতা প্রদর্শন করবে? যাই হোক, এটাই ছিল কিউবাকে নিয়ে আমেরিকার নতুন ভাবনা। তারা নিজেদের কি ধরণের রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করবে, কিউবাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে নাকি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেবে।
ঠিক সেই সময়টায় অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রীতিমতো যুদ্ধ বয়ে গেল। দুপক্ষই নিজেদের আইন পাশের জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে কিউবা আংশিক স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু গুয়ানতানামো উপসাগর মার্কিনদের দখলেই থাকে। কিউবার বৈদেশিক নীতিতেও মার্কিনরা হস্তক্ষেপ করতে থাকে।
১৯০৬ ও ১৯১৭ সালে কিউবার রাজনীতিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। তারা জনসমক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয় বটে, তবে বাস্তবে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় জোরারোপ করে। যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ হলো কিউবা থেকে চিনি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া। কেননা চিনি কিউবার প্রধান রপ্তানীযোগ্য পণ্য। আমেরিকা-কিউবার এ চরম বৈরিতার উৎস হলো স্নায়ু যুদ্ধ। কিউবানরা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে চায় আর মার্কিনরা তাতে জল ঢেলে দেয়। অবশেষে ১৯৩৩ সালে কিউবানরা মার্কিন মদদপুষ্ট কিউবা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার হহস্তক্ষেপ করার কথা ছিল কিন্তু তারা নিরব থাকে। কারণ ততকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট আমেরিকায় সামরাজ্যবাদের অবসান চান।
এর পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত কিউবা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি হয়। কিউবার সামরিক নেতা ফুলজেনসিও বাতিস্তা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করে এবং চলমান সংবিধান পরিবর্তন করে নানা ধরণের অসাংবিধানিক কার্যক্রম চালাতে থাকে। স্বৈরশাসক বাতিস্তার অত্যাচার বেশিদিন টিকে নি। পরের বছর থেকেই কিউবায় কমিউনিস্টরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। আর এর নেতৃত্ব দেন কিউবার তরুণ বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। যুক্তরাষ্ট্র তখন কিউবায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে এবং যে কোন মূল্যে আবার বাতিস্তাকে কিউবার গদিতে ফিরে পেতে চায়। শুরু হয় তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ এক স্নায়ু যুদ্ধ।
১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রো পাকাপাকিভাবে কিউবার নেতৃত্বের ভার কাঁধে তুলে নেন। ফিদেল কাস্ত্রো এমন একজন সাহসী বীর যে তাঁর জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তাঁর দেশ কিউবায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এবং সেটা তিনি করেও দেখিয়েছেন। কিউবাকে সম্পূর্ণরূপে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র তৈরি করার মাধ্যমে ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত করেন। ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কাস্ত্রোও নির্ভীক ছিলেন। তিনি তাঁর মার্কিন বিরোধী মনোভাব অব্যাহত রাখেন। তিনি ১৯৬০ সালে কিউবায় মার্কিন মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করেন। এর জের ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার পারস্পরিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এবং ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাসে এ দুই দেশের সমস্ত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ঐ বছরের এপ্রিল মাসে কিউবার পিগস উপসাগরে সিআইএ এর তদারকিতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কিউবার বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান চালায়। কিউবার উপর মার্কিননীতি কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। ১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে। ফলে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র প্রজেক্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মার্কিন সিনেটের এক তদন্তে বলা হয়, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে আটবার ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। বুটালিনাম নামক এক ধরণের মারাত্মক বায়োলজিক্যাল টক্সিন কাস্ত্রোর সিগারে ভরে দেওয়া হয়। আবার বলপয়েন্ট কলমে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ লুকিয়েও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপরও ফিদেল কাস্ত্রোকে ক্ষান্ত করতে পারে নি। তিনি তার ক্ষমতাকে শাণিত করবার জন্য গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন।
কিউবা নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের অনুমতি দেয়। ১৯৬২ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত রাশিয়া কিউবার ভূখণ্ডে মিসাইল স্থাপন করে। যেখানে স্থাপন করা হয় সেখান থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জনগন ও সরকার তাই আতঙ্কিত হিয়ে যায় এবং যত দ্রুত সম্ভব এটাকে সরানোর৷ আহবান জানান। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইল সরানোর কোন পদক্ষেপ নিল না। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবাকে মার্কিন নৌবাহিনী দিয়ে বেষ্টন করার নির্দেশ দেন। যাতে কিউবা বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া এই দুই পরাশক্তির মধ্যে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয় এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হয়। অবশেষে সোভিয়েত নেতা ক্রোশ্চেভ নতি স্বীকার করেন এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করেন। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়ার নিকটবর্তী তুরস্ক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নেয়। ইতিহাসে চরম উত্তেজনাপূর্ণ এ ঘটনা মিসাইল সংকট নামে পরিচিত।
১৯৭৭ সালে জিমি কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কিউবায় আরও কঠিন ব্যবস্থা চালু করেন। কিউবার রাজধানী হাভানায় অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্র ইন্টারেস্ট সেকশন চালু করে। কিউবার কিছু জনগণকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করে। ১৯৮০ সাল নাগাদ কিউবার প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। এদিকে ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর কিউবা ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। তারা আর কিউবার চিনি আমদানি করতে সমর্থ ছিল না। এত কিছুর পরও কিউবা কিঞ্চিৎ দমে নি পর্যন্ত। সাগরবেষ্টিত দেশ কিউবা তখন মনোনিবেশ করল পর্যটনশিল্পে। তারা সমুদ্রসৈকতে বেশকিছু স্থাপনা তৈরি করল। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এতে আগ্রহ দেখালেও যুক্তরাষ্ট্র একদমই তা করল না। বরং মার্কিন পর্যটকদের কিউবায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। শুধমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কারণে কিউবা পর্যটনশিল্প বেশিদূর এগুতে পারে নি।
অবশেষে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৬ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে ফিদেল কাস্ত্রো নিজের ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাউল কাস্ত্রো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কিছুটা নমনীয় হন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাও বারাক ওবামার হাতে আসে। তিনিও কিউবার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলান।
সময়ের বদৌলতে ধীরে ধীরে কিউবা-আমেরিকা সম্পর্ক নতুনরূপে অগ্রসর হয়। কয়েকবছর ধরে আলোচনা করে দুই দেশের মধ্যে বরফ গলতে শুরু করে। ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর বারাক ওবামা ও রাউল কাস্ত্রো দুজনে একসাথে ঘোষণা করেন যে, দুই দেশে পূর্ণ কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে। দু দেশের সম্পর্ক যখন স্বাভাবিক হওয়ার পথে তখনই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা চলে যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে কিউবা বিষয়ক নীতিতে পরিবর্তন আনেন। ওবামার আমলের কিছু ইস্যু যেমন দুই দেশে দূতাবাস স্থাপন করার সমর্থন করেন। আবার কোন ইস্যু বাতিল করেন। অর্থ ও বানিজ্য চুক্তিতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আনয়ন করেন।
২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল কিউবার ততকালীন প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রোর কাছ ক্ষমতা গ্রহণ করেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল। তিনি বলেন তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সভ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। তিনি কিউবার উপর আনিত যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অবসান চান। তাবৎ দুনিয়াও তাকিয়ে আছে কবে স্থায়ী সমাধানে আসবে এ দুই রাষ্ট্র।