আমাজন: রহস্যে ঘেরা এক ঘন অরণ্য1 min read
Reading Time: 3 minutesপৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত আমাজন; যা কি না বিশ্বের বৃহত্তম বনভূমি। দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ অঞ্চল জুড়েই রয়েছে এই ঘন অরণ্য। এই অরণ্যের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা, পশুপাখি ও কিছু মানুষের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম আমাজন নদী। নদী ও বনাঞ্চলসহ সম্পূর্ণ এলাকাটি আমাজন বেসিন হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। বৃহৎ ঘন বনভূমি বা রেইনফরেস্ট হওয়ার কারণে আমাজন নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। এই লেখাটির মাধ্যমে আমাজন বনভূমি নিয়ে নানাবিধ তথ্য, ইতিহাস ও পরিচিতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
নামকরণ ও অবস্থান
আমাজন নামটি স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রান্সেসকো দ্য ওরেলানার দেওয়া। ধারণা করা হয় এক যুদ্ধের পটভূমি থেকে আমাজন শব্দটি এসেছে। একটি সময়ে “ফ্রান্সেস্কো দে ওরেলানা” গোষ্ঠীর সঙ্গে “তাপুয়াস” ও কয়েকটি আদিবাসী গোত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করেছিল, এই কারণে ওরেলানা গোত্রের লোকজন গ্রীক পুরাণের “অ্যামাজোনাস” থেকে এই যুদ্ধের নামকরণ করেছিল অ্যামাজোনাস। এই যুদ্ধের নাম ও পটভূমি থেকেই এই বনাঞ্চল ও নদীর নামও আমাজন হয়ে যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০% অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এই বনভূমি; যার আয়তন প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। আর দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশজুড়ে অ্যামাজন রেইনফরেস্ট বিস্তৃতি লাভ করেছে। দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলে রয়েছে ৬০শতাংশ, পেরুতে ১৩শতাংশ, কলম্বিয়াতে ১০শতাংশ, আর বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, গায়না, সুরিনাম ও ফ্রেন্স গায়নায় বাকি ১৭শতাংশ বনভূমি অবস্থিত।
জীববৈচিত্র্য
আমাজন বনভূমি বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতে ভরপুর। প্রচুর পরিমাণে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের দেখা মেলে এই বনাঞ্চলে। এখানে যেমন রয়েছে উপকারী বিভিন্ন প্রাণী ও পোকামাকড়, তেমনি রয়েছে অত্যন্ত বিপদজনক প্রাণীরও। এসব প্রাণী এবং উদ্ভিদদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রায়ই পরিচালনা করা হয়। এসব গবেষণার মধ্য দিয়েই এখানে কি পরিমাণে ও কতো প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে তার সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করা হয়। পরিসংখ্যানগত তথ্য থেকে জানা যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম এই আমাজন রেইনফরেস্ট প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতির গাছ, ৪০ হাজার জাতের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ এবং প্রায় ২ হাজার ধরনের পাখি, ২.৫ মিলিয়ন শ্রেণির কীটপতঙ্গ, প্রায় ৪২৭ জাতের স্তন্যপায়ী, প্রায় ২২০০ জাতের মাছ, ৪২৭ শ্রেনির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১,২৮,৮৪৩টি অমেরুদন্ডী প্রজাতি, ৩৭৮ প্রজাতের সরীসৃপ প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। ইলেকট্রিক ঈল, মাংসখেকো পিরানহা, বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগ, ম্যাকাও, তাপির, গোলাপি ডলফিন, পিরারুক বা পাইচে বা আরাপাইমা মাছ ইত্যাদি এসব প্রাণীর দেখা মেলে এই আমাজন রেইনফরেস্টে।
মানুষের অস্তিত্ব
মারাত্মক ও বিষাক্ত বিভিন্ন পোকামাকড় ও পশুপাখির আখড়া থাকা সত্ত্বেও এই আমাজন বনে রয়েছে বেশকিছু জনগোষ্ঠীর বসবাস। প্রাচীনকাল থেকেই আমাজন বনের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এখানে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। সময়ের পরিক্রমায় কিছু-কিছু আদিবাসী গোত্র আধুনিক ও পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবে তারপরেও প্রায় ৫০টি জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এসব জনগোষ্ঠীর লোকেরা কৃষিকাজ, শিকার, পশুপালন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
বিস্ময় ও রহস্যাবৃত আমাজন
এই রেইনফরেস্টকে ঘিরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের আশ্চর্যময় রহস্য আমাদের সামনে উঠে আসছে। তবে এসব রহস্যের মধ্যে অধিকাংশেরই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন: আমাজন বনের ব্রাজিল অংশে বৃত্তাকার বেশকিছু নকশা দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, এগুলো সমাধিক্ষেত্র; আবার কেউ কেউ বলেন, কোনো সুরক্ষা ক্ষেত্র। তবে এটির আসল রহস্য কি তা সকলের কাছেই অজানা। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, এই বনে নাকি এলডোরাডো নামক একটিং গুপ্ত শহর বিদ্যমান আছে; যা কিনা পুরোটাই স্বর্ণ দিয়ে নির্মিত। কিন্তু এই কাল্পনিক শহরের কোন অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
আমাজন বনকে রেইনফরেস্ট হিসেবে অভিহিত করা হলেও, এখানে যে সব সময় বৃষ্টি হয় এমন ধারণা কিন্তু মোটেও সঠিক নয়। বরং এখানকার অত্যাধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত এবং গরম ও উষ্ণ আবহাওয়ার কারণেই এটিকে রেইনফরেস্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ঘন বনাঞ্চলের একটি অংশে গবেষকরা কালো মাটির সন্ধান পেয়েছেন। অনেকে ধারণা করেন, এই মাটির উপরে কোনো এক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই কালো মাটিকে টেরা মাটি হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
এই আমাজন বনাঞ্চলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম আমাজন নদী; যা একটি সময় প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হতো, কিন্তু বর্তমানে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। তবে এটি মূলত ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সংঘটিত হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে অক্সিজেন। আর পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ২০শতাংশই আসে এই আমাজন ঘন অরণ্য থেকে।
বিভিন্ন রহস্য ও বিস্ময়কর বিষয়ের সংমিশ্রণে আমাজন হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তু। তবে বিভিন্ন কারণে বর্তমান সময়ে আমাজন বনাঞ্চল বিরূপ পরিস্থিতি ও নানাবিধ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আমাজন বনাঞ্চলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। যদি কোনো কারণে আমাজন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, তবে পৃথিবীও অস্তিত্বহীনতার দিকে অগ্রসর হবে।