বাগদাদির মৃত্যু ও আইএস-এর ভবিষ্যৎ1 min read
Reading Time: 3 minutesএকবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের অন্যতম আলোচিত একটি নাম ইসলামিক স্টেট বা আইএস(IS)। সেই সাথে ইসলামিক স্টেটের প্রধান হিসেবে বিশ্বজুড়ে ঝড় তোলেন আবু বকর আল-বাগদাদি। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার বাগদাদির মৃত্যুর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলো গুজবে পরিণত হয়েছে। তবে এবার আর গুজব নয়, এবার সত্যে পরিণত হয়েছে আবু বকর আল-বাগদাদির মৃত্যুর সংবাদ। গত ২৬ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইটের মাধ্যমে এমন বার্তাই প্রদান করেন। আর ইসলামিক স্টেটও বাগদাদীর মৃত্যুর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।
তবে বাগদাদীর মৃত্যুর পর আইএস থেমে নেই। ইতিমধ্যেই ইসলামিক স্টেটের নতুন প্রধান হিসেবে আবু ইব্রাহিম আল হাশেমী আল কুরাইশের নাম শোনা যাচ্ছে। বাগদাদির মৃত্যুর পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন দুর্ধর্ষ এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান? বাগদাদীর মৃত্যু আইএস-এর ভবিষ্যৎকে কোন দিকে ঠেলে দিতে পারে? আজকে এমনসব উৎকণ্ঠারই উত্তর জানানোর চেষ্টা করবো এই লেখাটির মাধ্যমে।
আইএস–এর প্রধান আবু বকর আল বাগদাদি ইরাকের এক ছোট নগরী সামারায় ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বাল্যকালে তার নাম ছিল ইব্রাহিম আল বদরি। অত্যন্ত ধার্মিক পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে বাল্যকাল থেকেই বাগদাদী কোরআন-হাদিস ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকেন। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিসের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন আবু বকর আল বাগদাদি। তারপর স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন।
তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া না গেলেও যতটুকু জানা যায় তাতে উঠে আসে, বাগদাদি বাগদাদ শহরে মসজিদে শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং ধর্মীয় চর্চা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। বিভিন্ন ফুটবল দলে তিনি রীতিমতো নামকরা ফুটবলার হিসেবে পরিচিতিও লাভ করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বাগদাদি তার কাকার মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন। তারপর ২০০০ সালের দিকে সালাফী জিহাদিদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আবু বকর আল বাগদাদি ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকে যখন মার্কিন বাহিনী অভিযান পরিচালনা শুরু করে তখন থেকে পুরোপুরি জঙ্গী হয়ে ওঠেন তিনি। এরমধ্যে ২০০৪ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। সেসময় ১০ মাস বুক্কা ক্যাম্পে বন্দি হিসেবে কাটাতে হয় তাকে।
ঘটনাচক্রে একসময় আল কায়দার সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি হয় বাগদাদির। আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালে অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারে নিহত হলে আল-কায়েদার শক্তি কমতে থাকে এবং ইরাক ও সিরিয়া থেকে আল কায়দা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ঠিক সেসময় থেকেই ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। বাগদাদি একটা সময় পর্যন্ত আল কায়েদার হয়েই কাজ করতেন। কিন্তু নফুরা নামক এক জঙ্গিগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে ঘিরে বাগদাদির সঙ্গে আল-কায়েদার মতের অমিল হলে আল-কায়দা বাগদাদিকে বের করে দেয়।
বাগদাদি আল কায়দা থেকে বেরিয়ে এসে ২০১৩ সালে নিজেকে খলিফা হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইসলামিক স্টেটের নামে ইরাক ও সিরিয়াতে তুমুল প্রচারাভিযান শুরু করেন। এরপরই বিভিন্ন জঙ্গি হামলার দায়ভার স্বীকার করে নেওয়াকে কেন্দ্র করে খুব দ্রুত আইএস নামটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। একই সাথে আইএস–এর প্রধান হিসেবে আবু বকর আল–বাগদাদির নামও ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
জঙ্গি দমনের লক্ষ্যে পরিচালিত মার্কিন বাহিনীর অভিযানের ফলে আইএস প্রধান বাগদাদি যতটা শক্তি নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছিল না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদিকে ধরিয়ে দিতে পারলে বিশাল অঙ্কের পুরস্কারও ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পরা বাগদাদি ২৬শে অক্টোবর রাতে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে মার্কিন বাহিনীর অভিযানের মুখে আত্মঘাতী পথ বেছে নেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর রব খান মনে করেন, আল–কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার ফলে আল-কায়দা যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে, তেমনি আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদি নিহত হওয়ার ফলে আইএস-ও দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি আরো বলেন, বাগদাদির মৃত্যুর ফলে বাংলাদেশ যদি আইএস ভাবাপুষ্ট বা বিশ্বাসী কোনো মানুষ থেকেও থাকে তবে তারাও ক্রমশ দুর্বল হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অপরদিকে লীনা খাতিব যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক, তিনি বলেন আবুব আল-বাগদাদির মৃত্যুর মাধ্যমে আইএসের অস্তিত্ব ধ্বংস বা পতন কিছুই হবে না। আইএসের অস্তিত্ব নির্ভর করবে সিরিয়ার স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর।
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন আবু বকর আল বাগদাদি শুধুমাত্র খলিফার একটি চরিত্র হিসেবে ছিলেন, তার মৃত্যুতে আইএস শক্তিহীন হয়ে পড়বে এমনটি ভাবা বোকামি বরং আইএস তাদের শীর্ষ নেতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।