ইতিহাস

হিরোশিমা-নাগাসাকি ও আমেরিকার ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ1 min read

মার্চ ২২, ২০১৯ 4 min read

author:

হিরোশিমা-নাগাসাকি ও আমেরিকার ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ1 min read

Reading Time: 4 minutes

এ বছর আগস্টে ৭৪ বছরে পদার্পণ করবে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে কদর্য ও ভয়াবহ হামলা, জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আমেরিকার পারমাণবিক হামলা। এই হামলা শুধু শহর দুটিকে নিশ্চিহ্নই করেনি, সেই সাথে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে সারাজীবনের জন্য শারীরিক মানসিক ভাবে পঙ্গু করে ফেলেছিল

পেছন ফিরে দেখা

১৯৪৫- এর বসন্ত, তখনও যুদ্ধ চলছে ইউরোপ চূড়ান্ত ধ্বংস থেকে বাঁচলেও জাপানীজ আর আমেরিকানদের মধ্যকার যুদ্ধ তখনও থামেনি জাপানের আকাশে আমেরিকা রাজত্ব করলেও জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পণ করতে নারাজ ছিলেন

ইউএস সেনাদের জীবন বাঁচাতে একটি গোপন অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছিল সেটি ছিল পারমাণবিক বোমা জার্মান অভিবাসী হ্যান্স বেথও এই ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টে কাজ করছিলেন, যেন হিটলার এই অস্ত্র আগে হাতে না পেয়ে যায়হ্যান্স জানতেন এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি অস্ত্র  এবং এই অস্ত্র অগণিত মানুষ মারতে সক্ষম তিনি ভেবেছিলেন যদি জার্মানরা আগেই এই অস্ত্র হাতে পেয়ে যায় তাহলে তারা পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে কিন্ত তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন ধ্বংসই এই অস্ত্রের কাজ তা জার্মানদের হাতে থাক বা আমেরিকানদের

প্রায় ২০০০০ লোক কাজ করছিল এই অস্ত্র তৈরিতে ১৬ জুন, ‘ট্রিনিটি’ নামের পরীক্ষামূলক অস্ত্র  নিউ মেক্সিকোতে পরীক্ষা করা হয়।  হ্যান্স বেথের ভাষায় প্রদীপ থেকে জিনি বেরিয়ে পড়েছিল

Image Source: bbnnews.com

হিরোশিমার দুঃস্বপ্ন

আগস্ট, ১৯৪৫ প্রথম পারমাণবিক বোমা লিটল বয় আকাশ পথে বেরিয়ে পড়েছে বি-২৯ ইনোলা গে এটিকে নিয়ে জাপানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল বিমানের ক্রুরা মনে করেছিল সেদিনই তারা যুদ্ধ শেষ করে দেবেকিন্ত তাদের লিটল বয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না

হিরোসিমা, সকাল টা জাপানের ৭ম বৃহত্তর শহর এখন পর্যন্ত যুদ্ধ এই শহরে তার থাবা ফেলতে পারেনি কিন্ত ইনোলা গে হিরোশিমার আকাশে পৌঁছালে হিরোশিমার মাটিতে থাকা সাধারণ মানুষদের দুঃস্বপ্নটা শুরু হয়ে গেল সেই বিভীষিকা বর্ণনায় বোঝানোর মত নয় হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার ফলে সৃষ্ট আগুনের গোলক যেটি ব্যাঙয়ের ছাতার মত ছিল, তার উচ্চতা ছিল ৩০ কিলোমিটার। যেন ১৫,০০০ টন বিস্ফোরক একসাথে ফুটেছে এর প্রভাব এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ইনোলা গের একজন কর্মী তার ডাইরিতে লিখেছিলেন, “হে ঈশ্বর!   আমরা কি করেছি!”

পুরো হিরোশিমা মুহুর্তের মধ্যে ধ্বংস হিয়ে গিয়েছিল, শুধু কিছু এলাকা বাদে। কিন্ত সেই সব এলাকার মানুষজনও  ভয়াবহ ভাবে আহত হয়েছিল। একজন ভুক্তভোগী তার জবানবন্দিতে জানান, “ যখন আমি আমার বাসা থেকে বের হলাম, আমি দেখি একজন মা ছোট গাড়িতে করে বাচ্চাকে নিয়ে আসছিলেন দূর থেকে তাদের স্বাভাবিক মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখি তার (মা) শরীরে কোন কাপড় নাই, আগুনের তাপে চামড়াও নেই বেশিরভাগ স্থানে আর বাচ্চাটার গালের মধ্যে এক টুকরা কাঠ ঢুকে ছিল কিন্তু বাচ্চাটা মোটেই কাঁদছিল না”।

নাগাসাকির দুর্ভাগ্য

তিন দিন আগেই হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছেআমেরিকা আশা করছিল জাপান আআত্মসমর্পণ করে ফেলবে কিন্ত জাপান আত্মসমর্পণ না করায় আবার হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয় সকাল ১১.০২ মিনিটে ২৮,৯২০ ফুট উঁচু থেকে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যানকে নাগাসাকিতে ফেলে দেয়া হয় বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে প্লেন তাড়াতাড়ি সরে গিয়েছিল ২২,০০০ টন টিএনটি এর সমপরিমাণ শক্তিসম্পন্ন বোমা থেকে নির্গত ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপে  আর ১০০০ কিমি/ঘণ্টা এর চেয়ে বেশি দ্রুত বাতাসে পুরো শহর কর্পুরের মত উড়ে গিয়েছিল।

সাকুই শিমোহিরা, যিনি তখন কিশোরী ছিলেন, মায়ের আদেশে মাটির নিচে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিন্ত সেই বিস্ফোরণ এতটাই প্রবল ছিল যে বাংকারে তার সাথীরাও এর প্রভাব থেকে বাঁচতে পারে নি বোমার আঘাতে জ্ঞান হারানো সাকুই জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান তার সাথীদের একজনের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছিল

নাগাসাকি আর তার তিন দিন আগে আক্রান্ত হিরোসিমায় পারমাণবিক হামলায় মুহুর্তের মধ্যে লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলআহত হয়েছিল তার কয়েকগুন বেশি কিন্ত পারমাণবিক বোমার রেডিয়েশনে পরবর্তীতে আরো লাখো মানুষ মারা গিয়েছিল নাগাসাকির হামলার দিন পর জাপান আত্মসমর্পণ করেসেদিনই ইউএস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রেস কনফারেন্সে জানান জাপান বিনাশর্তে হার মেনেছে। 

শেষ হয়েও যার শেষ হল না

যুদ্ধ শেষের পর যেন নতুন যুদ্ধ শুরু হলএই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল হাসপাতালেবোমা হামলার দিন পর থেকে রহস্যময় একটা অসুস্থতা ছড়াতে শুরু করলআহত ব্যাক্তিদের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল নাশরীরে বাদামি গোটা গোটা দাগ সাথে বমিফলাফল মৃত্যুসবখানে ছড়িয়ে পড়ছিল এই সমস্যাএটা ছিল নেক্রোসিসতাদের শরীরে শ্বেত রক্তকণিকা ছিল নাফলে শরীর ইনফেকশন এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারছিল নাফলে পচন শুরু হয়ে গিয়েছিলহঠাৎ চুল পড়তে শুরু করেছিলমাথায় হাত দিলেই গোছা গোছা চুল উঠে আসতপরে জানা গেল যারা হাইপারসেন্টারের কাছাকাছি ছিল অথবা যারা রেডিওএকটিভ পদার্থ গিলে ফেলেছিল তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলপরবর্তীতে রেডিয়েশন এর ভয়াবহতাই যেন পারমাণবিক বোমার সবচেয়ে বড় আঘাতে পরিণত হয়েছিল, মৃত্যুর চেয়েও বড়

পারমাণবিক বার্তা

যুদ্ধ শেষ পুরো পৃথিবীকে জানানো হল আমেরিকান সৈন্যদের বাঁচাতেই হিরশিমা আর নাগাসাকিতে বোমা হামলা করা হয়েছিল কিন্ত আদৌ কি তাই? এই যুদ্ধে প্রায় ২০ লাখ জাপানী সৈন্যসাধারণ নাগরিক এবং লাখের মত আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছিল

জাপানে আমেরিকার হামলা নিয়ে আজকের দিনে দুইধরণের মতামত পাওয়া যায়হিরোশিমা আর নাগাসাকি হামলার ৭০ বছরে অনেক বই, সিনেমা এবং তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছেএই বোমাহামলার পক্ষে এবং বিপক্ষেকিন্ত কিছু গোপন নথিপত্র প্রকাশ করা হয় যাতে এই ধারণাই মূর্ত হয় যে জাপান বোমা হামলা যতটা না প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল একটি বার্তা, সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য

আমেরিকান ইউনিভার্সিটির পারমাণবিক বিদ্যার পরিচালক পিটার কুজনিক এর মতে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সেসময় এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছিলেন প্রথমত, বিনা শর্তে জাপানের আত্মসমর্পণদ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি পরিষ্কার বার্তা পাঠানো

ফিনিক্স পাখির জেগে ওঠা

পারমাণবিক বোমা হামলার পাঁচ দিনের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় যায় জাপানের শহর দুটি পুরোপুরি অচল হয়ে যায়, কিন্তু ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ আর অন্যান্য ব্যবস্থা আগের মত করার চেষ্টা করা হয়  মানুষজন যে কোন অর্ধপোড়া বা না পুড়ে যাওয়া জিনিস ফেলে না দিয়ে কাজে লাগানো শুরু করে হামলার পর গুজব রটেছিল যে ৭৫ বছর জাপানের মাটিতে কিছু জন্ম নেবে না কিন্ত রেড কানা ফুল যখন প্রথম ফুটেছিল তা পরিণত হয়েছিল জাপানের মানুষের প্রাণশক্তির প্রতীক। 

লেখক- Labiba Farzana

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *