হুট করেই আটলান্টায় বেড়ে গেল নিখোঁজ শিশুর মিছিল। প্রতি বছরই বেশ কিছু শিশু পালিয়ে যায় বা মাদক ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় জড়িত হয় অবৈধ কাজে। তাই প্রথম দিকে খুব একটা আমলে নেয়নি পুলিশ। ক্রমে নিখোঁজ শিশুদের লাশ মিলতে থাকলো শহরের বিভিন্ন স্থানে। এবার নড়েচড়ে বসলো তারা, সাথে এফবিআই। শেষ পর্যন্ত ২৮ খুনের মূল হোতাকে খুঁজে বের করে আইন রক্ষাকারী বাহিনী।
১৯৭৯–৮১ সালে ঘটে যাওয়া ‘আটলান্টা মনস্টার’-এর কেস সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল এফবিআইয়ের দুই এজেন্ট– জন ই ডগলাস এবং রবার্ট কে রেসলার। শুধুমাত্র এই কেসই নয়, আরও বহু হত্যাকাণ্ডের সমাধানও এসেছে এই দুই কর্মকর্তার হাত ধরে। তবে তাঁদের সবচেয়ে বড় অবদান ‘ সিরিয়াল কিলার বা ক্রমিক খুনিদের মনস্তত্ত্ব ও আচরণ বিদ্যা’র গবেষণায়। এডমন্ড কেম্পার, চার্লস মেনসনসহ ডজনখানেক ক্রমিক খুনির সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষণার ফল নিয়েই ১৯৯৫ সালে ডগলাস এবং মার্ক ওলশেকার প্রকাশ করেন ‘Mindhunter: Inside the FBI’s Elite Serial Crime Unit ‘। এই নন–ফিকশনের উপর ভিত্তি করেই নেটফ্লিক্সের সাড়া জাগানো সিরিজ ‘Mindhunter’.
সিরিজে ডগলাসের( হোল্ডেন ফোর্ড) চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোনাথন গ্রফ এবং রেসলার(বিল টেঞ্চ) হিসেবে রূপদান করেছেন হল্ট ম্যাককেলনি। দুই সিজনে সত্তর ও আশির দশকের বেশ কয়েকজন সিরিয়াল কিলারের মনস্তত্ত্ব এবং খুনের পদ্ধতির বিশদ দেখানো হয়েছে। চলুন, অল্প কথায় জেনে আসি সেই সিরিয়াল কিলারদের সম্পর্কে।
এডমন্ড কেম্পার বা কো-এড কিলার
ছয় ফুট নয় ইঞ্চি আর ২৮০ পাউণ্ডের বিশালদেহী খুনি এডমন্ড কেম্পারের সাক্ষাৎকার দিয়েই শুরু হয় এফবিআই এজেন্ট হোল্ডেন ফোর্ড এবং বিল টেঞ্চের যাত্রা। কেম্পারের বিরুদ্ধে নিজের মা, দাদা–দাদিসহ ১০ টি খুনের মামলা ছিল। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ১৯৬৪–৭৩ এর মধ্যে ঘটে। দাদা–দাদিকে খুনের দায়ে ১৫ বছর বয়সে ‘কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে’ও ছিল সে।
২১ বছর বয়সে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে ফের শুরু হয় তার নারকীয় কাণ্ড। কেম্পার সান্তা ক্রুজ এলাকার মোট ৬ জন ছাত্রীকে অপহরণ এবং হত্যা করে। হত্যার পর তাদের লাশের সাথে যৌনসংসর্গও করতো সে। আটটি লাশের শিরচ্ছেদও করে কো–এড কিলার। হত্যার নির্দিষ্ট কোন ধরণ ছিল না তার। গুলি, শ্বাসরোধ বা ছুরিকাঘাতের মাধ্যমেই খুনগুলো করতো কেম্পার।
মন্টে র্যালফ রিসেল
১৯৭৬ সালের ভেতর পাঁচজন মহিলাকে খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে মন্টে রিসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র আঠারো। পূর্বেও তার বিরুদ্ধে ডাকাতি ও ধর্ষণের বেশ কটি মামলা চলছিল।
১৯৯৫ সালে প্যারোলে বের হওয়ার কথা হলেও পরে তাকে ভার্জিনিয়ার পোকাহন্তাস স্টেট কারেকশনাল সেন্টারে পাঠানো হয়। তার বর্তমান বয়স ৫৯ বছর।
জেরি ব্রুডোস
সিরিয়াল কিলারদের সাথে সাধারণ খুনির বেশ অনেকগুলো তফাৎ আছে। যেমন– সাধারণ খুনিরা খুন করে এক সময় অনুশোচনায় ভুগে, যেখানে সিরিয়াল খুনিদের এই অনুভূতিটা একদমই নেই। তাদের কাছে একেকজন ভিকটিম একেকটা অর্জনের মতো।
ঠিক এই মনস্তত্ত্ব নিয়েই বাস করতো জেরি ব্রুডোস। এর উপর নারীদের সাজপোশাক, বিশেষত জুতোর প্রতি ছিল তার বাড়তি আকর্ষণ। ১৯৬৮–৬৯ সালের মধ্যে জেরি প্রায় পাঁচ জন মহিলাকে খুন করে। তার খুনের পদ্ধতিও ছিল বেশ সাজানো। প্রথমে সে বিভিন্ন স্থান থেকে অপরিচিতা নারীকে মডেল হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে নিজের গ্যারেজে নিয়ে আসতো এবং ধর্ষণের পর হত্যা করতো। মৃতদেহের প্রতিটি অঙ্গকে আলাদা করে পোশাক বা হাই হিল জুতো পরিয়ে ছবি তুলে রাখতো এই ভয়ানক খুনি। দুই ভিক্টিমের স্তন কেটে সাজিয়েও রেখেছিল সে ট্রফি হিসেবে।
২০০৬ সালে জেরি ব্রুডোস ওরেগন সংশোধন বিভাগে থাকাকালে লিভার ক্যান্সারে মারা যায়।
রিচার্ড স্পেক
১৫ বছর বয়সেই মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে স্পেক। স্কুল থেকে বহিষ্কৃতও হয় বাজে আচরণের জন্য। ১৯৬৬ সালে সে শিকাগো শহরে যায় কাজের আশায়। কিন্তু স্বভাব তো আর সহজে বদলায় না!
মদ্যপ অবস্থায় শিকাগোর এক নার্স হোস্টেলে ঢুকে পড়ে সে এবং একই সাথে আটজন নার্সিং স্কুলের ছাত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এর মধ্যে একজনকে ধর্ষণও করে স্পেক।
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলার সময় ঘরে আরও একজন ছাত্রী ছিল যে পরে স্পেককে সনাক্ত করে। ১৯৯১ সালে এই ভয়ংকর খুনি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে মারা যায়।
এলমার ওয়েন হেনলি জুনিয়র
এলমার ওয়েন মাত্র ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই ২৭ জনকে হত্যা করে। হেনলির এই ঘৃণ্য হত্যাকান্ডগুলোকে একত্রে ‘ হাউস্টোন ম্যাস মার্ডার’ নামে অভিহিত করা হয়।
তবে এই হত্যাগুলো হেনলি একা করতো না। প্রতিবেশী ডিনের জন্য কম বয়সী ছেলেদের ঘরে নিয়ে আসতো সে। ডিন ছিল সমকামী। শিশুগুলোকে ধর্ষণের পর নির্যাতন চালাতো তারা। শেষমেশ শ্বাসরোধে হত্যা করা হতো নিষ্পাপ শিশুদের।
১৯৭৩ সালে হেনলি ডিনকে গুলি করে হত্যা করে এবং তৎক্ষণাৎ পুলিশের কাছে নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করে। তারই মাধ্যমে পরবর্তীতে পুলিশ ২৭ জন শিশুর লাশ বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে।
বর্তমানে হেনলি টেক্সাসের মার্ক ডব্লিউ ইউনিটে কারাভোগ করছে।
ডেনিস রাডার
সিরিজে এখন অব্দি ডেনিস রাডার ওরফে ‘বিটিকে কিলার’এর পরিচয় উদঘাটন করা হয় নি। ১৯৭৪–৯১ সাল পর্যন্ত এই ক্রমিক খুনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস শহরে ১০ টি হত্যাকাণ্ড চালায়।
রাডার অবশ্য অন্য ক্রমিক খুনিদের থেকে বেশ আলাদাই। ১৯৭৪ সালে ওটেরো পরিবারের চারজনকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে সে। হত্যার পর তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা চিঠিতে লিখে উইচিটা লাইব্রেরির এক বইয়ের ভেতর রেখেও আসে। এরপরের খুনগুলোর পরেও সে নিয়মিত পুলিশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো। কখনো চিঠি পাঠানো, কখনো ফোনকলের মাধ্যমে সর্বদা লাইমলাইটে থাকতে চাইতো। খুনের পর ভিক্টিমের পোশাক, অন্তর্বাস প্রভৃতি স্মারক হিসেবে রেখে দিতো বিটিকে কিলার।
দুই সন্তান এবং স্ত্রী কে নিয়ে সুখী সংসার ছিল ডেনিসের । তাই কখনো সন্দেহের দৃষ্টিও পড়েনি তার উপর। এমনকি ১৯৭৪–৮৮ সাল অব্দি নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্বও পালন করে সে। ১৯৯১ সালে পুলিশের কাছে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেসও চাপা পড়ে।
২০০৫ সালে ডেনিস ফের চিঠি লেখা শুরু করলে সে বছরেরই জুন মাসে ধরা পড়ে। ১০ টি খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয় সে। বর্তমানে ক্যানসাসের এল ডোরাডো সংশোধনকেন্দ্রে আছে এই ঠাণ্ডা মাথার খুনি।
চার্লস ম্যানসন
ক্রমিক খুনির তালিকায় চার্লস ম্যানসনের নাম আর সবার থেকে ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। অন্য খুনিদের মতো ম্যানসন সরাসরি খুনের সাথে জড়িত ছিল না। বলতে গেলে কোন খুনই সে নিজ হাতে করেনি। অথচ তাকে মানা হয় সিরিয়াল কিলিং তথা নৃশংস খুনের অন্যতম কারিগর।
১৯৬৯ সালে একই রাতে হলিউড অভিনেত্রী শ্যারন টেটসহ পাঁচজনকে খুন করে চার্লস এবং তার কথিত পরিবারের সদস্যরা। এরপরের দিনই ম্যানসন পরিবার লেনো ও রোজমেরি লা বিয়াংকা নামক এক দম্পতিকে হত্যা করে। এছাড়াও ওই বছরেরই জুলাইয়ে এ গ্যারি হিনম্যান খুন হন এদের হাতে।
অক্টোবরে পুরো ম্যানসন পরিবারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং ১৯৭১ সালে জানুয়ারিতে সাক্ষ্যপ্রমাণসহ দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাদের। তদন্তে বেরিয়ে আসে, চার্লস কোন হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। সে মূলত পরিবারের অন্য সদস্যদের নানারকম দীক্ষার মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ চালাতে উৎসাহ প্রদান করতো। চার্লসের উত্থান সম্পর্কে ’৬০ এর দশকে তীব্র হতাশার জন্ম, বোহেমিয়ান জীবন এবং ‘হেল্টার স্কেল্টার’ তত্ত্বকে দায়ী করেন গবেষকেরা। ম্যানসন বিশ্বাস করতো, ‘ যারা সম্পদশালী এবং সুখে বাস করছে, তারা মৃত্যু সম্পর্কে জানেনা। তাদের অধিকারও নেই বেঁচে থাকার। বঞ্চিতদের জন্যই এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বিপ্লব আনা জরুরি।‘
১৯৭২ সালে ম্যানসন পরিবারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও পরে তা যাবজ্জীবনে বদল করা হয়। ইতিহাসের ভয়ালতম খুনে মাস্টারমাইন্ড মারা যায় ২০১৭ সালে, ৮৩ বছর বয়সে।
ওয়েন উইলিয়ামস
ফটোগ্রাফি এবং সংগীত প্রযোজনার কাজ করতো ওয়েন উইলিয়ামস। ১৯৭৯–৮১ সালে আটলান্টায় ২২ শিশু এবং ৬ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিকে খুনের দায়ে আটক করা হয় তাকে।
তবে পুলিশ মাত্র দুটি খুনের সাথেই ওয়েনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে।এমনকি মামলার গুরুত্বপূর্ণ তদন্তকারী এজেন্ট ডগলাসও বলেন, ‘প্রমাণাদি ঘাঁটলে আপনি মাত্র ১১ জন ভিক্টিমের সাথে উইলিয়ামসের সম্পৃক্ততা পাবেন। কিন্তু কোনভাবেই সবগুলো খুনের সাথে সে জড়িত নয়।‘
দীর্ঘদিন মামলাটি নিষ্ক্রিয় থাকলেও এ বছরের মার্চে আটলান্টার মেয়র কেইশা ল্যান্স বটমস এবং পুলিশ চিফ এরিকা শিল্ডস পুনরায় তদন্তের ঘোষণা দেন।
এই লেখাটি লেখার সময় আরেক খবরও কানে এলো। দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত সিরিয়াল কিলিং এর কথা মনে আছে? যার উপর ভিত্তি করে ‘Memories of Murder’ নির্মাণ করেছিলেন বং জুন হো। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা বাহিনী শেষমেশ খুনির ডিএনএ সনাক্ত করতে পেরেছেন। তবে দেখা যাক ইতিহাসের অন্যতম ধুরন্ধর আর ক্লাসিক খুনি ধরা দেয় কিনা পুলিশের হাতে!