যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি1 min read
Reading Time: 4 minutesএগিয়ে আসছে বাংলাদেশীরা
সাহেদ আলম, নিউইয়র্ক,
নিজেদের মধ্যে সমঝোতার সংকটে নিউইয়র্ক সিটির কাউন্সিলম্যান এবং মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হ্যামট্রমিক সিটি মেয়র নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বেশ কটি সিটির মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীরা নিজেদের আসন পোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের ‘লিবার্টি বেল’ সংরক্ষণকারি সিটি হিসেবে পরিচিত ফিলাডেলফিয়ার ডেপুটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশী ড. নীনা আহমেদ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সিটি কাউন্সিলসমূহে জয়ী সকল বাংলাদেশীই ডেমক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন। বাংলাদেশী-আমেরিকানদের ৯৫% এরও বেশী হলেন ডেমক্র্যাট।গত ৭ নভেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছেন পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের মিলবোর্ন বরো এবং আপার ডারবি টাউনশীপে। নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের হেলডন সিটির কাউন্সিলওম্যান তাহসিনা আহমেদ পুন:নির্বাচিত হয়েছেন। একই অঙ্গরাজ্যের প্লেইন্সবরো টাউনশিপে কাউন্সিলম্যান হিসেবে আগে থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানী ড. নূরন্নবী। নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে জয়ী হবার পরও দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে দীর্ঘ এক বছর আইনগত লড়াই চালাতে হয়েছে শাহীন খালিককে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই মামলা করেছিলেন আরেক বাংলাদেশী মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান। তিনি সামান্য ভোটের (১৪০১-১৩৮১) ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর শাহীনের বিরুদ্ধে মেইল ভোট-জালিয়াতির অভিযোগ করেছিলেন।যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী বাস করছেন জাতিসংঘের শহর নিউইয়র্কে। এ সংখ্যা কোনভাবেই ৩ লাখের কম নয়। তবুও এখন পর্যন্ত কংগ্রেসম্যান হওয়া দূরের কথা এই সিটির কাউন্সিলম্যান (ওয়ার্ড কমিশনার)ও নির্বাচিত হতে পারেননি কোন বাংলাদেশী। গত ৭ নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমক্র্যাট প্রাইমারিতে হেরে যাবার পর রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হিসেবে ব্যালটে নাম রয়ে যায় বাংলাদেশী তৈয়বুর রহমান হারুনের। এটি ছিল ২৪ নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের ২৪ নম্বর ডিস্ট্রিক্টে। এই নির্বাচনী এলাকার অধীনে রয়েছে জ্যামাইকা, জ্যামাইকা হিল্্স, পার্কওয়ে ভিলেজ, ব্রায়ারউড, জ্যামাইকা এস্টেট, হিলক্রেস্ট, ফ্রেশ মেডোজ, ইলেক্টচেস্টার, পমোনক এবং কিউ গার্ডেন্স এলাকা। এখানকার মোট ভোটারের ২৫% এর মত বাংলাদেশী। এশিয়ান ভোটারের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশী। হারুন ছিলেন একমাত্র এশিয়ান প্রার্থী। তবুও জয়ী হতে পারেননি নির্বাচনে। গৃহিত ভোটের ৮৮% পেয়েছেন ররি ল্যাঙ্কমেন।
অপরদিকে হারুন পেয়েছেন মাত্র ১১%। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ানদের সমর্থন আদায় দূরের কথা বাংলাদেশী-আমেরিকানরাও নিরঙ্কুশভাবে তাকে ভোট দেননি। এজন্যে দায়ী কে-সে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেয়ে সামনে যারা প্রার্থী হবেন তাদের উচিত হবে কম্যুনিটিকে আগে ঐক্যবদ্ধ করা অথবা প্রার্থী হবার পর সকলে স্বতস্ফুর্তভাবে মাঠে নামেন-এমনভাবে কম্যুনিটিতে বিচরণ করা। নিউইয়র্ক সিটির বেশ কটি এলাকায় বাংলাদেশীসহ দক্ষিণ এশিয়ান রয়েছেন ভোট-ব্যাংকে যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে। অথচ এখন পর্যন্ত একজনও নির্বাচিত হতে পারেননি নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকার কারণে।
মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হ্যামট্রমিক সিটির মোট ভোটারের অধিকাংশই মুসলমান। এর অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে বাংলাদেশীরা। গত কয়েক টার্মে এই সিটির ৬ কাউন্সিলম্যানের ৪ জনই বাংলাদেশী ছিলেন। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশীদের দখলে আসছিল এই সিটি। সে প্রেরণা থেকেই এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন বিদায়ী কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ হাসান। বর্তমান মেয়রকে মোহাম্মদ হাসানসহ আরেক বাংলাদেশী চ্যালেঞ্জ করেছিলেন দলীয় প্রাইমারিতে। অর্থাৎ ডেমক্র্যাটিক পার্টি থেকেই দুই বাংলাদেশী পরস্পরের বিরুদ্ধে ভোট চাওয়ায় অন্য দেশের ভোটারের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রাইমারিতে মোহাম্মদ হাসান টিকে গেলেও বাংলাদেশী ভোটারের মধ্যেকার বিভক্তি অবসানে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি হাসান। পরিনতি হিসেবে যা হবার তাই হলো ৭ নভেম্বরের নির্বাচনে। বর্তমান মেয়র ক্যরেণ মাজেওয়াস্কি ৬১% ভোট পেয়ে চতুর্থ টার্মের জন্যে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। হ্যামট্রমিকের নিকট প্রতিবেশী ডেট্রয়েট সিটির বাংলাদেশীদের অনেকেই এই পরাজয়ের জন্যে হাসানকেই দায়ী করেছেন। ‘ইগো’ প্রবলেম দূর করতে সক্ষম হলেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাংলাদেশী মেয়র হতে পারতেন বলেও কম্যুনিটি লিডারদের বিশ্বাস। হ্যামট্রমিক সিটির ৬ কাউন্সিলরের মধ্যে এখন মাত্র দু’জন বাংলাদেশী রয়েছেন। এরা হলেন আবু মুসা এবং এনাম মিয়া।পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়া সিটির ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. নীনা আহমেদ। এই সিটির ভোটারের মধ্যে খুব কমই রয়েছেন বাংলাদেশীরা। তবুও ড. নীনা নিজের অবস্থান পোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এশিয়ানদের মধ্যে নিজের কর্মতৎপরতাকে জনপ্রিয় করায়। শুধু তাই নয়, হিসপ্যানিকরাও ড. নীনাকে আপন ভাবেন অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের প্রশ্নে। এই সিটির পার্শ্ববর্তী আপারডারবি টাউনশিপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় টাউনশিপ। ৬৫ ভাষার মানুষের এ সিটির ভোটার এক লাখের মত। কাউন্সিলম্যান রয়েছেন ১১ জন। এরমধ্যে মাত্র এক বাংলাদেশী শেখ মোহাম্মদ সিদ্দিক নিজের অবস্থানকে সুসংহত রাখার পাশাপাশি কম্যুনিটির লোকজনকে মূলধারায় আরো বেশী সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালে। বাংলাদেশ সোসাইটি অব পেনসিলভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ সিদ্দিক বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতিকে বহুজাতিক এ সিটিতে সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। শেখ সিদ্দিক বলেন, প্রবাসীরা সংঘবদ্ধ থাকলে এখানে অনেক কিছুই করা সম্ভব।ফিলাডেলফিয়া এবং আপার ডারবির মধ্যে অবস্থিত মিলবোর্ণ সিটি। ১২ শতাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই সিটির ৫ কাউন্সিলম্যানের ৪ জনই বাংলাদেশী। এরা হলেন নূরুল হাসান, ফেরদৌস ইসলাম, মনসুর আলী মিঠু এবং মাহবুবুল আলম তৈয়ব। অপর কাউন্সিলম্যান হলেন ভারতীয় আমেরিকান জাস্টিন স্কারিয়াহ। তিনিই হচ্ছেন এই সিটি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট। অপরদিকে, আসছে জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নতুন কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেন নূরুল হাসান। নানাাবিধ কারণে প্রেসিডেন্ট পদটি এখনও নিজেদের আয়ত্বে আনা সম্ভব হয়নি, তবে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চলছে বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশী। নূরুল হাসান বলেন, জানুয়ারিতে নতুন কাউন্সিলের শপথ গ্রহণের পর সকলের সমর্থনে যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারি তবে সর্বপ্রথম কাজ হবে সর্বসাধারণের জন্যে ট্যাক্স রিবেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটানো।
ট্যাক্স প্রদানকারিদের স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি নিরাপদ জীবন-যাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। সকলেই যাতে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম এবং কালচার লালন-পালনে কোন বাধার সম্মুখীন না হন-সে চেষ্টা সবসময়ই ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। হাজার বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত বাঙালি সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মে বিকাশের প্রক্রিয়াকেও সহায়তা দেয়া হবে এই সিটিতে। তবে এই সিটির পুরো নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশীদের হাতেই বলে মনে করছেন অনেকে। উল্লেখ্য, বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়া এলাকায় ১২ থেকে ১৫ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করছেন। জাতীয় ইস্যুতে তাদের মধ্যে ঐক্য থাকায় ফিলাডেলফিয়া সিটি হলের পাশের রাস্তায় বাংলাদেশের পতাকাও শোভা পাচ্ছে। আসছে বিজয় দিবসে সেখানে ঘটা করে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর চেষ্টার কথা জানালেন ডেপুটি মেয়র নীনা আহমেদ।এদিকে, নিউজার্সির হেলডন সিটি কাউন্সিলওম্যান হিসেবে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন তাহসিনা আহমেদ। নিউজার্সির পার্সপ্লেনীতে জন্মগ্রহণকারি তাহসিনা মা-বাবার সাথে দু’বছর বয়সে হেলডনে বসতি গড়েছেন। বর্তমানে তিনি মনমাউথ ইউনিভার্সিটিতে সমাজকর্মে মাস্টার্স করছেন। অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি কম্যুনিটি সার্ভিসের পথ ধরে ৩ বছর আগে সিটি কাউন্সিলে জয়ী হয়েছেন। এবার পুননির্বাচিত হওয়ায় তাহসিনার স্বপ্নের দিগন্ত আরো বিস্তৃত হলো। তিনি মাস্টার্স শেষ করে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হতে আগ্রহী। তবে সবটাই নির্ভর করছে দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর। তাহসিনার বাবা সিলেটের গোলাপগঞ্জের লক্ষিপাশা গ্রামের সন্তান আমিন উদ্দিন আহমেদ এ সময় বলেন, স্কুল বোর্ডে দু’বার লড়েও জয়ী হতে পারেনি তাহসিনা। এরপর ডেমক্র্যাটিক পার্টি তাকে কাউন্সিলম্যানের পদে দাড় করায়। এভাবেই তার কর্ম-এরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছি। তাহসিনার একমাত্র ছোটভাই গ্র্যাজুয়েশন করে পুলিশ একাডেমিতে গেছেন। তার বাবা ৩৮ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এই সিটির প্রবাসী দেওয়ান বজলু ২০০৮ সালে স্কুল বোর্ডে লড়েছেন। জয়ী হতে পারেননি। তবুও তিনি থেমে যাননি। গত ৯ বছর যাবত হেলডনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও তাহসিনার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।এই অঙ্গরাজ্যের প্লেইন্সবরো টাউনশিপে গত ৩ টার্ম থেকেই নির্বাচিত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানী ড. নূরন্নবী। তিনিও ডেমক্র্যাটিক পার্টির রাজনীতিতে আরো এগিয়ে যেতে আগ্রহী। সে লক্ষ্যে মাঠে রয়েছেন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকেই।মিশিগানের হাশিম ক্লার্ক কংগ্রেসম্যান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে বিশেষ এক আসনে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি পুননির্বাচিত হতে পারেননি। এরপর জর্জিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, টেনেসী প্রভৃতি এলাকা থেকে ইউএস কংগ্রেসে কয়েকজন বাংলাদেশী প্রার্থী হলেও এখন পর্যন্ত কেউই জয়ী হতে পারেননি। এনআরবি নিউজ