নিউইয়র্কে ট্যাক্সিচালক দেশে শিক্ষানুরাগী1 min read
Reading Time: 3 minutes৫টি স্কুল সহ ১০ টি প্রতিষ্ঠান চালাতেই নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালান মোশারফ হোসেন খান
বিশেষ প্রতিনিধি
মোশারফ হোসেন খান, নিউইয়র্কের আরো ১০-১৫ হাজার ট্যাক্সি-উবার চালকদেরই একজন। কুমিল্লার ব্রাম্মপাড়ায় তার জন্ম।নতুন বছরের তৃত্বীয় দিনে যখন তার সাথে কথা হচ্ছিল তখন মোশারফ হোসেন বেরিয়ে পড়ার ব্যস্থতায় ছিলেন।নিউইয়র্কের পথে পথেই কেটেছে তার ২৯ বছরের আমেরিকা জীবন।
২০১৪ সালে বোর্ড সেরা ২০ টি কলেজ এর তালিকায় স্থান করে নেয় কুমিল্লার ব্রাম্মপাড়ার মোশারফ হোসেন খান ডিগ্রি কলেজ। এর পর সেখানে অনার্স কোর্স চালুর দাবী উঠে। সেই দাবী বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয় সরকার। এখন ঐ কলেজে ১০টি বিষয়ে অনার্স শিক্ষা চালু আছে। নাম হয়েছে মোশারফ হোসেন খান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ঐ কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা মোশারফ হোসেন খান।নিউইয়র্কের বাসিন্দা, পেশায় একজন ট্যাক্সিচালক।তবে এর বাইরেও কাজ করেন তিনি। কাজ যেটাই করেন, উদ্দেশ্য থাকে যেন এই শহরে জীবন ধারন করার পরও বাড়তি কিছু টাকার সংস্থান করা যার মাধ্যমে তিনি যেনে তার জন্মভুমি কুমিল্লায় গড়ে তোলা ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ মোট ১০টি প্রতিষ্ঠানকে মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারেন।
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরাগ এসেছে আমার পারিবারিক শিক্ষা থেকেই। আমার দাদা একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুলের শিক্ষার্থীই এখন ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল।আরো অনেক বড় জায়গায় তারা প্রতিষ্ঠিত। আমি বিশ্বাস করি আমার প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজ গুলো থেকেই একদিন দেশ পরিচালনার কারিগর তৈরী হবে’- বলছিলেন মোশাররফ হোসেন খান।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যায়। পারিবারিক অভাবে পড়ে আমার আর শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয় নি। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল বাবা আর দাদা’র স্বপ্নটাকে এগিয়ে নেয়া। কারণ আমার দাদা যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন সেটার ছাত্ররা আজ অনেক বড়, একজন তো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল। আমার বাবার স্কুল প্রতিষ্টা করেন রাঙামাটিতে। কিন্তু আমাদের এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন পূরন করতে পারেননি বাবা। সে কারনেই গ্রামবাসীর সহায়তা আমি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্টান দাড় করিয়েছি।
মোশাররফ হোসেন জীবন জীবিকার তাগিদে প্রথমে চলে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে পরে নিউইয়র্কে ১৯৮৯ সালে। ইনি ১৯৮৯ সালেই নিজ উদ্যোগে ও অর্থায়নে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন নিজগ্রামে আব্দুর রাজ্জাক খান চৌধুরী হাইস্কুল। তারপর পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠা করেন ৭টি প্রতিষ্ঠান। (১) মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ যার ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৪০০০ । আইনমন্ত্রী হিসেবে আব্দুল মতিন খসরু তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এমপিওভুক্ত করতে সহযোগীতা করেন, এ কারনে তিনি তার নামেও একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৫০০। আব্দুর রাজ্জাক খান চৌধুরী হাইস্কুল ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ১০০০। মুুমু-রোহান চাইল্ড প্রিক্যাডেট ,আশেদা-যোবেদা মাদ্রাসা , মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী ফাউন্ডেশন , ব্রাক্ষণপাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল নামেও প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন তিনি।
এই স্বপ্ন পূরন করতে গিয়ে নিজের একখন্ড বাড়ি গাড়ীর স্বপ্ন পূরন করতে পারেননি তিনি। তাতে দু:খ নেই। কথার ফাকে এই ত্যাগের জীবন বেছে নেয়ার পেছনে স্ত্রীর অনুপ্রেরণার কথাও মনে করিয়ে দেন মোশারফ হোসেন খান ।
‘আমি চাইলেই আমার স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে আসতে পারতাম,কিন্তু সেটা করলে তো স্বপ্নে ছেদ পড়তো। এখানকার জীবন খুবই কষ্টের। বেশিরভাগ সময় আমার মেনুতে থাকে আলু ভর্তা আর ডাল। এখানে পরিবার নেই দেখেই আমি অবিরাম কাজ করতে পারি। কিছু টাকা পাঠাতে পারি দেশে।’ বলছিলেন মোশারফ হোসেন খান।
সম্পূর্ন নিজ অর্থে ও উদ্যোগে ক্রয় করা জমির উপর তিলে তিলে গায়ে খাটা ঘামে ঝড়া পয়সায় নির্মিত বহুতল বিশিষ্ট দালান হচ্ছে ও সুপ্রশস্ত খেলার মাঠ ও অডিটোরিয়াম, চিত্ত বিনোদনের জন্য বিনোদন প্রাঙ্গন এবং সুদৃশ্য ফুল ও ফলের বাগান। যার অধিকাংশ নিজের হাতেই গড়েছেন তিনি।
‘আমার কাজ শেষ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সৃষ্টি কর্তা আমার হাত দিয়ে হয়তো আরো অনেক কাজ করাতে চান। সেগুলি আমি করবো তাই আমেরিকায় বাড়ি গাড়ি করি নি। আমার ২ টি ছেলে মেয়ে ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করছে। সেখানে আমার পরিবার চালাতেও বেশ খরচ হয়। সেটা যোগান দিতেই আমি এখনও এই শহরে পড়ে আছি। তবে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি দেশে ফেরত যাব।এখনও যাতায়াতের মধ্যেই থাকি, কিন্তু একেবারের দেশে পাড়ি জমাবো সময় হলে। আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি যেন আরো বড় হয় সেদিকে নজর দেব’- জানাচ্ছিলেন মোশাররফ হোসেন।
৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব কটিউ-ই এমপিও ভুক্ত। এ্ই এমপিও ভুক্ত হওয়ার কারণে এখন শিক্ষকদের বেদতনাদি এবং অন্যন্য বিষয়ে সরকারী সহায়তা মিলছে, তবে এতদুর আসতে গিয়ে কখনই অণ্যের অনুদান অথবা অর্থনৈতিক সাহায্যের কথা ভাবেন নি।
‘এখনও আমি অনুদান নেই না। কারন, কেউ হয়তো বলছে দেবে ২ শত ডলার। কিন্তু সেই টাকা আদায় করতে গিয়ে যে সময়টা ব্যায় হয়, সেই সময় তো আমার নেই। বরং আমি আরো একটু বেশি পরিশ্রম করি, যেন কারো কাছে টাকা চাইতে না হয় আমার’।