চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের বর্তমান অবস্থা1 min read
Reading Time: 3 minutes২০১৫ সালে যখন সিপিইসি(CPEC) অর্থাৎ চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিল তখন বলা হচ্ছিল পাকিস্তানের ভাগ্য পরিবর্তনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সিপিইসি মূলত চায়নার আন্তঃ মহাদেশীয় বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর একটি প্রকল্প। চীনের অর্থায়নে এই প্রকল্পটির মূল পরিকল্পনা ছিল চায়না ও এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য পুরাতন সিল্ক রোড পুনঃনির্মান করা। বেইজিং এর আশা ছিল যে BRI এর এই প্রকল্পটি পাকিস্তানসহ পুরো এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ এবং বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যার ফলে সেই অঞ্চলগুলোতে মার্কিন প্রভাব অনেকাংশে কমে আসবে।
সিপিইসির উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে চাইনিজ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাকিস্তান সফরে গিয়ে ৪৬ মিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্টটি শুরু করেন। পরবর্তীতে চায়না সরকার এবং বেসরকারি অতিরিক্ত বিনিয়োগ মিলে সেই অংকের পরিমাণ বেড়ে যায়। ২০১৭ সাল নাগাদ এই উন্নয়ন প্রকল্পের মূল্য দাঁড়ায় ৬২ মিলিয়ন ডলারে। সিপিইসি মূলত পুরো পাকিস্তান জুড়ে অবকাঠামো মূলক উন্নয়নের একটি প্রকল্প এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তান জুড়ে হাইওয়ে এবং রেলপথের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হবে।
এক নজরে সিপিইসি এর কিছু উল্লেখ্য যোগ্য পরিকল্পনাঃ
- ২০০০ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই করিডরটি পাকিস্তানের গদর শহরের গদর বন্দর থেকে চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে
- লাহোর এবং করাচীর মধ্যে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার লম্বা একটি হাইওয়ে তৈরি করা হবে
- হাসান আবদাল থেকে চাইনিজ সীমান্ত পর্যন্ত কারাকোরাম হাইওয়ে সম্পূর্ণ পুনর্গঠন ও পুনঃ নির্মাণ করা হবে
- করাচী-পেশোয়ারের প্রধান রেলপথটি আরো উন্নত করা হবে যাতে এই পথ দিয়ে ২০১৯ সালের মধ্যেই ঘণ্টায় ১৬০ মেইল বেগে ট্রেন যাতায়াত করতে পারে।
- পাকিস্তানের রেলওয়ে নেটওয়ার্কটি চীনের দক্ষিণ জিনজিয়াং পর্যন্ত সংযুক্ত করার জন্য বৃদ্ধি করা হবে
- পাকিস্তানের জ্বালানী সমস্যা সমাধানের জন্য প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের জ্বালানী অবকাঠামো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তৈরি করা হবে।
সিপিইসি এর বর্তমান অবস্থা
ব্রাসেলস-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া ডেমোক্র্যাটিক ফোরামের সিনিয়র গবেষক সিগফ্রিড ও ওলফ এর মতে চার বছর আগে শুরু হওয়া এই সিপিইসি প্রকল্পটি বর্তমানে ঠিক ততটা কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না যতটা আশা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রকল্পটির অগ্রগতিতে কিছুটা ভাটা পরে গেছে।
গত বছর পাকিস্তানের বাণিজ্য, শিল্প ও বিনিয়োগ মন্ত্রী আবদুল রাজ্জাক পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব সিপিইসি প্রকল্প স্থগিত করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি এক বছরের জন্য পুরো প্রকল্পটি বন্ধ রাখা উচিৎ যাতে করে আমরা পুরো বিষয়টি নিয়ে আরেকটু পর্যালোচনা করতে পারি। এছাড়া তিনি বিগত সরকারের দুর্নীতির সমালোচনা করে বলেন, নওয়াজ শরিফের সরকার এই প্রকল্পটি চীনকে অনেকটাই শর্তবিহীন করে অনুমোদন দিয়েছে।
করাচী ভিত্তিক রাজনৈতিক কলামিস্ট নাদিম আক্তার বলেন, পূর্বের সরকার নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য এই চীনা সংস্থাগুলোর সাথে জড়িত ছিল। ইমরান খান এসে পুরো দৃশ্যপটটি রাতারাতি পরিবর্তন করে দিতে পারেন না। এই রাজনৈতিক কলামিস্ট ডি,ডব্লিউতে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, ইমরান খানের সরকারকে ক্ষমতায় আসার জন্য মূলত সামরিক বাহিনী অনেক সহযোগিতা করেছিল, কেননা তারা নওয়াজ শরীফের এই সিপিইসি প্রকল্পটি নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট ছিল না। সামরিক বাহিনী এটা ধারনা করছিল যে, তারা যদি নাওয়াজ শরীফকে এই প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে দেয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আরো অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন এবং সেনাবাহিনীর উপর তার নির্ভরশীলতা কমে আসবে।
প্রতিবেশী দেশের সাথে কোন্দল এবং সিপিইসির উপর তার প্রভাব
ওলফের মত বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রকল্পটি আদতে অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে পাকিস্তানের ভাগ্যকে রাতারাতি বদলে দিবে না বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা হিসেবেই থেকে যাবে।
আদতে যতক্ষণ পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে না এবং সীমান্তব্যাপী সন্ত্রাস এবং জঙ্গিদের সমর্থন বন্ধ করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সিপিইসি আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সর্বোপরি উন্নতির ব্যাপারে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য অবদান নিয়ে আসতে সক্ষম হবে না।
এছাড়া গত ৫ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে বাতিল করার পর থেকে নয়াদিল্লী ও ইসলামাবাদের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভারত সরকারের নেয়া এই পদক্ষেপটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিরোধকে আরও বেগবান করেছে, সেই সাথে এইসব আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমঝোতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যাহত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো এই প্রকল্পে না জড়াবে ততক্ষণ পর্যন্ত সিপিইসি দিয়ে পূর্ণ সমৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব নয়।
অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের দাবী, সিপিইসিকে একটি স্বনির্ভর ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবে অনুমতি দেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এটিকে একটি “নিয়ন্ত্রিত প্রকল্প” হিসাবে ব্যবহার করছে। যার ফলে এই প্রকল্পটি অভ্যন্তরীণ এবং প্রতিবেশী দেশের সমস্যাগুলো তো সমাধান করবেই না বরং সেগুলো আরো ব্যাপক আকারে বেড়ে যাবে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সিপিইসি সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের কিছু এলাকা একদম স্থায়ী ভাবেই বদলে যেত। দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠত।