ইতিহাস

কুখ্যাত হুন সম্প্রদায় এবং রোমান সাম্রাজ্য1 min read

জুন ৩০, ২০২০ 5 min read

author:

কুখ্যাত হুন সম্প্রদায় এবং রোমান সাম্রাজ্য1 min read

Reading Time: 5 minutes

হুনরা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত যাযাবর যোদ্ধা জাতি। কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে উঠে এসে চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে এরা ইউরোপের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং রোমান সম্রাজ্যে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। তুখোড় অশ্বারোহী বাহিনী এবং নিপুণ রণকৌশল ইতিহাসে তাদের অমর করে রেখেছে। ইউরোপ দখলের পথে বর্বরোচিত অত্যাচার, ধর্ষণ, লুন্ঠণ হুন জাতিকে সে সময়ে কুখ্যাতির চরমে পৌঁছে দিয়েছিল।

হুন জাতির আদিনিবাস নিয়ে বিতর্ক আছে। গবেষকদের একটা অংশের দাবি হুন জাতির আদিনিবাস কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে। আরেক দল গবেষক বিশ্বাস করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩১৮ সালে চীনের ছিন (Qin) রাজত্ব চলাকালীন শিয়ংনু যাযাবর জাতি থেকেই আলাদা জাতি হিসেবে জন্ম নেয় হুন জাতি। উল্লেখ্য যে, চীনের বিখ্যাত “গ্রেট ওয়াল” নির্মাণ করা হয়েছিলো তৎকালীন পরাক্রমশালী শিয়ংনু জাতির আক্রমণ থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্যই।

এই জাতির দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর কোন ইতিহাস এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। চতুর্থ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই জাতিটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করা শুরু করে। এসব দলের জন্য একজন করে নেতা নির্বাচন করা হতো। তবে এদের কেন্দ্রীয় কোন নেতা বা রাজা ছিলো না। ৩৭০ সালের দিকে এরা ইউরোপে এসে পৌঁছায় এবং একের পর এক ছোটো রাজ্য দখল করে ৭০ বছর যাবত একটানা শাসন করে।

হুনরা ইতিহাসের অন্যতম সেরা অশ্বারোহী যোদ্ধা জাতি। কথিত আছে, তারা ঘোড়ার পূজা করতো এবং ঘোড়ার পিঠেই ঘুমাতো। হুনরা তাদের সন্তানদের মাত্র ৩ বছর বয়স থেকেই অশ্বারোহন শেখাতো। অল্প বয়স থেকে যন্ত্রণা সহ্য করার স্বক্ষমতা আনতে তাদের মুখ তলোয়ার দিয়ে কেটে দেওয়া হতো। অল্প বয়স থেকেই একজন পাঁকা যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলা হতো প্রত্যেকটা হুন শিশুকে।

হুন সৈন্যরা সাধারণ পোশাক পরিধান করতো। তবে আভিজাত্যের জানান দিতে অনেকেই সোনা, রৌপ্য এবং মূল্যবান পাথর ব্যবহার করতো। যাযাবর জাতি হওয়ায় এক জায়গায় খুব বেশীদিন স্থায়ী হতো না এরা। খাদ্যের যোগান দিতে হুনরা গবাদি পশু পালন করতো। হুনদের খাবার তালিকায় ছিল বুনো ওল, শিকড় ও নানারকম গুল্ম। আদিম সভ্যতার জাতিগুলোর মতো এরাও একসাথে শিকার করতো এবং সবাই মিলে একসাথে খেতো।

হুনদের রণকৌশল ছিলো অনন্য। যুদ্ধের ময়দানে অশ্বারোহী বাহিনী খুব দ্রুত এবং বিক্ষিপ্তভাবে অগ্রসর হতো। তাদের ক্ষীপ্রতা দেখে প্রতিপক্ষ দলের যোদ্ধারা বিভ্রান্ত হয়ে ময়দান ছেড়ে পালাতো। হুন যোদ্ধারা হাড়ের তৈরি এক বিশেষ ধরণের ধনুক ব্যবহার করতো। তাদের ধনুকের তীর প্রায় ৮০ গজ দূর পর্যন্ত শত্রুর হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতো। আর হুন তীরন্দাজদের নিশানাও ছিলো নির্ভুল। তাদের তীরের নিশানা থেকে বেঁচে ফেরা একরকম অসম্ভবই ছিলো। যুদ্ধের ময়দানে হুনদের হিংস্রতা আর নৃশংসতা শত্রুদের আত্মা কাঁপিয়ে দিতো।

জানা যায় যে, হুনরা তাদের সন্তানদের মাথায় একধরণের বিশেষ বন্ধনী পড়িয়ে দিতো। এই বন্ধনী ধীরে ধীরে তাদের মাথাকে এক ভয়ানক বিকৃত রূপ দিতো। যা দেখেই প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের কলিজা হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো।

হুনদের নৃশংসতা থেকে নারী শিশু কিংবা বৃদ্ধ কেউই বাদ যেতো না। চলার পথে চোখের সমানে যাকে পেতো তাকেই নৃশংসভাবে খুন করতো এরা। বাড়িঘর লুটপাট করে আগুণ ধরিয়ে দিতো অথবা একদম মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতো। এছাড়া শক্তি সামর্থ্য বিবেচনা করে কিছু মানুষকে বন্দী করে দাস বানিয়ে রাখতো।

৩৭০ সালের দিকে হুনদের ইউরোপ আগমন এক ঐতিহাসিক মোড় নেয়। সে বছর তারা ভলগা নদী অতিক্রম করে ইউরোপ অঞ্চলে প্রবেশ করে আরেক যাযাবর জাতি অ্যালান্স-কে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে ঐ এলাকা দখল করে নেয়। আলান্সও ছিলো ঘোড়া সওয়ার যাযাবর জাতি।

দুই বছর এই এলাকায় কাটানোর পর হুনরা জার্মানিক গথসের পূর্ব দিকের ওস্টরোগ্রোথ উপজাতিদের আক্রমণ করে বসে। নিয়মিত বিরতিতে রোমান অধ্যুষিত এই এলাকায় আক্রমণ করে হুনরা রোমানদের হয়রানি করতে শুরু করে। ৩৭৬ সালের দিকে হুনরা গোথের পশ্চিমের উপজাতি ভিসিগোথসদের ( Visigoths) আক্রমণ করে এবং তাদের রোমান সম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিতারিত করে। কয়েক বছরের যুদ্ধে বহুসংখ্যক অ্যালান্স, গথ এবং ভিসিগথস যোদ্ধাদের আটক করে তারা নিজেদের পদাতিক সেনাদলে ভর্তি করে দেয়। হুনদের হাত থেকে পালানোর কোন উপায় ছিলো না এই সৈন্যদের। তাই প্রাণ বাঁচাতে হুনদের হয়ে যুদ্ধ করতে হতো তাদের।

কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপজুড়ে হুনদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই তাদের পরাক্রমশালী হিসেবে মেনে নেয়। ৩৯৫ সাল পর্যন্ত হুনরা রোমান অধ্যুষিত আশপাশের এলাকাগুলোতে নিয়মিত আক্রমণ চালিয়ে হয়রানি করতো। রোমানদের মধ্যে তখন একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিলো, হুনরা জাহান্নম থেকে আগত শয়তানের সেনাদল। এদের পরাজিত করা অসম্ভব।

৪৩০ সালের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা হুনরা এক এক করে ইউরোপের এই অঞ্চলে এসে জড়ো হতে থাকে। এই সময়টাতে হুনদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো রাজা রুগুলিয়া এবং তাঁর ভাই অক্টার। ৪৩২ সালে রোমানদের সাথে এক যুদ্ধে অক্টারের মৃত্যু হলে রুগুলিয়া একাই হুনদের উপর রাজত্ব কায়েম করেছিলো। এই সময়টাতে রুগুলিয়া রোমান সম্রাট থিয়োডিসিয়াসের সাথে এক যুগান্তকারী চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী বিপুল পরিমাণ উপঢৌকনের বিনিময়ে গোথদের পরাজিত করার জন্য হুনরা থিয়োডিসিয়াসকে সাহায্য করে। রোমানদের সাথে এমন চুক্তির পরই পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে হুন জাতি হাঙ্গেরিয়ান সমভূমি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে।

রোমানরা হয়তো ভেবেছিল, হুনরা রুগুলিয়া শাসনামলেই নৃশংস ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তখনও হুনদের নৃশংসতার কিছুই দেখেনি। ৪৩৪ সালে রুগুলিয়া মারা গেলে তাঁর দুই ভাতিজা আতিলা (Attila) এবং ব্লেদা তাঁর স্থালাভিষিক্ত হয়। আতিলা ছিলো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। সে লাতিন এবং গোথ উভয় ভাষাই জানতো। আপোস আলোচনায় তাঁর দক্ষতা ছিলো ঈর্ষণীয়। ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই সে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের সাথে একটি শান্তিচুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী হুনরা রোমানদের আক্রমণ করা বন্ধের বিনিময়ে বিপুল স্বর্ণ নিয়েছিলো রোমানদের থেকে। এবং কথা ছিলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর হুনদের স্বর্ণ দিয়ে যেতে হবে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৪৪১ সালে রোমানরা এই চুক্তি ভঙ্গ করে।

চুক্তি ভঙ্গের পরপরই কালক্ষেপন না করে আতিলা তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে বালকানস এবং ডানুবিয়ান সীমান্ত দিয়ে রোমান সম্রাজ্যে প্রবেশ করে। এরপর ৪৪২ সালে রোমানরা পুনরায় আরেকটি শান্তিচুক্তি করে। কিন্তু এবার আতিলা সেই শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে ৪৪৩ সালে কনস্ট্যান্টিনোপল নগরী আক্রমণ করে বসে। কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করার পর তাঁর নৃশংসতার জন্য সে “ঈশ্বরের চাবুক” উপাধি পেয়েছিলো।

এদিকে ৪৪৫ সালে আতালি তাঁর ভাই ব্লেদাকে খুন করে বসে। ধারণা করা হয়, ব্লেদাই আতালিকে খুন করতে চেয়েছিলো এবং নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ব্লেদাকে হত্যা করে সে। ব্লেদার মৃত্যুর পর আতালি একাই হুন জাতিকে শাসন করতে থাকে। একা রাজ্বত হাতে পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আতালি পূর্ব রোমান সম্রাজ্য আক্রমণের জন্য সৈন্য দল নিয়ে রওনা হয়। বালকানস যাওয়ার পথে এই সৈন্যদল পথের সামনে যা পেয়েছে তাই একদম গুড়িয়ে নস্যাৎ করে দিয়েছে। প্রাণ নিয়েছে বহু নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের।

৪৫১ সালে আতিলা গল আক্রমণ করে। গল অঞ্চলটি বর্তমান ফ্রান্স, উত্তর ইতালি এবং পশ্চিম জার্মানিজুড়ে বিস্তৃত ছিলো। তবে রোমানরা এবার নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় বেশ স্বোচ্চার ছিলো। তারা ভিসিগথ এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য বর্বর উপজাতিদের সাথে মৈত্রী গঠন করে এক বিশাল এবং শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করে হুনদের পথরোধ করে।

পূর্ব ফ্রান্সের কাতালুনিয়ান সমভূমিতে উভয়পক্ষ যুদ্ধে মিলিত হয়। উভয়পক্ষই সমানতালে লড়ছিলো। এতো দিন পরে হুনরা যুদ্ধে সমকক্ষ কাউকে পেয়েছিল। মূলত হুনদের সাথে পূর্বের যুদ্ধ অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়েছিলো রোমানরা। সমানে সমান দক্ষ ঘোড়সওয়ার বাহিনী দাঁড় করিয়েছিলো তারা হুনদের সামনে। আর রোমান পদাতিক বাহিনীর সুনাম তো ইতিহাসখ্যাত। এছাড়াও তাদের সাথে ছিলো ভিসিগোথসহ অন্যান্য বর্বর উপজাতি যোদ্ধারা।

ঘন্টার পর ঘন্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। প্রায় দশ হাজার সৈন্য এযুদ্ধে প্রাণ হারায়। রোমান এবং তাদের মিত্র যোদ্ধারা হুনদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলো। এটাই ছিলো কোন যুদ্ধে আতিলার প্রথম এবং একমাত্র পরাজয়।

পরাজয়ের পর আতিলা তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইতালি ফিরে আসে এবং একের পর এক শহর ধ্বংস করতে থাকে। ৪৫২ সালে আতিলা প্রথম পোপ লিয়োর সাথে সাক্ষাৎ করে। পোপ লিও, আতিলা এবং রোমান সম্রাজ্যের মধ্যে দূত হিসেবে কাজ করছিলেন। তবে তাদের মধ্যে ঠিক কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো এ বিষয়ে কোন রেকর্ড নেই। তবে পোপের সাথে কয়েক দফা আলোচনার আতিলা ইতালি ছেড়ে হাঙ্গেরিয়ান সমভূমিতে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাঁর এমন সিদ্ধান্তের পেছনে পোপ লিয়োর মধ্যস্ততা কাজ করেছিল নাকি নিজের সৈন্যদের যুদ্ধ করে ক্লান্ত হওয়া বা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া মূল কারণ ছিলো এটা নিয়েও এখনও বিতর্ক রয়েছে।

বিখ্যাত যোদ্ধা হওয়া স্বত্বেও আতিলার মৃত্যু কিন্তু কোন যুদ্ধের ময়দানে হয় নি। রোমের নতুন সম্রাট মার্সিয়ান পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী হুনদের বাৎসরিক রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানালে আতিলা পুনরায় কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তাঁর সর্বশেষ বিয়ের রাতে সে প্রচুর পরিমাণ মদ পান করে মাতাল হয়ে যায়। গলা দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হওয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যায় আতিলা।

মৃত্যুর পূর্বেই আতিলা তাঁর বড় ছেলে এলাককে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত করে যায়। কিন্তু আতিলার মৃত্যু হুন জাতির অন্ত ডেকে এনেছিলো। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেরা রাজত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে যায় এবং বেশ কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে। এসব যুদ্ধে হুন জাতি ধীরে দূর্বল হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যকার একতা ভেঙে যায়।

অবশেষে ৪৫৯ সালে একসময় ইউরোপজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করা হুন সম্রাজ্যের পতন ঘটে। হুনরা যে যার মতো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে কাছের শহরগুলোতে বসবার করতে শুরু করে।

লেখক- নিয়ন রহমান 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *