Site icon Bangla Info Tube

স্যার ফজলে হাসান আবেদঃ একজন পথ প্রদর্শকের প্রস্থান

স্যার ফজলে হাসান আবেদঃ একজন পথ প্রদর্শকের প্রস্থান, Photo Source: BRAC

Reading Time: 4 minutes

স্যার ফজলে হাসান আবেদ একাধারে একজন সমাজকর্মী এবং বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। স্যার আবেদের একান্ত চেষ্টা এবং দূরদর্শিতার কারণে দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলা ব্র্যাকের পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা এখন বিশ্বব্যাপী। ২০১৪ সালের ২৪শে এপ্রিল দক্ষিণ এশিয়া ইন্সটিটিউটের বার্ষিক হরিশ সি মাহেন্দ্র লেকচারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন, “আশা হল এমন একটি উপাদান যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে পরিচালিত করে দারিদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহ পায়”  

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা ও বেড়ে ওঠা আবেদ একজন একাউন্টেন্ট হিসেবে যখন কর্ম জীবন শুরু করছিলেন, তখনই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধ স্যার আবেদের জীবন দর্শন এবং ভবিষ্যত চিন্তার উপর তীব্র প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৎকালীন সময়ে তিনি লন্ডনে অবস্থানরত অবস্থায় স্বদেশের পক্ষে এডভোকেসি করেন এবং যুদ্ধের পরবর্তীতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফিরেই তিনি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা শুরু করেন। বলা যেতে পারে তখনই তিনি দরিদ্র মানুষের কর্মক্ষমতা বিকাশে সহায়তার মাধ্যমে দারিদ্রতা বিমোচনের উদ্দেশ্যে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই পরিকল্পনাটি সফলভাবে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও পরবর্তীতে প্রয়োগ করা হয়েছে।

লেগো পুরষ্কার (২০১৮), লাউডাটো সি ‘অ্যাওয়ার্ড (২০১৭), টমাস ফ্রান্সিস, গ্লোবাল পাবলিক হেলথের জুনিয়র মেডেল (২০১৬), বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার সহ সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য স্যার ফজলে অসংখ্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনে উল্লেখিত বিশ্বের ৫০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের তালিকায় উঠে এসেছিল স্যার আবেদের নাম। এছাড়া বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় দারিদ্র বিমোচনের উপর বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যার ফজলে হাসান আবেদকে “অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জের নাইট কমান্ডার” নামক উপাধিতে ভূষিত করেন। 

এই ছবিটির মতোই স্যার আবেদ দরিদ্রদের একজন হয়ে ছিলেন তাদের মাঝে

স্যার ফজলে হাসান আবেদের বেড়ে ওঠা 

হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বানিয়াচাং নামক এলাকায় তিনি ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনাও ঘটে সেই হবিগঞ্জে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও দেশ ভাগের পরে কুমিল্লা জেলা স্কুলে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন এবং এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।  

১৮ বছর বয়সে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলেন। অন্য সবার থেকে একটুখানি ব্যতিক্রম কিছু একটা করার প্রয়াসে তিনি নেভাল আর্কিটেকচারে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু এই বিষয়ে পড়ে দেশের মানুষের জন্য অবদান রাখা কঠিন হবে বিবেচনা করে পরবর্তীতে লন্ডনের চার্টার্ড ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে যোগদান করেন এবং সেখান থেকে চার বছরের পেশাদার কোর্সটি শেষ করেন। এরপর শেল তেল সংস্থায় যোগদানের জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ফিরে আসেন এবং খুব দ্রুতই পদন্নোতি পেয়ে সেই সংস্থার অর্থ বিভাগের নেতৃত্ব দেন। 

তার কিছুদিন পরেই পাকিস্তানের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তৎকালীন পরিস্থিতি আবেদকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। স্যার আবেদ যুদ্ধকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় পেয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি দেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সংগ্রহ এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারের কাছে লবিং করার জন্য একশন বাংলাদেশ নামক একটি সংগঠন চালু করেছিলেন। 

ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা 

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হলে স্যার আবেদ তার লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরে এসে তিনি ভারত থেকে ফেরত আসা লাখো শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন। সেই সময় সাধারণ মানুষের দুর্দশা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে লন্ডনে ফ্ল্যাট বিক্রয় করা অর্থ দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী কোন কিছু একটা করতে হবে। আর সেই চিন্তা ভাবনা এবং প্রচেষ্টা থেকেই তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

বিল এবং মেলিন্ডা গেটসের সাথে স্যার আবেদ

তিনি তাঁর কাজ শুরু করার জন্য উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের সুল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল বেছে নিয়েছিলেন এবং এই কাজটি ১৯৭২ সালে ব্র্যাক নামে পরিচিত বেসরকারি সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন মূলক কাজ করা শুরু করে তখন ব্র্যাক শব্দটির একটি ব্যখ্যা দেয়া হয়েছিল, Brac- Bangladesh Rural Advancement Committee”। 

ব্র্যাকের প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে স্যার আবেদ সুনিশ্চিত করেছিলেন যাতে করে ব্র্যাক ভূমিহীন দরিদ্র বিশেষ করে মহিলাদের উন্নয়নের জন্য যেন আরো বেশি করে কাজ করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ, দক্ষতা, মানবাধিকার, কৃষি ও উদ্যোগের উন্নয়ন থেকে শুরু করে উন্নয়নের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বর্তমানে ব্র্যাক বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় কাজ করছে। এছাড়াও ব্র্যাক এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। আর এই স্বীকৃতি ব্র্যাকের কর্মচারী সংখ্যা এবং তাদের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা উভয় দিক থেকেই সমহিমা প্রকাশ করছে। 

২০০২ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার একটি মিটিং এ তৎকালীন আফগানিস্তান প্রধানমন্ত্রী ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে আফগানিস্তানের কম্যুনিটি ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব নেয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিল বিশ্বের অনেকগুলো দেশের প্রতিনিধি। এই অনুরোধে অন্য কেউ সাড়া না দিলেও স্যার ফজলে হাসান আবেদ হাত উঠিয়ে সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত।  

সেই ২০০২ সালেই ব্র্যাক আফগানিস্তানের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক একটি সংগঠন হয়ে যায়। এরপর থেকেই ব্র্যাক বিভিন্ন ভৌগলিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সাফল্যের সাথে নিজস্ব মডেলটিকে এশিয়া এবং আফ্রিকার মোট ১১টি দেশে প্রসারিত করেছে। 

পথ প্রদর্শক স্যার আবেদের স্বপ্ন

স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য স্বপ্ন দেখতেন, আবার একই সাথে তিনি নিজেকে ব্যক্তিগত ধন সম্পত্তির মোহ থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি চাইলেই তাঁর যোগ্যতা দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসবের কিছুই করেননি। শুধুমাত্র দরিদ্র মানুষের পাশে থাকাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ সম্পর্কে একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখন থেকেই আমি চিন্তা করেছিলাম যে নিজের জন্য কিছুই করব না”। 

আর সেই কথা রাখতেই হয়ত স্যার ফজলে হাসান আবেদের তেমন কোন বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি নেই। এমনকি তাঁর নিজের একটি বাড়িও নেই, তিনি থাকেন একটি ভাড়া করা ফ্লাটে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “যদি নিজের জন্য চিন্তা করতে শুরু করতাম তাহলে হয়ত আর সাধারণ গরীব মানুষদের জন্য চিন্তা করা সম্ভব হত না” 

এই স্বপ্ন দেখা মানুষটি দেশের সর্বস্তরে বহুল জনপ্রিয় একজন মানুষ। তিনি নারী পুরুষের সমতা, নারী এবং শিশু অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ভাবে কাজ করে গিয়েছেন। এইসব নারীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি প্রচুর পরিমাণ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। 

স্বপ্ন দ্রষ্টার মৃত্যু হলেও বেঁচে থাকবে তাঁর স্বপ্ন 

বেশ কিছু সময় ধরেই তিনি শারীরিক দুর্বলতার সাথে সাথে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাতেও ভুগছিলেন। আর তারই জের ধরে  চলতি বছরের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।  ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ রোজ শুক্রবার দিবাগত রাত ৮ঃ২৮ মিনিটে ঢাকায় অবস্থিত অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৩ বছর। দীর্ঘ কাল এবং বহু ইতিহাসের সাক্ষী স্যার ফজলে হাসান আবেদ মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে তারই প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ব্র্যাকের মাধ্যমে। 

লেখক- ইকবাল মাহমুদ ইকু

Exit mobile version