বিশ্ব

ইরানকে কেন শত্রু মনে করে সৌদি আরব?1 min read

জুন ২৯, ২০১৯ 3 min read

author:

ইরানকে কেন শত্রু মনে করে সৌদি আরব?1 min read

Reading Time: 3 minutes

সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যকার সাপে নেউলে সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। দুটি দেশই শক্তিশালী এবং ধর্মীয় দিক থেকে ভিন্ন মতাদর্শের। উভয় দেশ মুসলিম প্রধান হলেও ইরান শিয়া ও সৌদি আরব সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী। আবার জাতিগত ভিন্নতাও তাদের মধ্যে বিরাজমান। ইরানিরা পারস্য আর সৌদিরা আরব জাতি। আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারও ইরান ও সৌদির মধ্যকার বৈরি সম্পর্কের আরেকটি কারণ।

ইসলাম ধর্মের জন্ম হয়েছে সৌদি আরবে। সে হিসেবে সৌদি আরব নিজেদেরকে মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করে। আবার সৌদি আরবে রাজতন্ত্র বিদ্যমান। অপরদিকে ইরান প্রচন্ডরকমভাবে রাজতন্ত্র বিদ্বেষী। সেই সাথে ইরানও নিজেদের মুসলিম বিশ্বে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রকাশ করতে চায়।

২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাকের সে সময়কার জাদরেল প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হন। সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সুন্নী মুসলমান এবং ইরান বিদ্বেষী। তাই সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতাচ্যুতিতে ইরানের বড় ধরনের লাভ হয়। মূলত সেই সময় থেকেই ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।

২০১১ সালে আরব বসন্তের ফলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তৈরি হয় এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। সেই সময় সুযোগ সন্ধানী ইরান ও সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে নিজেদের অধিকার খাটানোর চেষ্টা করে। ফলে তাদের মধ্যে নতুন করে বৈরিতার জন্ম নেয়। ইরান এক্ষেত্রে বেশি ঈর্ষান্বিত হয়। কেননা তাদের স্বার্থটা এখানে বেশি। যদি এসব দেশকে নিজের কব্জায় নিয়ে আসতে পারে তবে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমগ্র এলাকা ইরানের নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।

সিরিয়া এখন পুরোপুরি ইরানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কারণ সিরিয়ার বাশার আল আসাদ ইরান ও রাশিয়া সমর্থিত রাষ্ট্র। তারা সৌদি আরবের বিদ্রোহী দলগুলোকে হারিয়ে দিয়েছে। এদিকে সৌদির আগ্রাসী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিবর্তে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরির চেষ্টা করছেন। এই সুযোগে ইরান সেই দেশগুলোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

সৌদি আরবের পক্ষে রয়েছে সূন্নী প্রধান দেশগুলো। যেমন— কুয়েত, বাহরাইন, মিশর, জর্ডান, আরব আমিরাত প্রভৃতি। অন্যদিকে ইরান সমর্থিত দেশগুলো হলো শিয়া ও মিলিশিয়া ভূখণ্ড ও সিরিয়া। বর্তমানে ইরাক ইরানের সাথে হাত মিলিয়েছে।

ইরানকে ঠেকাতে মরিয়া সৌদি আরব নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ-নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। নিমরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের সৌদি দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলা চালানো হলে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

সৌদি-ইরান রোষানলকে স্নায়ুযুদ্ধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ তারা সরাসরি যুদ্ধ না করলেও অন্য দেশে ঠিকই প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে। সিরিয়া ও ইয়েমেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। লেবাননেও যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তখন হয়ত সৌদি সমর্থিত ইসরায়েলও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

তবে যত যাই করুক না কেন ইরান ও সৌদি আরব কখনও সরাসরি যুদ্ধে নামতে পারবে না। কারণ তাদের অবস্থান উপসাগরের দুপাশে। আর এ উপসাগর দিয়ে তেল ও অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে যায়। যুদ্ধের কারণে যদি কোন ঝামেলা হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে না।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সবসময়ই ইরানকে হুমকি হিসেবে ভেবে এসেছে। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সৌদি আরবসহ পশ্চিমা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ। কিন্তু সৌদি আরবও থেমে নেই। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর প্রশাসন সৌদি আরবের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং সাহায্য বিক্রি করার অনুমতি প্রদান করেছে। সব মিলিয়ে কার মধ্যপ্রাচ্যে দিন দিন উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

সম্প্রতি ইরানের প্রভাব খানিকটা নমনীয় করার আশায় সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হয় আরব লীগ ও জিসিসি সম্মেলন। সৌদি আরবের ডাকা এ সম্মেলনে ঘোষিত প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করেছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ কাতার। গত ৩১ মে সৌদি আরবে ওআইসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বিশ্বের ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্র যোগদান করে। এ সম্মেলনের ঠিক একদিন আগে সৌদি বাদশাহ মোহাম্মদ বিন সালমান এক জরুরি সম্মেলনের ডাক দেন। সম্মেলনটি মূলত চিরশত্রু ইরানকে চাপে রাখার জন্য ডাকা হয়েছিল। সৌদি আরবের উদ্দেশ্য ছিল এরকম, সৌদির ডাকে ইরান-বিরোধী সম্মেলনে প্রায় সব মুসলিম প্রধান দেশ একত্র হয়েছে— তা ইরানকে বুঝানো। কিন্তু সৌদির সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে এবারের ওআইসি সম্মেলনে ইরানের কোন ইস্যু প্রাধান্য না পেয়ে বরং ফিলিস্তিনি সংকট নিয়ে জোড়ালো আলোচনা হয়েছে।

ইরান বৈরিতা অবসানের জন্য সৌদি আরবকে আহবান জানিয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব পাল্টা জবাবে বলেছে, যদি সত্যিই সম্পর্কের উন্নয়ন চায় তাহলে তেহরানকে অবশ্যই তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জাবের সম্প্রতি এক বার্তায় বলেছেন, সৌদি আরবও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। কিন্তু তেহরানকে হুশিয়ার করতে চায় যে রিয়াদ তার স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

আরও পড়ুন- ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস

আরও পড়ুন- ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতার শুরু যেভাবে

আরও পড়ুন-আমেরিকা-কিউবার সরল গরল সম্পর্ক

আরও পড়ুন- সৌদি-মার্কিন বন্ধুত্বের একাল সেকাল

আরও পড়ুন- ভিয়েতনাম যুদ্ধ- স্বাধীনতার লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *