ইতিহাস

রক্তস্নাত শ্রীলঙ্কা এবং উপমহাদেশের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ1 min read

অক্টোবর ১৪, ২০২০ 5 min read

author:

রক্তস্নাত শ্রীলঙ্কা এবং উপমহাদেশের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ1 min read

Reading Time: 5 minutes

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বৈশ্বিক মন্ডলে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি তিনি অবশ্যই মাহিন্দার রাজাপাকসে। আর তার পরেরজন কখনোই দেশটির প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। ছিলেন উগ্রপন্থী নেতা। নাম ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। উগ্রপন্থী তামিল এই নেতা নিজ অঞ্চলে ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। তার নেতৃত্বেই শ্রীলঙ্কায় চলেছিল উপমহাদেশের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ।

লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম

১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা বৃটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সে সময় শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার মাত্র ১৫% ছিল তামিল, ৭০-৭৫% ছিল সিংলিজ। এতে সরকারি চাকরি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে সিংহলিজদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালে সিংহলা ভাষাকে শ্রীলঙ্কার অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে অফিসিয়াল কাজে তামিল ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এসবের প্রেক্ষিতে ১৯৭০ এর দশকে অনেকগুলো সশস্ত্র তামিল দল গড়ে উঠে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ‘তামিল নিউ টাইগার্স’ তেমনই এক সংগঠন। মূলত তারা ছিল দ্বীপরাষ্ট্রটির উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।

তামিল ইলম রাজ্য থেকে উঠে আসা প্রভাকরণ প্রথম নিজ অঞ্চলের নেতা হন ১৯৭০ নাগাদ। প্রথম অবস্থায় এ সংগঠনটি তামিলদের প্রান্তিক নানা অবস্থার প্রতিবাদকারী একটি সংগঠনের মতো কাজ করলেও ১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ এটি ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম’ বা এলটিটিই নামে প্রতিষ্ঠা পায়। রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সামরিকভাবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন প্রভাকরণ।

এক সময় শ্রীলঙ্কার উত্তর দিকের অঞ্চল জাফনার মেয়রকে হত্যার অভিযোগ ওঠে তাদের উপর। খুব দ্রুতই তামিল টাইগাররা ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের বাহিনীতে পরিণত হয়। স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রভাকরণের সঙ্গে এত বেশি শ্রেণি পেশার মানুষ যুক্ত হয় যে, একপর্যায়ে সামরিক শাখাতেই বিভিন্ন উইং চালু করেন তিনি। শুরু হয় নৌ ও বিমান বাহিনীর কাজও। সেই সাথে নিজস্ব নীতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের বিরাট নেটওয়ার্ক ছিল তাদের।

তামিল টাইগাররা সর্বপ্রথম বড় আঘাত করে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে। যাকে এখনো শ্রীলঙ্কানরা বলে ‘ব্ল্যাক জুলাই’। ৮৩ সালের জুলাই মাসের ২৩ তারিখ তামিল সেনারা দেশটির উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায় সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর উপর আরেক নারকীয় তাণ্ডব চালায়। যার ফলে নিহত হয় তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। শুরু হয়ে যায় লঙ্কান গৃহযুদ্ধ। নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয় তামিলরা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম’ (এলটিটিই) নিজেদের আরো সংগঠিত করতে থাকে।

তামিল টাইগারদের কর্মপরিধি

এলটিটিই ছাড়া তামিলদের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে তামিল ইলম লিবারেশন অর্গানাইজেশন, দ্য পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অফ তামিল ইলম, দ্য ইলম পিপলস রেভ্যুলেশনারী লিবেরাল ফ্রন্ট উল্লেখযোগ্য। তবে সবগুলো সংগঠনের মাঝে অদম্য ছিলো ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের দলটিই।

প্রভাকরণ বাদবাকি দলের প্রধানদের সরিয়ে দিয়ে দক্ষ সেনাদের নিয়ে আসতেন নিজের দলে। এলটিটিই’কে তিনি দুই উইং দিয়ে পরিচালিত করতেন- রাজনৈতিক শাখা এবং সামরিক শাখা। নিজেদের দাবি করা ভূখন্ডে তামিলদের সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করাই ছিল এলটিটিই এর মূল কাজ। পুলিশ বাহিনী, আইন, প্রশাসন, রেডিও ও টিভি সম্প্রচারের কাজ করতো রাজনৈতিক শাখা। এছাড়াও তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার আলাদা কর্মকর্তা ছিলো।

আর সামরিক শাখা চলতো একেবারেই মূল শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর আদলে। কমিশন ও নন কমিশন র‍্যাঙ্ক অফিসারের মত ব্যবস্থাও ছিল তাদের। এলটিটিই’র নৌবাহিনী ছিল অত্যন্ত চৌকস। এমনকি অল্প কয়েকটি বিমান নিয়ে খুবই সীমিত পরিসরে তাদের বিমানবাহিনীও ছিল।

এলটিটিই এর সামরিক শাখা চলতো একেবারেই মূল শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর আদলে

প্রথম ইলম যুদ্ধ

শ্রীলঙ্কান তামিলদের মূল আবাস ভারতেই। ভারতের প্রায় ৭০ হাজার তামিলকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসে ব্রিটিশরাই। কিন্তু ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার সময় তাদের ব্যাপারে সুরাহা করেনি ব্রিটেন। শ্রীলঙ্কার নেতারাও তামিলদের নিতে আগ্রহী ছিলেন না। প্রায় ৭০ হাজার তামিল হয়ে পড়েন দেশছাড়া নাগরিক।

দীর্ঘ কয়েকদশক এজন্যই তামিলরা  সংগ্রাম করেছে। তাদের প্রথম হামলাও ছিল স্বাধীনতার প্রতি শ্রীলঙ্কা সরকারের নজর আনার জন্যে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত প্রথম ইলম যুদ্ধ ঘোষণা করেন প্রভাকরণ। কলম্বো সহ দেশের নানা প্রান্তে হামলা চালাতে শুরু করে তামিল বাহিনী। অতর্কিত আক্রমণসহ নানাবিধ কৌশলে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেয় তামিলরা। ১৯৮৬ সালে নিজেদের দাবী করা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তামিল টাইগাররা।

এই যুদ্ধের পরে ইন্দিরা গান্ধী শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিলেও প্রমাণিত হয় ভারতই তামিলদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। এই পর্যায়ে ভারত শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক অবনতি ঘটে। সাগরে ভারতীয় নৌকাকেও হেনস্তা করতে থাকে শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনী।

তামিল সমস্যা এবং ভারত

১৯৮৩-৮৭ সাল পর্যন্ত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তামিলদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুয়ায়ী এই বছর ভারতের সেনাবাহিনী শ্রীলঙ্কায় পা রাখে মধ্যস্থতা করার জন্যে। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বাধীনতা দাবি বিসর্জন আর অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানায় টাইগাররা। বরং এক পা এগিয়ে ভারতেই আক্রমণ করে বসে তারা। ১৯৮৩-৮৭ সালের এই যুদ্ধে নিহত হয় এক হাজার ভারতীয় সেনা। ভারত বুঝতে পারে তামিলদের বিপক্ষে যুদ্ধ অনেকটাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালে ভারত সরকার সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। অবশ্য এতে করে দায় মোচন হয়নি ভারতের। শ্রীলঙ্কা ২০১৩ সালে দেশটির ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের জন্য ভারতের সাবেক সরকারকে দায়ী করেছে।

এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হত্যার সাথেও মিশে আছে তামিল টাইগারের নাম। এছাড়াও ফিলিস্তিন এবং পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথেও যোগাযোগ ছিল তামিল টাইগারদের।

তামিল টাইগারদের দমাতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ভারতীয় সেনা

২য় ইলম যুদ্ধ

১৯৯০ সালের ১১ জুন। ভারত ফিরে যাবার পর প্রায় ৬ থেকে ৭’শত পুলিশকে একসাথে আটক করে তামিল টাইগাররা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের অঞ্চলে সরকারি প্রভাব কমানো। এরই মাধ্যমে শুরু হয় ২য় ইলম  যুদ্ধ। পুলিশ বাহিনী কোন প্রকার পাল্টা আক্রমণ না করেই আত্মসমর্পণ করে আর তামিল বাহিনীও তাদের ক্ষতি করবেনা বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে নিজেদের জঙ্গলে নেয়ার পরে নৃশংস এক ঘটনা ঘটায় তারা। এক এক করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে সব পুলিশকে। এক সপ্তাহ পর শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিজেরাই যুদ্ধ ঘোষণা করে।

শ্রীলঙ্কা তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলের সব রকম খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তামিলরা এর জবাবে সিংহলিজ আর মুসলিম গ্রামে হামলা চালায়। সরকার তার জবাব দেয় আরেক স্কুলে গণহত্যা ও গণকবর দেয়ার মাধ্যমে।

১৯৯১ এর জুলাই মাসে ৫০০০ তামিল টাইগারকে আটক করে সরকারি বাহিনী। তারা মূলত এলিফ্যান্ট পয়েন্ট পেরিয়ে নিজেদের এলাকা জাফনায় যাচ্ছিল। সেখানেই ১০ হাজার সেনা তাদের ঘিরে ফেলে। দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায় সে যুদ্ধে। তবে এতকিছুর পরেও সে সময় জাফনা দখলে নিতে পারেনি শ্রীলঙ্কা সরকার।

তৃতীয় ইলম যুদ্ধ

১৯৯৫ সালে নৌবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে শুরু হয় ‘তৃতীয় ইলম যুদ্ধ’। তবে সেবারই শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর কাছে জাফনার নিয়ন্ত্রণ হারায় তামিল টাইগাররা। বলে রাখা ভাল, এই মধ্যবর্তী সময়ে তামিলদের নৌবাহিনী প্রচন্ড শক্তিশালী হয়েছিল। সেই সাথে বেড়েছিল ব্ল্যাক টাইগারের দৌরাত্ম্য। ব্ল্যাক টাইগারের কাজ ছিল আত্মঘাতী হামলার। তৃতীয় ইলম যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা যুদ্ধ। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ। ১৯৯৬ সালে কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে শুরু করে অসংখ্য মেয়র, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে এলটিটিই বাহিনী। এভাবে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল পরিচালনা শুরু করেন প্রভাকরণ। টাইগারদের হামলায় আহত হন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। এরপর ২০০২ সালে নরওয়ের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হয়।

শান্তিচুক্তি অবসান, রাজাপাকসে এবং যুদ্ধের অবসান

২০০৪-২০০৫ সালে টাইগারদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার কর্নেল করুনা আমান প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধা নিয়ে এলটিটিই থেকে বেরিয়ে যান। এদিকে সন্দেহভাজন টাইগারদের হামলায় নিহত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামার। ২০০৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন কট্টর এলটিটিই বিরোধী নেতা মাহিন্দার রাজাপাকসে। শুরু হয় প্রভাকরণের প্রতি শেষ আক্রমণ।

২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে জেনেভায় শান্তি আলোচনায় কোন ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয় দুপক্ষ। ক্রমাগত আক্রমণ শানাতে থাকে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। আর তামিল বাহিনীও তাদের মনোবল হারাতে শুরু করে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মাঝে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। জাতিসংঘের প্রতিনিধি একে বলেছিলেন রক্তস্নান। সরকারি বাহিনী এগিয়ে আসা শুরু করলে নিজেদেরই শেষ করতে থাকে বেশ কিছু তামিল সেনা।

১৬ মে, ২০০৯। শ্রীলঙ্কার সরকার ঘোষণা করে তামিলদের সাথে দীর্ঘ বিরোধ ও যুদ্ধের অবসান হয়েছে। পরদিন তামিল টাইগাররা নিজেদের ওয়েবসাইটে স্বীকার করে, “একটি তিক্ত পরিণতি দিয়ে শেষ হয়েছে এই যুদ্ধ।”

তিক্ত সত্য কি তা জানা যায়নি সহসা। ১৮ মে জানা যায়, নিজের কথা রেখেছেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। তিনি বলতেন জীবিত থেকে কখনোই শ্রীলঙ্কার সরকারি বাহিনীর কাছে ধরা দেবেন না। ঠিকই আত্মহত্যার মাধ্যমে সরে গিয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে শেষ হয় প্রায় ২৬ বছর ধরে চলমান এক গৃহযুদ্ধ। যে গৃহযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ১ লাখ প্রাণ।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *