বিশ্ব

রবার্ট মুগাবেঃ স্বাধীনতার নায়ক হয়েও যিনি স্বৈরশাসক1 min read

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯ 3 min read

author:

রবার্ট মুগাবেঃ স্বাধীনতার নায়ক হয়েও যিনি স্বৈরশাসক1 min read

Reading Time: 3 minutes

১৯২৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা জিম্বাবুয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একজন কাণ্ডারি। গত ৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।

বলা চলে মুগাবের হাত ধরেই জিম্বাবুয়ে দেশটি শ্বেতাঙ্গ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। তবে শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে তিনি দেশবাসীদের উপহার দিয়েছিলেন, সেই স্বাধীনতা স্বাদ জিম্বাবুয়ের সাধারণ জনগণকে তিনি কখনই পুরোপুরি পেতে দেন নি। দীর্ঘ ৩৭টি বছর একটানা জিম্বাবুয়ে শাসন করার পর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ তিনি পদত্যাগ করেন। এই দীর্ঘ ৩৭টি বছর জিম্বাবুয়ের মানুষ কি সুশাসনে অন্দলিত হয়েছে নাকি দুঃশাসনের কারাগারে বন্দী ছিল? আসুন জেনে নেই স্বাধীনতার নায়ক কেন এবং কিভাবে ধীরে ধীরে স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। 

প্রথম জীবন 

তৎকালীন রোডেশিয়ার “শোনা” গোষ্ঠীর একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন মুগাবে। তার বাবা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। প্রাথমিক জীবনে তিনি পড়ালেখা করেছিলেন একটি ক্যাথোলিক মিশন স্কুলে। পড়ালেখা শেষ করে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন তিনি। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যান। এরপর ঘানায় বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা চালিয়ে গেলেও মুগাবে মূলত রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছিলেন। আর সেই সময়েই ঘানার নেতা কোয়ামের আদর্শ তাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। 

১৯৬০ সালে তিনি ফিরে যান তার স্বদেশ রোডেশিয়াতে। শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগদান করেন। সেখানে এক ভাষণে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে কুট মন্তব্য করার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর কোন ধরনের বিচার ছাড়াই তাকে দশ বছরের মত কারাবাস করতে হয়েছিল। এই কারাবাসের সময়ে তার একটি শিশু সন্তান মারা যায়। ভাগ্যের নির্মম  পরিহাস, কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিনি সন্তানের শেষকৃত্যেও যোগদান করতে পারেন নি।   

রাজনৈতিক উত্থান এবং জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা 

১৯৭৩ সালে কারাবাসরত অবস্থাতেই তিনি জানু নামক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং সেবছরই কারামুক্তি লাভ করেন। তখন ইতোমধ্যেই রোডেশিয়াতে শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোট বাঁধতে শুরু করেছে। তবে আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতাদের মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রভাবশালী এবং আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন রবার্ট মুগাবে। সেসময় লন্ডনে সফররত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, রোডেশিয়ার সমস্যা কেবলমাত্র বন্দুকের নল দ্বারাই সমাধান করা সম্ভব। 

তার নেতৃতে অনেক গেরিলা হামলা হয়েছিল রোডেশিয়াতে। তবে এই আগ্রাসী মনোভাব থাকার পরেও মুগাবে ছিলেন যে কোন ধরনের আলোচনায় দক্ষ। পরবর্তীতে বিভিন্ন সমালোচকরাও তার এই গুণটি নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। 

১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ের আকাশে স্বাধীনতার পায়রার আগমন হয়েছিল মুগাবের হাত ধরেই। তাই তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তবে তখন মুগাবে এবং তার প্রতিপক্ষ জাপু, উভয় দলের বিরুদ্ধেই ভয় ভীতি দেখিয়ে ভোট গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। মুগাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই অনেক শ্বেতাঙ্গরা দেশত্যাগ করা শুরু করেছিল। আর স্বাধীন রোডেশিয়াকে “জিম্বাবুয়ে” নামে নতুন নামকরণ করা হয়। 

স্বাধীনতার নায়ক থেকে স্বৈরশাসক 

একটি দেশের জাতীয় নেতা কীভাবে সেই দেশের স্বৈরশাসকে পরিণত হন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন মুগাবে। তিনি বর্তমান জিম্বাবুয়ে অর্থাৎ তৎকালীন রোডেশিয়া থেকে শ্বেতাঙ্গ দূর করেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কুশাসনের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের মানুষের অপছন্দের তালিকায় চলে আসেন। একটা সময় ছিল যখন জিম্বাবুয়ে থেকে আফ্রিকার অনেক অঞ্চলেই খাবার সরবরাহ করা হত। অথচ সেখানে মুগাবে’র দুর্নীতি এবং অস্থিতিশীল শাসনের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক ধ্বস নামে। রীতিমত বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ে থেকে মানুষ আশেপাশের দেশের আশ্রয় গ্রহণ করা শুরু করে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দেশের অবস্থা একদম শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশেরও উপরে। 

১৯৯২ সালে মুগাবে কোন ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করেই ভূমি দখলের নতুন নিয়ম তৈরি করেন। তার বক্তব্য ছিল, এইসব ভূমি মূলত আফ্রিকার মানুষের, এতদিন ধরে শ্বেতাঙ্গরা সেই ভূমি দখল করে থাকলেও এখন সময় চলে এসেছে সেই সব ভূমি নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসার। জিম্বাবুয়ের অনেক ভালো ভালো কৃষি জমি প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্বেতাঙ্গ কৃষকের কাছ থেকে জোর পূর্বক ছিনিয়ে নেয়া হয়। 

তিনি শ্বেতাঙ্গদের থেকে জমি দখলের পর সেই জমিগুলো প্রয়োজনীয় মানুষদের হাতে হস্তান্তর করেননি বরং তার পছন্দের কাছের মানুষদেরকে দিয়ে দিয়েছিলেন। দেশের কৃষিখাত অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে চলে যাওয়ার ফলাফল স্বরূপ এক কালে আফ্রিকার খাবারের ভাণ্ডার ধীরে ধীরে খাবার শূন্য অবস্থায় পরিণত হয়। 

রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি 

কৃষি খাত এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা খুব দ্রুতই জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ফলাফল স্বরূপ গোটা দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর সেই অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করলে ২০১৭ সালে জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে মুগাবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। 

মুগাবের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগের মধ্যে বিরোধী দল দমন ছিল অন্যতম। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি বিরোধী কোন ধরনের মতকে খুব একটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেননি বরং তাদেরকে তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ২০১৭ সালে রীতিমত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও এক অস্থিতিশীল দেশ তিনি পেছনে ছেড়ে আসেন, যে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোন ভিত্তিই নেই। 

ইতিহাসে সফলভাবে আন্দোলন করা অনেক মহানায়ককেই দেখা গেছে পরবর্তীতে তারা ভালো শাসক হিসেবে দেশ শাসন করতে পারেন নি। এমন নেতাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে মুগাবে থেকে যাবেন। তবে শাসক হিসেবে অসফল হলেও শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশ দূরীকরণের ক্ষেত্রে মুগাবের অবদান জিম্বাবুয়ের মানুষ ভুলতে পারবে না। 

লেখক- ইকবাল মাহমুদ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *