ইতিহাস

মোঘলাই খানার ইতিহাস1 min read

এপ্রিল ৮, ২০১৯ 3 min read

author:

মোঘলাই খানার ইতিহাস1 min read

Reading Time: 3 minutes

‘দীর্ঘ এলম বনস্পতির ছায়াতলে তন্বী জলধারা স্নিগ্ধ কলশব্দে প্রবাহিত।এই রমণীয় উপবনে ঘাসের উপর কার্পেট বিছিয়ে আহার হল। পোলাও মাংস ফল ও যথেষ্ট ঘোল।‘  -রবীন্দ্রনাথঠাকুর

উপরের উক্তিটি যখনকার তখন কবি গুরু পারস্যে ছিলেন। কবি মুখেই যখন নিদারুণ কথা সেখানে সামান্য বঙ্গসন্তান খাবার নিয়ে উৎফুল্ল হলে খুব একটা দোষের কিছু হবেনা।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে গেছেন, ‘ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি,  মুসলমানের হাঁড়ি।‘ এই উপমহাদেশের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে এই হাঁড়িতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব আছে ‘মোঘল’দের। আর কথায় তো আছেই, পড়েছি মোঘলের হাতে,  খানা খেতে হবে সাথে। সেই মোঘলদের এদেশে আগমন ১৩৯৮ সালে তৈমুর লংয়ের আক্রমণের হাত ধরে। তবে পাকাঘর প্রথম  বাঁধেন বাবর (১৫২৬-১৫৩০)। তখন থেকেই এই উপমহাদেশের পাকঘরে আসে নতুন রসনার রোশনাই। মোঘল খানার ইতিহাস ঘটনাবহুল ও সুবিস্তৃত। এরমধ্যে অল্প কিছুই তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

বিরিয়ানির কাহিনী

বিরিয়ানি কাজাকিস্তান থেকে তৈমুরলংয়ের সাথে সাথেই এসেছে। এ দাবি অনেকের। আবার শাহজাহান পত্নী মমতাজ মহলের নির্দেশে সেনা ছাউনির বাবুর্চিরা সৈনিকদের সুষম আহারের তাগিদে আবিষ্কার করেছেন বিরিয়ানি,  এমনটাও শোনা যায়। এককভাবে বিরিয়ানি আবিষ্কর্তা হিসেবে কারো নাম না থাকলেও এই উপমহাদেশে এর আগমন যে মোঘলদের হাতেই সেটা সত্যি। আর কাচ্চির মূল রেসিপিটা এসেছে তুর্কিদের কাছ থেকে। এই খাবারে তারা লবঙ্গ, হিং, মাখন,  গোলমরিচ, এলাচ ও স্থানীয় মসলার সংমিশ্রণ ঘটাত।

পোলাও আবিষ্কারে মোঘলদের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও সুক্ষ্মতার দাবিদার তারাই। তবে সম্রাটদের তুলনায় নবাবদের রসনা পূরণে বাবুর্চিরা নতুন নতুন পোলাও রান্না করার চেষ্টা করতেন। একজন বানিয়েছিলেন আনারদানা পোলাও,  আরেকজন নবরতন পোলাও- যা কিনা ন’টা রঙের চাল দিয়ে তৈরি।

বিরিয়ানির মূল স্বাদ আসে মোঘলদের হাত ধরেই;
Image Source: Pexels

তবে মোঘলদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি এবং প্রথম এই ভারতকে ভালোবেসেছিলেন আকবর। তাঁর আইন-ই-আকবরিতে পাওয়া যায় জর্দা বিরিঞ্জে রান্নার রেসিপিও। সে অনুসারে ‘১০সের চাউল, ৫ সের মিছরি, ৩.৫ সের ঘি, কিসমিস, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম (আধ সের করে), একপো লবন, আধপো আদা, জাফরান, দারুচিনি। মোটামুটি চারজনের খাবার হবে এতে, কেউ কেউ এতে মাংসও দিয়ে থাকেন।‘

লা জওয়াব কাবাব

তুর্কি সৈন্যরা ধারালো তলোয়ারে মাংস গেঁথে পুড়িয়ে খেত মাংস। ক্রমে সেই জায়গা নিলো লোহার তার। সেই সময়ে পশ্চিম এশিয়ায় কাঠ কম থাকায় মাংস রান্নার চাইতে ঝলসে নেয়াই ছিল সুবিধা জনক। ক্রমে এর সাথে যুক্ত হলো নানান মশলা,  কেওড়া জল, কস্তুরি, শুকনো ফল, পোস্ত। ১৪ শতকে ইবনেব তুতাও সুলতানি আমলে ভারতের দিল্লির শাহি বাবুর্চিখানায় কাবাব তৈরি হতে দেখেছেন।

সুলতান ও মোগল রাজ দরবারে রাজকীয় অতিথিদের জন্য কাবাব পরিবেশন ছিল অত্যাবশ্যক। শিক কাবার, শামি কাবাব , কাকোরি কাবাব, চাপলি কাবাব, টুন্ডা কাবাব, কাঠি কাবাব, রেশমি কাবাব, টিক্কা কাবাব, কলমি কাবাব, টিকেন মালাই কাবাব, হাণ্ডি কাবাব, চিংড়ির রামপুরি কাবাব, চেলো কাবাব ইত্যাদি সে সময়েরই সৃষ্টি।

শিককাবাব এসেছে শিশকাবাব থেকে;
Image Source: R
rannaghar.com

কম নয় খিচুড়িও

আকবর পুত্র চতুর্থ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর বেশির ভাগ সময় কাটাতেন পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে। ফলে তাঁর আমলে রসুই  ঘরে ছিল এই দুই অঞ্চলের প্রভাব। তবে তিনি ‘লাজিজাহ’ নামক এক ধরণের খিচুড়ি খেতেন যা জোয়ার, ডাল,  চাল দিয়ে গুজরাটি কৌশলে রান্না করা হতো।

রুটিতে রুচি

সম্রাট বাবর উপমহাদেশে ঘাঁটি গাড়লেও মোটেও খুশিছিলেন না এখানকার স্থানীয় খাবারে, ‘একটাও ভালো খাবার নাই,  মাংস আঙুর তরমুজ খরমুজ কিসসুনা। কোন বরফ নাই, ঠাণ্ডা পানি নাই, বাজারে রুটি নাই।‘  অথচ মোঘলদের আগেই ভারতীয় উপমহাদেশে নান রুটি প্রচলিত ছিল। তবে উর্দু গদ্যনির্মাতা আবদুল হালিম শরর তাঁর ‘গুজিশতা লখনউ’ বইয়ে লেখেন, ‘ইরান থেকে মুসলমানরা ভারতে এসেছিলেন খামিরি রুটি খেতে আর তন্দুর স্থাপন করতে। তখন অবশ্য তাঁরা রুটিতে ঘি লাগাতেন না। ভারতীয়দের ঘি ও তেলে ভাজা পুরি দেখে মুসলমানরা তাওয়ার রুটিতে ঘিয়ের প্রলেপ লাগিয়ে পরাঠা বা পরোটা তৈরি করতে শেখে। ‘১৬ শতকের মাঝামাঝি সময়ের প্রভাবে পুরনো দিল্লির চাঁদনিচক এলাকায় একটা সরু গলির নামই হয়েছে ‘পরাঠে ওয়ালে গলি’।

কাবাব, কিমা প্রভৃতির সাথে নানান রুটিই ছিল প্রধান খাবার। সম্রাট, নবাবদের বাবুর্চির শিল্পিত হাতে পড়ে শিরমাল, লাচ্ছা, পরোটা, নান-ই-জওয়ান, বাকরখানি প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। আর মোগলাই পরোটাতো সুবিখ্যাত।

ইতিহাসে নেহারি

নেহারি ফারসি শব্দ, এর অর্থ সকাল। মোঘল আমলে লখনৌর সুই ঘরে নেহারির শুরু। কথিত আছে, মোঘল শ্রমিকদের নির্মাণ কাজে পারিশ্রমিক ছাড়া সকালে কাজের আগে নেহারি খাওয়ানো হতো। ফলে দুপুর অব্দি তাদের শরীরে ক্ষুধা ও শক্তির ঘাটতি হতোনা।

মিঠে মুখ

হালুয়া আরব থেকে ইরান হয়ে এসেছে ভারতে। এর সাথে দরবেশ, খুরমা, নুক্তি, গুলাবজামুন, বালুশাহি, জিলাপিও এই আমলে এসেছে এই দেশে। ফিরনির আবিষ্কারও মোঘল আমলের কাশ্মীর থেকে। বরফির মতো শাহি টুকরা ও বাদশাহিখানার আগমন নিয়েও কোন দ্বিমত নেই।

বাড়তি কথা

মোঘল বাদশাদের খাবারের জন্য প্রস্তুতি চলতো বহু আগ থেকেই। তাঁদের জন্য ছাগল-ভেড়া-মুরগিকে বিশেষ খাবার দেয়া হতো যার মধ্যে ছিল সুগন্ধিগুল্ম, চিনির সাথে মিশ্রিত জাফরানগুলি, মুক্তোর গুঁড়ো। ফলে এদের মাংসে অন্যরকম এক সৌরভ তৈরি হতো। এছাড়াও তাঁদের খাবারে ব্যবহার হতো হিং, জাফরান, পেস্তা, মৌরি, নানা রকম মশলা।

লেখক- Sarah Tamanna

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *