অর্থনীতি বাংলাদেশ

মানি লন্ডারিংঃ যে কারণে উন্নয়ন সবার হয় না1 min read

নভেম্বর ২২, ২০১৯ 5 min read

author:

মানি লন্ডারিংঃ যে কারণে উন্নয়ন সবার হয় না1 min read

Reading Time: 5 minutes

উন্নয়ন সুষম হচ্ছে না এটা কোন নতুন খবর নয়। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অনেক টাকা জমে যাচ্ছে এটাও নতুন খবর না। এই অতি ধনী লোকরা তাদের সম্পদের একটা অংশ বিদেশ পাচার করে দিচ্ছে – এটিও এখন আর নতুন কোনো খবর নয়৷ এমন প্রেক্ষাপটে বরং কোথায় কত টাকা কীভাবে পাচার হচ্ছে সেটা জানতে পারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা আজ আপনাদের সাথে নিয়ে সেটাই জানার চেষ্টা করবো। 

মানি লন্ডারিং কি? কিভাবে হয়?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানি লন্ডারিং বলতে অবৈধ এবং অনৈতিক উপায়ে অর্জিত সম্পদকে কৌশলে বৈধ আয়ে পরিণত করার পদ্ধতিই মানি লন্ডারিং। অনেকে আবার বৈধ করার চেয়ে বৈধ এবং অবৈধ রাস্তায় আয়কৃত সম্পদ বিদেশে পাচারের চেষ্টা করেন। সেটাকে মুদ্রা পাচার হিসেবে ধরা যায়।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে পায় সেটির প্রায় তিনগুণ টাকা পাচার হয়েছে ২০১৫ সালে। ই এক বছরের পাচার করা টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল নির্মাণের মতো দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর মেট্রোরেল প্রকল্পের খরচ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৫ শতাংশ এবং একই সময়ে বাংলাদেশের পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৩৪০ শতাংশের সমান৷

২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ দেশের সেসময়কার শিক্ষা বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি, আর স্বাস্থ্য বাজেটের তুলনায় বেশি ৮ দশমিক ২ গুণ৷ পাচার হওয়া ওই অর্থের ২৫ শতাংশ হারে যদি কর পাওয়া যেত, তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ এবং শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো৷

কিন্তু এভাবে টাকা পাচার বাড়লে ক্ষতি একাধিক৷ প্রথমত, অর্থ পাচার প্রয়োজনীয় সম্পদকে দেশ থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে দেয় যা কিনা দেশে বিনিয়োগ হতে পারত৷ দ্বিতীয়ত, এই প্রবণতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে৷ তৃতীয়ত, এটি সমাজের বৈষম্যকে প্রকটভাবে তুলে ধরে৷ আর এসব কিছুই টেকসই ও সুসম উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে৷ সে কারণেই পাচার পুরোপুরি রোধ না করা গেলেও কমিয়ে আনা জরুরি৷ আর সুশাসনের মাধ্যমে তা করা সম্ভব৷

বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করা হয়।  আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্রধান কৌশল গুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছি-

ওভার ইনভয়সিং-আন্ডার ইনভয়সিং

আমদানি-রপ্তানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বেশি টাকা পাচার হয়। আবার প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশে আসে না। বিদেশেই থেকে যায়। আইনের ফাঁকের কারণেই টাকা পাচার হয়। 

অনেক সময় রেমিট্যান্স দেশে ঢোকে না। ওখানে পেমেন্ট হয়, আর হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পরিশোধ করা হয়। দেশে আর টাকাটা ঢোকে না। 

আবার ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও টাকা পাচার করা হয়। যেমন বলা যেতে পারে আমি হয়তো ইমপোর্ট করবো, সেখানে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকাটা বিদেশে পাঠিয়ে দিলাম। আসলে সেটার মূল্য তত না। আমি ১০০ ডলার ওভার ইনভয়েস করলাম, জিনিসটা আসলে ৫০ ডলারের। সে ক্ষেত্রে বিদেশের পার্টির কাছ থেকে আমি ৫০ ডলার নিয়ে নিতে পারব। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং হয়। হয়তো ১০০ ডলার পেতাম, ৫০ ডলার এখন দিচ্ছে, আবার আমি বিদেশে গেলে আরও ৫০ ডলার দিচ্ছে। 

যেমন, ২০১৪ সালের মার্চে সাড়ে ৫৪ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা একটি রেকর্ড৷ এ সময়ে কেবল পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৭৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি৷ আবার এ সময়ে ফ্রান্স থেকে কেবল ক্রেন (পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্র) আনা হয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের৷ পুঁজি যন্ত্রপাতি হিসেবে এর শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ৷ ২০১৫ সালেও পুঁজি যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানো হয়েছে৷

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার৷ অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি  প্রায় ৫০০ ডলার৷

বিদেশি নিয়োগের নামে পাচার 

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় দুই লাখ বিদেশি। এর বাইরে ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন খাতে এ দেশে বিদেশি অবস্থান করছেন প্রায় ১২ লাখ। বাংলাদেশে এসে ব্যবসার কথা বলে বিভিন্নভাবে টাকা পাচারের অভিনব ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন তারা। দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিদের বেতন, ফি বাবদ প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেলেও ওয়ার্ক পারমিট বা অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন মাত্র কয়েক হাজার ব্যক্তি। অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নেওয়া অর্থের বিষয়ে তথ্য থাকলেও এর বাইরে যেসব অর্থ যাচ্ছে এর কোনো হদিস নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যে পরিমাণ অর্থ বিদেশি নাগরিকরা নিয়ে যান, বাংলাদেশে এর চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে আসে।

বাংলাদেশে বিদেশিদের উচ্চ বেতনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগকৃত এসব বিদেশির বাংলাদেশের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়ার্ক পারমিট নেয়ার নিয়ম থাকলেও তা না নিয়েই কাজ করছেন তারা। আবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এ দেশে গত পাঁচ বছরে আসা বিদেশিদের কেউই ফিরে যাননি। যারা একবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন, তারা আর কখনোই নবায়ন করেননি।

দেশের গার্মেন্ট কোম্পানিগুলোতে ১৮ থেকে ২০ হাজারের মতো বিদেশি কর্মরত আছেন। এই খাতে বিদেশিরা মোট কত টাকা উপার্জন করছে এর কোনো হিসাবই নেই। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কাজের অনুমতিপ্রাপ্ত মাত্র কয়েকশ ব্যক্তি রয়েছেন গার্মেন্ট শিল্পগুলোতে। এসব বিদেশি একবার বাংলাদেশে এসে যেন সোনার খনি পেয়ে আর ফিরে যান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশিদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে অনুমতি নিয়ে এ দেশে কাজ করছেন মাত্র ৫০০ জনের মতো। কিন্তু বাস্তবে আছে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি।

সেকেন্ড হোমের নামে পাচার 

দুই হাজার ৩৭০ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়েছেন। এ সুবিধা পেতে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে মোটা অঙ্কের অর্থ জমা রাখতে হয়েছে। এরপরও এই সুযোগ গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বয়স ৫০ বছরের নিচে এমন কোনো ব্যক্তির এ সুবিধা নিতে লাগছে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি টাকার বেশি। বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে সাড়ে তিন লাখ রিঙ্গিত বা ৮০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত এক অনুসন্ধানে দেখেছে, এসব অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছেন সুবিধা গ্রহণকারীরা। এর বাইরেও কোটি কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় পাচার করে নিয়ে গেছেন তারা। এ কারণে গত কয়েক বছরে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণের দিক দিয়ে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশিরা রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশের ঠিক আগে রয়েছে চীন।

কতো টাকা পাচার হয়েছে? কারা পাচার করছে?

বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ বা কত টাকা পাচার হচ্ছে, তার খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য-পরিসংখ্যান মেলে না৷ যেটুকু মেলে, তা মোটামুটি একটা ধারণা দেয়৷ লন্ডনভিত্তিক ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক ২০১৩ সালে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ সেটা থেকে প্রথম জানা যায় যে, বাংলাদেশ থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে (১৯৭৬-২০১০) ২৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৪৭০ কোটি ডলার টাকা পাচার হয়েছে৷ সম্ভবত সেটা ছিল টাকা পাচার নিয়ে বড় ধরনের কোনো তথ্য প্রকাশ৷ এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে টাকা পাচার বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, যার সবই মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য৷ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারীর সংখ্যা বা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে (যা সুইস ব্যাংক নামে বেশি পরিচিত) বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ টাকা পাচারের বিষয়টি সমর্থন করে৷

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি’র ২০১৫ সালের  এক রিপোর্ট বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা! প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা৷

সূত্র- জিএফআই এর ২০১৫ সালের – Illicit Financial Flows to and from Developing Countries: 2005-2014 শীর্ষক প্রতিবেদন

জিএফআই-এর প্রতিবেদন মতে, ২০০৪ সালে পাচার হয় ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার৷ এরপর ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার৷ ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে৷

সর্বশেষ জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) জানাচ্ছে বাংলাদেশে বছরে যত টাকা কর আদায় হয়, তার ৩৬ শতাংশের সমান টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়।

উত্তরণের উপায়

বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে ব্যাপক অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে৷ অবৈধ আয়ের সুযোগ বন্ধ না করে অর্থ পাচার বন্ধ করা কঠিন৷ অর্থ পাচার বেআইনি৷ মানি লন্ডারিং আইনে তা ধরে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে৷ আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের তথ্য জানতে সরকারি পর্যায়ে চুক্তি করতে হবে৷ আর তা না করা গেলে বাংলাদেশ বিপূল পরিমান অর্থ হারাবে৷ ট্যাক্স হারাবে৷ বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে৷

পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ- বাংলা ইনফোটিউবের এই বিশ্লেষণ বিভিন্ন সংস্থা এবং জাতীয় দৈনিকের বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে তৈরী। এটি সেই অর্থে কোন মৌলিক বিশ্লেষণ নয়। এটি কোন পূর্বাভাস বা ভবিষ্যত বাণীও নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *