Site icon Bangla Info Tube

নাথুরাম গডসে কেন মহাত্মা গান্ধীকে কেন হত্যা করেছিল?

নাথুরাম গডসে কেন মহাত্মা গান্ধীকে কেন হত্যা করেছিল?

Reading Time: 3 minutes

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন। লোকমুখে তিনি ‘বাপু’ নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন ভারত ছাড়, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মতো অহিংস আন্দোলনের কান্ডারি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অতুলনীয় অবদান এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনের কারণে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে দিয়েছিলেন “মহাত্মা” উপাধি।

১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের পোরবন্দর রাজ্যে (বর্তমান গুজরাট) এক বেনিয়া হিন্দু পরিবারে মহাত্মা গান্ধীর জন্ম। আশ্চর্যের বিষয় হলো স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা করার পরেও মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুটা সাধারণ ছিলনা। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী নতুন দিল্লির সুবৃহৎ প্রাসাদ বিড়লা হাউসের প্রাঙ্গনে হত্যা করা হয় তাকে। গান্ধীকে হত্যা করার পর ঘাতক নাথুরাম গডসে সেখান থেকে পালানোর কোন চেষ্টাই করেনি। গডসে চেয়েছিল তার এই জঘন্যতম হত্যার কথা সারা দেশবাসী যেন জানতে পারে।

৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮

নাথুরাম গডসে ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একজন প্রাক্তন সদস্য। উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন আরএসএস ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বাসনা নিয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ তাদের সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দেয়। দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ধারণা ছিল গান্ধী ভারতের মুসলিমদের খুশি করতে হিন্দুদের নানা ভাবে প্রতারিত করতেন। এরকম হিন্দুবাদী চিন্তা থেকে ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন গডসে।

৩০শে জানুয়ারী ৫টার কিছু পরে গান্ধী বিড়লা হাউজের পিছনের দিকে লনে যাওয়ার সিঁড়ির মাথায় পৌঁছালেন। সেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সর্ব ধর্মের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করতেন। যেইমাত্র গান্ধী বেদির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, গডসে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীর পথ রোধ করেন এবং পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গান্ধীর বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি নিক্ষেপ করে।

জনতা গডসেকে ধরে ফেলে এবং পুলিশের হাতে সমর্পণ করে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লায়  শুরু হয় গান্ধী হত্যার বিচার । প্রধান আসামী গডসে এবং তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তে। একই সঙ্গে সহ-আসামি হিসাবে আরও ছয় জনের বিচার শুরু হয়েছিল। গান্ধীর হত্যাকাণ্ড রোধে গাফিলতি ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর। নিজেদের দোষ গাঢাকার জন্যই তদন্ত এড়িয়ে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল। ১৯৪৯ সালের ৮ই নভেম্বর গডসে এবং আপ্তেকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করে রায় দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর আম্বালা কারাগারে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।

মহাত্মা গান্ধীর ঘাতক নাথুরাম গডসে

হত্যাকান্ড নিয়ে গডসের জবানবন্দি

নাথুরাম গডসে কেন গান্ধীকে হত্যা করেছিল তার অনেকগুলো কারণ সে নিজে আদালতে স্বীকার করে। তবে ধারণা করা হয় তবে সেই সময় কংগ্রেস সরকার এই সমস্ত কারণগুলি প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। নাথুরামের দাদা গোপাল গডসের দীর্ঘতম আইনি লড়াইয়ের পর তা প্রকাশ পায়। নাথুরাম উগ্র হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল যেটা তার জবানবন্দিতেও প্রকাশ পায়। আদালতে দাঁড়িয়ে গান্ধীকে “পাকিস্তানের পিতা” বলেও আখ্যায়িত করেছিল নাথুরাম। নাথুরাম যে দৃষ্টিতে গান্ধীকে দেখতেন তার কিছুটা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি-

১. ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা জেনারেল ডায়ারের শাস্তি চেয়েছিল ভারতীয় জনতা। কিন্তু গান্ধী সেই দাবি খারিজ করেন।

২. বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের ফাঁসি আটকানোর জন্য গান্ধীর গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আশা করেছিল ভারতবাসী। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিলেন গান্ধী নিজেই। বরং গান্ধী ভগৎ সিং এবং সুখদেবকে পথ ভ্রষ্ট বিপ্লবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আরো বলেন, “তারা সন্ত্রাসবাদী, তাদের ফাঁসি তিনি আটকাবেন না।”

৩. ১৯৪৬ সালের ৬ মে, দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিদ্যমান। গান্ধী হিন্দুদের আদেশ করেন, তারা যেন মুসলিম লিগের লোকের বিরুদ্ধে কোনরকমের পদক্ষেপ না নেয়। সেই সময় মুসলিম লীগের লোকেরা কেরালায় প্রায় ১৫০০ হিন্দুকে হত্যা করেছিল। এছাড়া আরও ২০০০ হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়।

৪. কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে কাশ্মীর ছেড়ে দিতে বলেন গান্ধী। কারণ কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।

৫. ভারতের মহান যোদ্ধা শিবাজী মহারাজ, রানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে পথ ভ্রষ্ট ভারতীয় বলে সম্বোধন করছিলেন গান্ধী ।

৬. ত্রিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধী নিজের ক্ষমতা বলে নিজের অনুগত পট্টভি সিতারামাইয়াকে কংগ্রেসের সভাপতি করেন।

৭. ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট কংগ্রেস সরকার ঠিক করে যে তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। দেশভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন গান্ধী। তিনি বলেছিলেন, দেশ ভাগ হলে তাঁর লাশের উপর হবে। কিন্তু তিনি তাঁর কথায় অটল থাকতে পারেননি। যে সভায় এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে সেই সভাতে গান্ধী একদম শেষ সময়ে পৌঁছান এবং দেশভাগের বিষয়টিকে তিনি সমর্থন করেন।

৮. ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সর্দার প্যাটেল প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলন। কিন্তু গান্ধীর নির্দেশে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

৯. ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা করলে গান্ধী আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই অনশনে বসেন। এর ফলস্বরূপ ভারত সরকার পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।

পৃথিবীর অধিকাংশ মহৎ ব্যক্তিদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলনা। গান্ধীজির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর হত্যা ভারতের রাজনীতিতে এক ট্র‍্যাজেডির শুরু। পরবর্তীতে যার শিকার হন ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধী। ভারত স্বাধীনতার পুরোধা এই ব্যক্তিত্ব মৃত্যুকেও যেন দিয়ে গেলেন অন্য রকম চিত্রনাট্য।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম 

Exit mobile version