বিনোদন

মমতাজ –সুরের এক অনন্য সম্রাজ্ঞী1 min read

জুলাই ১৯, ২০১৯ 4 min read

author:

মমতাজ –সুরের এক অনন্য সম্রাজ্ঞী1 min read

Reading Time: 4 minutes

বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া।

রঙ্গ কইরা হাঁইটা যায়,

ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।‘ 

এমন বিচ্ছেদের কথা সহজ ভাষায়, প্রাণবন্ত সুরে গাওয়াটা খুব সোজা কাজ না। তারচেয়েও অভাবনীয়, কঠিন হলো শহর গ্রামের সববয়সী, সব ধরনের মানুষের মন জিতে নেয়া। সেই কাজটাই আশৈশব করে আসছেন মমতাজ বেগম, সবার কাছে যার পরিচয়ফোক সম্রাজ্ঞী 

চার বছরেই মাত

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইড়ে আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে জন্মগ্রহণ করেন মমতাজ। মা উজালা বেগম ছিলেন গৃহিণী এবং বাবা মধু বয়াতি ছিলেন গায়ক। ১৯৭৪ সালের মে জন্ম নেয়া এই গায়ক তনয়া শৈশবে সুর লয়ের ছোঁয়া পেলেও খুব একটা সরল ছিল না পথ। মাত্র চার বছর বয়সেই বাবা মধু বয়াতি খেয়াল করেন সঠিক দিকনির্দেশনা পেলেই কন্যা হয়ে উঠবে গানের মানুষ। ফলে তাঁর কাছেই প্রথম হয়েছিল গানের হাতেখড়ি। শুরুর দিকে বাবার সাথে বিভিন্ন গ্রাম্যমেলা, আসরে ঘুরে বেড়ালেও কিছুদিনের মধ্যেই এক মঞ্চে গাওয়াটা শুরু হয়ে যায়। সাথে ছিল আরও দুই ভাই। বিচ্ছদের গানেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন তখন।

গ্রামীণ রমণীর ভঙ্গিমা কিংবা কোমল স্বরকোনটাই কিন্তু মূলধন ছিলনা মমতাজের। সেকারণেই বোধহয় আর সবার থেকে দ্রুতই আলাদা করা যেতো তাঁকে। অল্প সময়ের ভেতরেই নানান আসরে ডাক পড়তে থাকে তাঁর। সেই ছোটকালেই গান গেয়ে প্রথম আয় করেন মমতাজ। তবে বাবার ইচ্ছেতেই পালাগানের জন্য মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের কাছ থেকেও তালিম নিতে থাকেন। লোকগীতির নানান শাখা যেমনলালন, ভাটিয়ালি,মারফতি, মুর্শিদি, বৈঠকি, প্রভৃতির প্রায় সব শাখাতেই অবাধ বিচরণ হতে থাকে মমতাজের। পরবর্তীতে রশিদ শিকদারের কাছেও গান শিখেন তিনি। 

শিকড়ে উর্বর মাটি ছিল বলেই মমতাজ দ্রুত হয়ে উঠলেন আসরের মধ্যমণি। তবে নজরে আসার পেছনে ছিল মজার ছোট গল্প। পালাগানের এক অনুষ্ঠানে গুরু মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান অসুস্থ থাকায় তাঁর স্থানে মঞ্চে ওঠেন ১২ বছরের কিশোরী মমতাজ। তখন থেকেই শ্রোতাদের নজরে আসেন তিনি।  কিন্তু শুধু আসর ঘুরে গাইবার কথাই ভাবেননি তিনি। তরুণ বয়সেই নিজ উদ্যোগে গানের এ্যালবাম বের করার কথা ভাবেন। 

সচ্ছলতার মুখ না দেখা পরিবারে গানই ছিল আয়ের প্রধান উৎস। এর মাঝে মমতাজের এমন সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন ছিল। একেবারে নতুন শিল্পীর গান এ্যালবামে আসায় কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। জনি ইলেকট্রনিকস নামক এক সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানই প্রথম আগ্রহ দেখায় এবং এ্যালবাম প্রকাশ করে। ক্রমে গ্রামগঞ্জে, দোকান পাটে জনপ্রিয় হতে থাকে তার এ্যালবামের গানগুলো। ফের ডাক পড়ে রেকর্ডিং এর জন্য। আগের এ্যালবামগুলোর জন্য লভ্যাংশ না পেলেও নতুনগুলোর জন্য আয় করতে থাকেন। তবে দ্বিতীয় এ্যালবাম রেকর্ডিয়ে প্রথম ২০০০ টাকা পান তিনি। 

জনপ্রিয়তার শুরু

মাঠেঘাটে, পল্লীতে ব্যাপক আলোচিত হলেও শহর জয় দূরেই ছিল মমতাজের। সেই সুযোগ আসে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠানইত্যাদি হানিফ সংকেতের হাত ধরে। গীতিকার রফিকুজ্জামানের লেখারিটার্ন টিকিটগানের মাধ্যমে দেশেবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে নামডাক। 

মমতাজের একটি গানের এ্যালবামের পোস্টার; Photo source: Youtube

চলচ্চিত্রের মমতাজ

পর্যন্ত ৮০০ এরও বেশি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে মমতাজের। এর ফলাফলগিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস উঠেছে তাঁর নাম। সারা বাংলাদেশে তাঁর মতো জনপ্রিয়তার অধিকারী কেউ নেই বললেই চলে।বুকটা ফাইট্যা যায়’, ‘নান্টু ঘটক’, ‘খায়রুন লো’, ‘মরার কোকিলে’, ‘আমার ঘরে নাকি চান্দ এসেছে’, ‘ বান্ধিলাম পিরিতের ঘরসহ অসংখ্য গান পেয়েছে তীব্র জনপ্রিয়তা। 

চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন মমতাজ; Image Credit: Youtube

তবে এক বিরল প্রাপ্তিও আছে তাঁর ঝুলিতে। কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীর সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করেনমমতাজনামক একটি চলচ্চিত্রে। উত্তম আকাশ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৫ সালে। 

রাজনীতির ময়দানেও বিচরণ

শখের বশে নয়, জনগণকে ভালোবেসেই রাজনীতির মাঠে নামেন মমতাজ। ২০০৯ সালে প্রথমবার সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আবার ২০১৪ সালেও মানিকগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। 

জনসেবাতেও আগ্রগামী মমতাজ; Image Credit: Facebook

তবে শুধু সংসদ পর্যন্ত গিয়েই থেমে থাকেননি তিনি। পিতার কথা মাথায় রেখেইমমতাজ চক্ষু হাসপাতালনির্মাণ করেছেন, নিয়মিত জনহিতকর কাজেও আছেন সম্পৃক্ত। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জেওশিশু চক্ষু হাসপাতালগড়েন তিনি। পাশপাশি বাংলাদেশে প্রথম লোকগীতির জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েও এগিয়ে যাচ্ছেন।  

এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী 

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লোকমুখে তুমুল জনপ্রিয় সুরের এই বিস্ময় কন্যা। তবে যারা মনে করতেন, মমতাজ শুধু এককালে দর্শকনন্দিত ছিলেন, ফুরিয়ে যেতে পারেন সময়ের সাথে; তাদের বেশ শক্ত জবাবও দিয়েছেন। প্রিতম হাসানের সাথে ২০১৬ সালে প্রকাশ পায়লোকাল বাসগানটি। গানচিল মিউজিকের ব্যানারে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এই গানটি এখন অব্দি ইউটিউবে দেখা হয়েছে ,৯৫,০০,০০০ বারেরও বেশি। ২০১৭ সালেও চিরকুটের সাথে একটি ছবির সঙ্গিতায়োজনে ছিলেন তিনি।

‘বন্ধু তুই লোকাল বাস’ গানটি এখন মুখে মুখে; Image Credit: Gaanchil Music

নতুন প্রজন্মের সাথেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে ক্রমান্বয়ে নতুনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৯ সালের এপ্রিলেও এক স্থানীয় অনুষ্ঠানে র‍্যাপ গেয়ে বিস্মিত করেন ভক্তকুলকে। 

ব্যক্তিগতভাবে লোকগীতির পাশাপাশি মান্না দে, হৈমন্তী শুক্লার ভক্ত তিনি। 

মমতাজের খ্যাতির নিয়ে দ্বিমত নেই একদমই। দীর্ঘ সময় ধরে পালাগান, বিচ্ছেদ, লোকগীতি এবং প্লেব্যাকে নিজস্ব জায়গা সৃষ্টি করে নিয়েছেন তিনি। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন কিংবা হালের পুজা, ন্যান্সি, কনা কারো সাথেই আসলে মেলানো যায়না মমতাজকে। দৃঢ় দরদভরা কণ্ঠই তাঁর স্বকীয়তা। মমতাজ আপন আলোতে ,নিজস্ব ঘরানায় সপ্রতিভ। 

লেখক- সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *