বিনোদন

বদলে যাচ্ছে চলচ্চিত্র ও নাটকের ভবিষ্যৎ1 min read

জুলাই ১৪, ২০১৯ 4 min read

author:

বদলে যাচ্ছে চলচ্চিত্র ও নাটকের ভবিষ্যৎ1 min read

Reading Time: 4 minutes

দৃশ্য : বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে জনগণ। যেভাবেই হোক বদলাতে হবে রায়। 

দৃশ্য : বুবুনের বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় গেল লোকটা

দৃশ্য : আনিস ভাইয়ের আশ্চর্য মুখ আর সংলাপমেয়েটা হঠাৎ রেগে গেল কেন?’ 

লাইন কটা পড়লেই চোখের সামনে আসাদুজ্জামান নূরের সানগ্লাস পরা মুখ, বুলবুল আহমেদের আলাভোলা চেহারা কিংবা জাহিদ হাসানের চশমা আঁটা জ্ঞানী চোখ ভেসে উঠছে, তাই না? সম্ভবত এটাই ছিল নব্বইয়ের দশকের আলাদা কারিশমা, যার জন্যকোথাও কেউ নেই’, ‘বুবুনের বাবা’, ‘আজ রবিবারএখনো মানসপটে সজীব। 

বাংলাদেশের বিনোদন চিত্র 

তবে বাংলাদেশের নাটকের সেই হাল যে আর নেই, বরং বেহাল দশা সেটা অনেকেই স্বীকার করছেন। এবারের ঈদউলফিতরে নাটকের মান, ভাষা ব্যবহার, একই অভিনেতাঅভিনেত্রীর পুনঃ পুনঃ উপস্থিতি বিনোদনের চেয়ে বিরক্তিই দিয়েছে বেশি। একটু ভিনদেশে যাদের চোখ আছে তারা নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছেন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হুলু বা এইচবিওর সিরিজগুলোকে। দর্শকের চাহিদা বাড়ছে, সাথে বাড়ছে বেছে নেবার সুযোগও। অতএব বুঝতেই পারছেন, মানসম্মত গল্প সঠিক চিত্রনাট্যের অভাব ধসিয়ে দিতে পারে এই ইন্ডাস্ট্রিকে। 

কিন্তু শুধু  আমরাই কি বদলের সাথে তাল মেলাতে পারছিনা? বিনোদন দুনিয়া যারা বদলে দিলেন তাঁদের অবস্থা কেমন? সামনের দিনে কী পরিবর্তন আসছে?

বদলে যাচ্ছে বিনোদনের ধরন

পুরো বিশ্বজুড়েই এখন ভালো গল্পকারের খোঁজ চলছে। বাংলাদেশে তাকালেই দেখবেনক্লোজ আপকাছে আসার গল্প’, ‘সবাই ভিন্ন একসাথে অনন্যে মতো নানান সময় গল্প লেখার প্রতিযোগিতাও হচ্ছে জোরেশোরে। তবে আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো একেবারে পেশাদারিত্বের কাতারে গল্প লেখার ব্যাপারটা এখনো আসেনি। 

চিত্রনাট্যকারদের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কারণ হলো বিভিন্ন টেলিভিশন এবং ওয়েবসাইট ভিত্তিক বিনোদন সার্ভিসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। প্রতি সপ্তাহেই এক প্যাক নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয় নেটফ্লিক্সযার কিছুর মান কম হলেও অধিকাংশই নজরকাড়া।

‘হ্যান্ডমেইডস টেল’ স্রষ্টা মার্গারেট এটঊডের সাথে অভিনেত্রী এলিজাবেথ মস; Image Credit : Time Magazine

হুলুরদ্য হ্যান্ডমেইড টেল ভবিষ্যৎ বিপন্ন পৃথিবী, এইচবিওরচেরনোবিলবিপর্যয়ের চিত্র, নেটফ্লিক্সেরস্ট্রেঞ্জার থিংসে দুরন্ত গল্পসবকিছুই দর্শকের খিদে বাড়াচ্ছে ক্রমাগত। 

অভিনেতা স্টিভ পেম্বারটন এই প্রসঙ্গে বলেন ,’ দেখুন, ধারাভাষ্য কিন্তু সবখানেই আছে। খেলায় বলুন কিংবা কার রেসের ট্র্যাকে। মানুষ এখন নতুন গল্প চায়, ভবিষ্যৎ জানতে চায়। তাদের সেভাবে জানানোই আমাদের দায়িত্ব। লেখকদের তাই সবসময় চাপে থাকতে হয়, কারণ মানুষ দিনদিন কৌতূহলী হয়ে উঠছে।

এমনকি ১৯৭৮ সাল থেকে চলমান ব্রিটিশ আর্টস শোদ্য সাউথ ব্যাংকএর এবারের বিষয়বস্তুও ছিলচমকপ্রদ টেলিভিশন ড্রামা নির্মাণ এতে পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় চিত্রনাট্যকারকে  আনা হয় এবং তাঁদের কাজ, বিনোদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়। 

বিতর্ক আর সমস্যা

তবে শুধু দারুণ একটা গল্প, চমৎকার অভিনেতা, পকেটভরা টাকাও কিন্তু যথেষ্ট নয় এক্ষেত্রে। প্রাইম স্লট অর্থাৎ জনগণ ঠিক কোন সময়ে শো বা নাটকটি দেখবে তা বাছাই করে বুকিং দেয়াও কিন্তু খাটনির ব্যাপার। সেক্ষেত্রেদ্য বিবিসিইয়ারস এন্ড ইয়ারসদর্শক টানতে ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়। 

জনপ্রিয় সিটকমগুলো পরিবেশক- প্রযোজকদের থেকে কিনে রাখছে নেটফ্লিক্স; Image Credit: IMDb

এর মাঝে ভালো গল্পের যেমন চাহিদা আছে, তেমনি খারাপ গল্পের জন্যও আছে সমালোচনা। গেম অফ থ্রোনসে শেষ সিজন দেখে বিরক্ত হন নি এমন দর্শক পাওয়া দুরূহ। প্রায় . মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এক পিটিশনে সাক্ষর করে পুনরায় শেষ সিজনের গল্প লেখা নির্মাণের দাবি জানিয়েছে। মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। জোয়া আক্তার পরিচালিত অ্যামাজন প্রাইমেরমেড ইন হ্যাভেন দর্শক চাহিদাতেই কিন্তু দ্বিতীয় সিজন নিয়ে সামনে আসছে।  

বডিগার্ডলাইন অফ ডিউটিখ্যাত লেখক জেড মার্কারি বলেন, ‘টেলিভিশন দেখার ধরন কিন্তু এখন বদলে গেছে। যে প্ল্যাটফর্মেই কাজ করেন না কেন, গল্প হতে হবে আকর্ষণীয়।তিনি আরও বলেন, ‘ বেশ কয়েক বছর আগেও আমাদের বলা হত গল্পকে জটিল না করতে। কেননা, আগের সপ্তাহে কী হয়েছিল খুব একটা মনে রাখতে পারবেনা দর্শক। এখন দেখুন? স্ট্রিমিং সার্ভিস আপনাকে একবারে সব পর্ব দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। কোন সিজনের এক পর্ব দেখে আগ্রহী হলে আগের সিজনগুলোও দেখতে পারছেন আপনি।‘ 

মার্কারিওর মতে এতে লেখকদের চিন্তার স্বাধীনতা বাড়লেও বেশ কিছু দিকে অনিশ্চয়তাও আছে। যেমনক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা চাহিদার ফলে চাপে পড়ে যাবেন তারা। প্রত্যেক সেকেন্ডে নতুন দর্শক যুক্ত হচ্ছে, চাহিদাও বাড়ছে প্রতি সেকেন্ডে। 

তবে সেক্ষেত্রে নেটফ্লিক্স এখনও বেশ সুবিধাজনক জায়গায় আছে। কারণ, তারা শুধু আমেরিকা বা ব্রিটেন ভিত্তিক না হয়ে সব অঞ্চল থেকেই গল্প সংগ্রহ নির্মাণের কাজ করছে। এর পাশাপাশি তারা পুরনো শো যেমন– ‘ফ্রেন্ডস’, ‘দ্য অফিসপ্রভৃতিও সংগ্রহে রাখছে। 

 অ্যামাজন, বিবিসি আইপ্লেয়ার, নেটফ্লিক্স, আইফ্লিক্স, বায়োস্কোপ ইত্যাদি সাইটগুলোর কারণে গতানুগতিক টেলিভিশন বেশ পেছনে পড়ে যাবে।  

‘গেম অফ থ্রোন্সের’ ফাইনাল সিজন হতাশ করেছে দর্শকদের; Image Credit: Glamour

এটা যেমন ঠিক অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো কন্টেন্ট পাচ্ছে দর্শকেরা, এর ভেতরেও চলছে আরেক ফাঁদ। সময়ের সাথে পরিচালক, প্রযোজক সবাই চাইবে দর্শক যেন প্রতিটি সিরিজের জন্য আলাদা করে খরচ করে। তাহলে ভেবে দেখুন, ‘স্ট্রেঞ্জার থিংসবাস্যাক্রেড গেমসে কয়েক সিজন দেখার পর আলাদা করে সিরিজ কিনতে হচ্ছে আপনাকে। আবার না কিনেও থাকতে পারছেননা! এর ফলে ভোক্তা শ্রেণিতেও বিশাল পরিবর্তন আসবে। 

উভয় সংকট

দ্রুত বর্ধনশীল এবং প্রতিযোগিতার বাজারে আরও কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রযোজকেরা কোটি টাকা লগ্নি করে যেমন লাভ চাচ্ছেন তেমনি অভিনেতারাও চরিত্র চিত্রায়নের চাপে অতিষ্ঠ। মানসিক চাপে পড়ছেন লেখকেরাও।কল দ্য মিডওয়াইফএর স্রষ্টা হেইডি থমাস তাঁর অভিজ্ঞতার কথাই বললেন এভাবে, ‘ আমি প্রতিদিনই রাইটার্স ব্লকে (লিখতে না পারার সমস্যা) পড়ি। তবে কেউ একজন আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, আমার প্রথম লেখা কখনোই নিখুঁত হতে হবেনা। বরং সেটা খাতাকলমে তুলে ফেলাই হলো মূল কাজ। কিছু না লিখলে শুধরাবেন টা কী?’ 

মার্কারিও আরেক আশঙ্কার কোথাও জানান। যেহেতু দর্শকেরা চলচ্চিত্র, সিরিজের জন্য খরচা করবে, তারা চাইবে তাদের পছন্দ অনুসারে গল্প এগোক। সেক্ষেত্রে হাতের পুতুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার অন্য দিক দিয়ে নতুন লেখকদের ক্রমান্বয়ে লিখে যাওয়ার পাশাপাশি সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরিও করতে হবে। ভবিষ্যতে সমালোচনা কেনার বড় বাজার তৈরি হবে বলেই মনে হচ্ছে। নেটফ্লিক্সের সাথে ডিজনি, প্যরামাউন্ট, ওয়ারনার ব্রাদার্স হাত মিলিয়েছে ভবিষ্যতকে সামনে রেখেই। 

গোটা বিশ্বে যখন বিনোদনের বিরাট বাজার তরতরিয়ে উপরে উঠছে সেখানে আমাদের নাটকসিনেমার মান হাজার মাইল দূরেই পড়ে থাকছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক নানারকম টানাপোড়েনের বাধা কাটিয়ে গল্প বলার কাতারে আমাদের অবস্থান কোথায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *