featured বিশ্ব

বেয়ার গ্রিলসঃ একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী1 min read

ডিসেম্বর ২৪, ২০১৯ 4 min read

author:

বেয়ার গ্রিলসঃ একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী1 min read

Reading Time: 4 minutes

“হাজার বার আমি মারা যেতে নিয়েছিলাম, কিন্তু নেহায়েত ভাগ্যের জোরে এখন পর্যন্ত বেঁচে আছি!” 

“ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড” টিভি সিরিজের বিখ্যাত হোস্ট ঠিক এমনটাই বলে এসেছেন তার অসংখ্য শোতে। হ্যাঁ! আজ আমরা কথা বলছি বিয়ার গ্রিলসকে নিয়ে, যিনি বন্য প্রতিকূল জগতে কীভাবে টিকে থাকতে হয় সেই সব দক্ষতা শিখিয়ে দুনিয়াব্যাপী হয়ে উঠেছেন একদমই অনন্য। প্রতিকূল পরিস্থিতে টিকে থাকতে পানির অভাবে নিজের প্রস্রাব নিজেই পান করা, বন্য প্রাণীর বিষ্ঠা চেপে সেখান থেকে পানির অভাব পূরণ করা এবং বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড় খেয়ে খাদ্যের অভাব পূরণ করার মতো কাজগুলোও তিনি স্বাভাবিকভাবে করেন। 

বেয়ারের ঘটনাবহুল জীবন থেকে আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছুই। আসুন জেনে নেই ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড খ্যাত এই জীবন্ত কিংবদন্তী কীভাবে হয়ে উঠলেন একজন সামান্য থেকে অসামান্য!

গভীর বনে চিরচেনা রুপে বেয়ার গ্রিলস; Photo Source: variety.com

প্রথম জীবন 

গ্রিলস ১৯৭৪ সালে লন্ডন শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবারকে একটি ক্রিকেটীয় পরিবার বলা যেতে পারে, কারণ গ্রিলস এর দাদার বাবা এবং দাদা দুইজনই “ফার্স্ট ক্লাস” ক্রিকেটার ছিলেন। চার বছর বয়স পর্যন্ত ছোট্ট গ্রিলস আয়ারল্যান্ডের  ডোনাঘাডি এলাকায় বেড়ে উঠেন এবং পরবর্তীতে তিনি পরিবারের সাথে ইংল্যান্ডের একটি গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। গ্রিলস খৃষ্ট ধর্ম বিশ্বাসী এবং এই বিশ্বাসকেই তিনি জীবনে চলার পাথেয় হিসেবে দেখেন। 

কৈশোর থেকেই শুরু হয়েছিল তার দুরন্তপনা 

বয়সটা সবে মাত্র কৈশোরে পা দিয়েছে, তবে ইতোমধ্যেই যেন তার জীবন যাপন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়া শুরু করেছিল তার বর্তমানের। মাত্র আট বছর বয়সেই গ্রিলস স্কাউটে যোগদান করেন। সেই দুরন্ত কৈশোরেই তিনি পর্বত আরোহণ এবং নৌকা চালানো শিখে ফেলেছিলেন। শুধু শিখেই তিনি থেমে থাকেননি, ইটন নামক একটি কলেজে পড়ালেখা করার সময় তিনি এই পর্বত আরোহণের উপর একটি ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। 

খাদ্যের সন্ধানে; Photo Source: telegraph.com

গ্রিলস যখন সেনাবাহিনীতে 

পড়া শেষ করার পরপরই গ্রিলস হিমালয়ে আরোহণ করার সময়েই মনঃস্থির করে ফেলেন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করবেন। যেমন চিন্তা ঠিক তেমনই কাজ, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে তিনি যোগদান করেন এবং স্পেশাল ফোর্স রিজার্ভে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে ছিলেন প্রায় বছর তিনেকের মত। সেই এয়ার সার্ভিসে থাকা কালীন গ্রিলস প্রথমবারের মত এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন, যে দুর্ঘটনায় ধারণা করা হচ্ছিল আজীবনের জন্য তিনি পঙ্গু হয়ে যাবেন। 

সেই মর্মান্তিক প্যারাসুট দুর্ঘটনা! 

তখন তিনি জাম্বিয়া অঞ্চলে বেশ কয়েকজনকে প্যারাসুট ট্রেনিং করাচ্ছিলেন, আর সেই প্রশিক্ষণের মধ্যেই তিনি এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। প্যারাসুট দুর্ঘটনার কারণে বেশ উঁচু থেকে গ্রিলস নিচে পড়ে যান এবং তাৎক্ষনিক ভাবে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায় এবং ডাক্তার বলেন, হয়ত গ্রিলস আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। 

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও সঙ্গী হয়েছিলেন বেয়ারের অভিযাত্রায়; Photo Source: theguardian.com

কিন্তু রক্তে যার রোমাঞ্চের নেশা, অদম্য উন্মাদনা! সেই গ্রিলস কখনোই সেখানে থেমে যেতে চান নি। তবে তাৎক্ষনিক অবস্থায় তাকে সেনাবাহিনীর চাকরি বাধ্যতামূলকভাবে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। অবসর নিয়েই গ্রিলস দিনরাত কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন যাতে করে আবার উঠে দাঁড়াতে পারেন! কারণ তখনো রোমাঞ্চের হাতছানিতে সাড়া দেয়া অনেকটাই বাকি রয়ে গিয়েছিল। অবশেষে প্রায় দেড় বছর পর গ্রিলস সুস্থ হয়ে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। 

দুর্ঘটনা পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানো ও মাউন্ট এভারেস্ট জয় 

জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থায় এডভেঞ্চারের যে রোমাঞ্চ তাই হয়ত তাকে ডাকছিল হাতছানি দিয়ে। যেখানে ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবেন কি না সন্দেহ, সেখানে তার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা অসাধারণ! সুস্থ হয়েই ভ্রমণ আর রোমাঞ্চের স্বাদ তাকে নিয়ে গিয়েছিল মাউন্ট এভারেস্টে।  মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নটা সেই ছোটবেলা থেকেই লালন করে আসছিলেন তিনি। যৌবনে এসে ১৯৯৮ সালের ১৬ই মে সেই আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন তিনি। দুর্ঘটনার মাত্র ১৮ মাস পরেই সর্ব কনিষ্ঠ ব্রিটিশ হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয়লাভ করে তিনি বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী হন। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বেয়ার

এরপর আর ঘুরে তাকাতে হয়নি গ্রিলসকে 

এরপর একটি টিভি বিজ্ঞাপন এবং মাদক বিরোধী ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি টিভি পর্দায় আসেন ও পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি টেলিভিশন শো করেন। এরপর তিনি “ফেসিং আপ” নামক এক বই রচনা করেন যা কি না ইউনাইটেড কিংডমে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় চলে আসে। প্রথম বইয়ে আশানুরূপ সাড়া পাওয়ার পর তিনি আরো বেশ কয়েকটি বই লিখেন যেগুলো বেশ পাঠক সমাদৃত হয়। 

গ্রিলস এবং ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড! 

এভারেস্ট জয় অথবা বই কোন কিছুই তাকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলতে পারেনি যতটা না ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড করেছে। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা নিয়ে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো এই টিভি শো এর মাধ্যমে তুলে ধরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে গ্রিলস কখনো ছুটে বেড়িয়েছেন আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে আবার হয়ত কোন জনপ্রানহীন মরুভূমিতে। এই অনুষ্ঠানে বেয়ার কি করেন নি! বেঁচে থাকার জন্য নিজের প্রস্রাব পান করতে হয়েছে আবার পোকামাকড় খেয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে নিজের জীবন। 

পানিতে লড়েছেন কুমীরের সাথে আর ডাঙায় জীবন বাঁচিয়েছেন বাঘ সিংহের থেকে। হিমশীতল পানি থেকে গায়ের চামড়া বাঁচানোর জন্য পড়েছেন সীল মাছের চামড়া আবার কোন বিশাল জলাধার পাড়ি দিয়েছেন বাঁশের ভেলা তৈরি করতে। প্রতিকূল এবং দুর্গম পরিবেশে কিভাবে টিকে থাকতে হয় তার নিত্য নতুন কৌশল তিনি শিখিয়েছেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। 

চ্যানেলের সাথে মতানৈক্যের কারণে এক সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড। তবে ২০১২ সালে তা বন্ধ হয়ে গেলেও বেশ কিছুদিন পরে তিনি আবার ডিসকভারি চ্যানেলের সাথে কাজ করেছিলেন। পরে আরও বেশ কয়েকটি টিভি শো করলেও বিয়ার গ্রিলস নামটা শোনা মাত্রই হাজারো ভক্তের মনে একটাই টিভি শো এর কথা ভেসে আসে, “ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড”।  

লেখক- ইকবাল মাহমুদ ইকু

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *