বিশেষ প্রতিনিধি
উদ্বোধনের ৩ বছরের মধ্যেই স্থানীয়দের বিভেদ আর কোন্দলের কারণেই আকর্ষন হারাতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বুকে সরকারী ভাবে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারটি প্রতিষ্টার সাথে যারা সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন, সরকার এবং নগর প্রসাশনে যারা দৌড়ঝাপ করেছিলেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে ২১শে উদযাপন কমিটি গঠিত হয় বলে, মূল উদ্যোক্তরা এখানে অন্যদের ঘেসতে দেন না। অন্যদিকে, সরকারী অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনারটি দখলে রেখে, সর্বসাধারনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেয়া হয়না বলে অভিযোগ আছে অপর পক্ষের। এই পাল্টা পাল্টি অভিযোগ আর স্থানীয় দুই বাংলাদেশী রাজনীতিকের কর্মী-সমর্থকদের টানাপোড়েন এ অনেকখানি-ই আবেদন হারাচ্ছে নিউজার্সির শহীদ মিনার।
ভাষার মাস একুশে ফেব্রুয়ারী সমাগত। এরই মধ্যে প্রবাসীদের মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারী ও মহান আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের নানান তোড়জোড় শুরু হয়েছে। নিউইয়র্কে ব্রঙ্কস , জ্যাকসান হাইটস, জাতিসংঘের সামনে আলাদা আলাদাভাবে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এদিনের আনুষ্ঠানিকতা সারের বাংলাভাষার মানুষেরা। কিন্তু এই মার্কিন মু্ল্লুকে প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র স্থায়ী শহীদ মিনারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে, নিউজার্সির প্যাটারসনে। ওয়েস্ট সাইট পার্কে স্কুলের পাশে উন্মুক্ত জায়গায় বেশ অনেক খানি জায়গায় এটি দন্ডায়মান। সরকারী ভাবে জমি আর দেড় লক্ষ ডলার বরাদ্দ পেয়েছিলেন বাংলাদেশীরা।পরে এটির নির্মান কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর। ২০১৫ সালে সবাই ঘটা করে এই শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্থাবক অর্পন করলেও, স্থানীয় রাজনীতির কোন্দলে পরের বছরের সেই উদযাপন অনেক খানি ম্লান হয়ে যায়। তার চুড়ান্ত রুপ দেখা যায় ২০১৭ সালে। এবার, এখনও পর্যন্ত সবাই মিলে একত্রে ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে শংসয় দেখছেন স্থানীয়রা।
প্রথম আলোর সাথে আলাপকালে, স্থানীয় টিভি চ্যানেল ৫২ এর প্রতিষ্ঠাতা ও স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক স্কুলের উদ্যোক্ত। এনাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের স্কুলের প্রায় ৬০ জন ক্ষুদে শিক্ষার্থী আছেন।ইচ্ছা আছে তাদেরকে নিয়ে একত্রে একটি অনুষ্টান করবো সেখানে। কিন্তু বিভেদ এমন জোরালো যে, এক পক্ষ চায় না তাদের সন্তানরা সেখানে যাক। আবার আরেক পক্ষ বলছে, উনাদের বাচ্চারা ওখানে গেলে আমাদের বাচ্চা সেখানে পাঠাবোই না। এসব কারনে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা যে, ২১শে উদযাপন করবো কতখানি স্বতস্ফুর্ত ভাবে’।
নিউজার্সির প্যাটারসান সম্ভবত একমাত্র সিটি কর্পোরেশন এলাকা যেখানে পরাজিত এবং জয়ী দুজন প্রার্থী-ই বাংলাদেশী বংশোদ্ভত। সাবেক কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান বিগত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন বর্তমান কাউন্সিলম্যান শাহিন খালিকের কাছে। পরে তিনি আদালতে কারচুপির মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন, যার ফলাফলও তার পক্ষে আসেনি শেষ পর্যন্ত। এবার তিনি, প্যাটারসনের অনেকগুলি কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট নিয়ে গঠিত কাউন্সিল এট লার্জ পদে প্রতিন্দীতা করছেন। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ কালে শহীদ মিনার কেন্দ্রিক ভেদাভেদ দুর করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তের আকতারুজ্জামান, বলেন, ‘আসলেই ভিতরে সমস্যা আছে’। একই মন্তব্য বর্তমান কাউন্সিলম্যান শাহিন খালিকেরও। ‘আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ কাউকে মানতে না চাইলে সমস্যার সমাধান করা কঠিন’ -বলছিলেন শাহিন খালিক। তবে, ফেব্রুয়ারীর চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সকল পক্ষকে নিয়ে একত্রে বসার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
শহীদ মিনার কেন্দ্রীক সমস্যার গভীরতা কতখানি সেটা অনেকটাই অস্পষ্ট। শাহিন খালিক এবং আকতারুজ্জান দুই জন বাংলাদেশের দুই বড় দলের রাজনীতির সমর্থক বলে পরিচিত। প্যাটারসনে বসবাসকারী প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশীরাও অনেকখানি বিবাদমান দুই রাজনীতির দুই মেরুর বাসিন্দা।কোন পক্ষের কাকে একুশে উদযাপন কমিটির আহবায়ক বানানো হলো, অন্যদের কেন সমান মর্যাদা দেয়া হল না এসব নিয়েই বিভেদ। সেটা অকপটেই স্বীকার করেন, শহীদ মিনারটির মূল উদ্যোক্তাদের একজন যোবায়ের আহমেদ।
‘আমরা আগে থেকেই বিক্ষিপ্ত ভাবে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এক পর্যায়ে আমারা নিজেরা কয়েকজন মিলে চেষ্টা করি একটি শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু আমাদের কাছে অর্থ ছিল না। পরে আমাদের অলাভজনক প্রতিষ্টান ওয়ার্ল্ড গ্লাম অর্গানাইজেশন এর প্যাডে আমরা আবেদন করি নগর কর্তপক্ষের কাছে। আমাদের সেই আবেদন গৃহীত হয়। পরে এই শহীদ মিনার নির্মিত হলে এর দায় দায়িত্বও রক্ষনাবেক্ষন কাজটিও আমাদের হাতে এসে পড়ে। কিন্তু দেখা গেল আমাদেরকে বাদ দিয়েই গায়ের জোরে ২১শে উদযাপন কমিটি হয়।আমরা সেখানে গৌন হয়ে পড়ি। এবছর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোন আহবায়ক কমিটির দরকার নেই, আমরা নিজেরা উদ্যোগ নেব, যত জন আসুক, তাদেরকে নিয়েই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবো’- বলছিলেন যোবায়ের আহমেদ।
এই টানাটানিতেই বির্বণ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে, প্রথম সরকারী তহবিলে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। সাধারস মানুষের অনেকের আবার অভিযোগ এই শহীদ মিনারটি উদ্যোক্তরা এখন এটাকে নিজেদের সম্পর্তি বলে মনে করতে শুরু করেছেন, যার পেছনেই লুকায়িত অনেক খানি সমস্যা।
অবস্য, প্যাটারসনের সকলকে নিয়ে একত্রে মহান একুশে এবং আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা পালন করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় কিনা ,সেটার দাবী আছে প্যাটারসনের বাঙালী প্রবাসীদের।