ইতিহাস

 বিজ্ঞানের আবিষ্কার যখন অভিশাপ1 min read

জুন ২৫, ২০১৯ 3 min read

author:

 বিজ্ঞানের আবিষ্কার যখন অভিশাপ1 min read

Reading Time: 3 minutes

ভিক্টর ফ্র্যাংকেনস্টাইন দুবছরের পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন নতুন প্রাণ। অথচ জাগতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেই আট ফুট লম্বা মানবটাই মুহূর্তে পরিণত হয়েছিলো মূর্তিমান আতঙ্কে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই সৃষ্টির গ্লানিতে ভুগেছিল মেরি শেলির অনবদ্য উপন্যাসের নায়ক। 

সৃষ্টি বরাবরই সুন্দর। কিন্তু অল্প এদিক সেদিক হলেই সেই সৃষ্টিই বুমেরাং হয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে মানবসভ্যতা। ফলে অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি পস্তাতে হয় এর আবিষ্কর্তাকেও। চলুন এই রচনায় বিজ্ঞানের তেমন কিছু আবিষ্কারের কথাই জেনে নিই।

ডায়নামাইট

নোবেল পুরস্কারের জন্মই হয়েছে এক ট্র্যাজেডির হাত ধরে। সুইডিশ রসায়নবিদ ব্যবসায়ী আলফ্রেড নোবেল মহৎ উদ্দেশ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন ডায়নামাইট। ১৮৬৭ সালে এর পাকাপাকি পেটেন্ট পান তিনি। তবে এই আবিষ্কারের রাস্তাও খুব একটা সহজ ছিল না। ছোট ভাই এমিলসহ বেশ কিছু কর্মীর মৃত্যু হয় এসব বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে। মূলত খনির কাজে সাহায্য হবে ভেবেই আবিষ্কার করেছিলেন এই বিস্ফোরক। তাছাড়া আলফ্রেড নোবেলের ধারণা ছিল, শক্তিশালী এই বিস্ফোরকের ভয়ে আর যুদ্ধও বাঁধবে না। 

গ্রীক শব্দ ডায়নামাইস থেকে এসেছে ডায়নামাইট শব্দটি, যার অর্থ ক্ষমতা। আদতেই ডায়নামাইটের জনপ্রিয়তা আলফ্রেড নোবেলকে ক্ষমতাশালী করে তোলে। কিন্তু গোল বাঁধে যখন তিনি দেখতে পান ডায়নামাইটের ব্যবহার নির্মাণের চাইতে ধ্বংসেই বেশি জার্মানিফ্রান্স আমেরিকাস্পেন যুদ্ধক্ষেত্রে এই বিস্ফোরকের ঢালাও ব্যবহার তাঁকে বাকরুদ্ধ করে ফেলে। নিজের ভয়ংকর আবিষ্কারের প্রায়শ্চিত্ত করতেই ১৮৯৫ সালে তিনি প্রবর্তন করেননোবেল পুরস্কার 

নিউক্লিয়ার বোমা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানেই নিউক্লিয়ার বোমার দামামা। এর শেষভাগেই স্মরণকালের ভয়াবহতম নিউক্লিয়ার বোম্বিংয়ের শিকার হয় হিরোশিমানাগাসাকি। অথচ এই যুদ্ধে নিউক্লিয়ার তৎপরতার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আইনস্টাইন জানতে পারেন- ‘পারমাণবিক বোমা তৈরিতে এগুতে পারেনি জার্মানরা’; Source: The Verge

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম থেকেই গুজব ওঠে, জার্মানদের হাতে পারমাণবিক বোমা তৈরির সূত্র চলে এসেছে।  অতএব, এই যুদ্ধে জার্মানরাই জয় পাবে। তাই বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে তাগাদা দেন, যেন খুব শীঘ্রই আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলে। শুধু তাই নয়, আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc^2 সূত্রও খাটানো হয় এর অগ্রগতিতে। ফলাফল, হিরোশিমানাগাসাকির ভয়াবহ অধ্যায়। পরবর্তীতে আইনস্টাইনসহ অন্য বিজ্ঞানীরাও অনুতাপে ভুগেছেন। 

একে-৪৭ 

সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আইন রক্ষাকারী বাহিনীসবার কাছেই এক জনপ্রিয় নাম একে৪৭। ১৯৪১ সাল থেকে এর নকশা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে রাশিয়ান মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার অস্ত্র নকশাকার মিখাইল কালাশনিকভ নির্মাণ করেন একে৪৭। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই অস্ত্র শুধু রাশিয়ান সেনাবাহিনীতেই ব্যবহৃত হবে। অথচ ক্রমেই বাড়তে থাকে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন রাশিয়ান অস্ত্র বাণিজ্যের সবচাইতে বড় চাহিদায় পরিণত হয় এটি। অতএব, সারাবিশ্বে বহুল ব্যবহৃত প্রাণ সংহারকের অপর নাম এখন একে৪৭।

একে-৪৭ হাতে এর নকশাকার ও আবিষ্কারক মিখাইল কালাশনিকভ; Image Source: The Guardian

কালাশনিকভ তাঁর আবিষ্কারের এমন ব্যবহার কখনোই চান নি। হতবিহবল এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল অনুতাপ থেকেই রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চে এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন ২০১০ সালে। চিঠিতে তিনি বারবার বলেছেন, ‘ এই অস্ত্র দিয়ে যত জনকে হত্যা করা হয়েছে বা হবে, প্রতিটি মৃত্যুরই ভাগীদার আমি।‘ 

পিপার স্প্রে

১৯৮০ সালে FBI এর নির্দেশে পিপার স্প্রে আবিষ্কার করেন ক্যামেরন লগম্যান। মূলত মরিচের ক্যাপসাসিন বা জ্বালা ধরানো রাসায়নিক দ্রব্য়ের বোতলজাত রূপই হলো পিপার স্প্রে। প্রাথমিকভাবে লগম্যানকে জানানো হয়েছিল, এটি শুধু অপরাধীদের জন্যই ব্যবহৃত হবে। 

পিপার স্প্রের ব্যবহার এখন তুমুল সমালোচিত; Image Source: Time Magazine

কিন্তু ক্রমে লগম্যানসহ পৃথিবীর সবাই দেখতে পান, এই পিপার স্প্রে আন্দোলনকারী, শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশগ্রহণকারী, ছাত্র, পরিবেশ কর্মীসবার উপরই নির্বিচারে প্রয়োগ করা হচ্ছে। 

এক্সটেসি পিল   

আমেরিকান মনো জীবরসায়নবিদ আলেকজান্ডার সুলজিন ব্যাপক গবেষণার পর আবিষ্কার করেন এক ওষুধ– MDMA বা মিথাইলডেনোক্সিমেথাফেটামাইন। এর কার্যকারিতা ছিল ব্যথা নাশে এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে। ১৯৬৭ সালে সুলজিন নিজের উপরও এটি প্রয়োগ করে ফল পান। 

ওষুধ যখন মাদক; Image Source: The Telegraph

কিন্তু সত্তরের শেষদিকে এটি বাজারে আসতেই গতি যায় বদলে। এটি এক্সটেসি নামে বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু থেরাপি হাসপাতালে এর আসল ব্যবহারের চাইতে মাদক হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে নানান নাইট ক্লাব, রাস্তাঘাটে। এটি গ্রহণের ফলে মাদকসেবীর মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে, সে অবর্ণনীয় আনন্দ লাভ করে, পাশপাশি হ্যালুসিনেশনও হতে থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এর ফর্মুলা খানিকটা বদলে আরও গাঢ় করে দেয় এর প্রভাব।৮০ ৯০ এর দশকের যুবসমাজ ধ্বংসে সবচেয়ে বড় দায় ছিল এই এক্সটেসির। 

উপরে উল্লিখিত আবিষ্কারের মতো ভুরি ভুরি ঘটনা আছে বিজ্ঞানের ইতিহাসে। বিজ্ঞান মূলত মানুষের জীবনকে সুন্দর সহজ করার লক্ষ্যেই এগিয়েছে; কিন্তু এর অপব্যবহার মানব সভ্যতাকে বারবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়েছে। তাই হয়তো বিজ্ঞানকে না দুষে কালাশনিকভের মতো মানুষের অসীম লোভকেই দায়ী করতে পারেন আপনি। 

 লেখক- সারাহ তামান্না            

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *