Site icon Bangla Info Tube

“পরিস্থিতি” সামলাতে বিচারক বদলি!

পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ ও পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আউয়াল; ছবিঃ যুগান্তর

Reading Time: 2 minutes

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুর্নীতির মামলায় পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ ও বর্তমান পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আউয়াল ও তার স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনের জামিন নামঞ্জুর করা পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজকে কয়েকঘন্টার নোটিশে ওএসডি ও বদলি করার বিষয়টি গত দুই দিনে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

জনাব আউয়াল পিরোজপুর-১ আসন থেকে ২০০৮ সালের দশম এবং ২০১৪ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও তিনি পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা হিসেবেই পরিচিত। জনাব আউয়ালের “দাপট” সম্পর্কে পিরোজপুরবাসী ওয়াকিবহাল থাকলেও গত ৩ মার্চ (মঙ্গলবার) পুরো বাংলাদেশের জনগণ তার “দাপটের” উত্তাপ টের পেয়েছে।

২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. আকবর আলী সরকারি খাস জমিতে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ, দলিল জাল করা, অর্পিত সম্পত্তি ও পুকুর দখলের অভিযোগে আউয়ালের বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করেন। এর মধ্যে একটি মামলায় আউয়ালের স্ত্রী লায়লা পারভীনকেও আসামি করা হয়। ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি আউয়াল ও তার স্ত্রী উচ্চ আদালত থেকে আট সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আবার জামিনের আবেদন করতে গত ৩ মার্চ এই দম্পতি পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হন।

শুনানি শেষে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নান তাদের জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিচারকের এই রায়ে আদালত প্রাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পিরোজপুরের বিভিন্ন স্থানে জনাব আউয়ালের অনুসারীরা রাস্তা আটকিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেন। শহরের দোকানপাট আতঙ্কে বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। আরেক দিকে বিচারক মো. আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে “অসদাচরণের” অভিযোগ এনে আউয়ালের আইনজীবী  এবং বারের সকল আইনজীবী আদালত বর্জনের ঘোষণা দেন।

এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই আউয়াল ও তার স্ত্রীর পক্ষের আইনজীবীরা তাদের অসুস্থতা দেখিয়ে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে যাওয়ার আবেদন করেন। বেলা তিনটার দিকে বিচারক ডিভিশনসহ এই দম্পতির হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরে জানা যায় আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিচারক আব্দুল মান্নানকে বদলি করে আইন বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করেছে আর তার জায়গায় পিরোজপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনকে।

বিকেল পৌনে চারটার দিকের আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের কাছে পুনরায় জামিনের আবেদন করলে শুনানি শেষে তিনি বিকেল চারটায় জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।

এই পুরো ঘটনাটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আবার জাগিয়ে তুলেছে। জনাব আউয়াল এমন কে যার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকঘন্টার নোটিশে বিচারক পরিবর্তন করে তাকে জামিনের ব্যবস্থা করে দেয়ার দরকার পড়লো? আইনমন্ত্রী ঘটনার পরের দিন ৪ মার্চ পুরো ব্যাপারটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, পরিস্থিতি প্রশমিত করতেই আব্দুল মান্নানকে বদলি করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, “ পিরোজপুরে জেলা জজের কাছে পিরোজপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তার স্ত্রী দুর্নীতির মামলায় জামিত চাইতে গিয়েছিলেন। জামিন চাওয়ার সময় তার আইনজীবী এবং বারের সকল আইনজীবীর কাছ থেকে আমরা যে তথ্যাদি পেয়েছি, জেলা ও দায়রা জজ অত্যন্ত অশালীন এবং রূঢ় ব্যবহার করেন। সেই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায়, যেখানে বারের সকলে আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই অবস্থায় যখন এসব গণ্ডগোল চলছিল এবং রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে গিয়েছিল, সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্য তাকে (জজ) ওখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ (তাত্ক্ষণিক বদলি) করে আদেশ দেওয়া হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে।” (০৫ মার্চ, ইত্তেফাক) 

জাতির স্বার্থে আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পিরোজপুর জেলা দায়রা জজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ তদন্ত না করে কেবল মৌখিক অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তাকে বদলি করা কতটা যুক্তি সঙ্গত? আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যদি বিচারক বদলি করতে হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজটা কি? পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় সে কথা মাথায় রেখে কি তাহলে বিচারকদের রায় দিতে হবে?

লেখক- হাসান উজ জামান 

Exit mobile version