Site icon Bangla Info Tube

‘ভুল বিচারে’ ভারতের কারাগার থেকে বাংলাদেশের কারাগারে

দিল্লির তিহার জেলে ১০ বছর ধরে বন্দি ছিলেন বাংলাদেশের বাগেরহাটের ছেলে বাদল ফরাজী।

Reading Time: 2 minutes

২০০৮ সালের ৬ মে ভারতের নয়াদিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধা খুন হন। এই খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বাদল সিং নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ঘটনার প্রায় ২ মাস পর ১৩ জুলাই পর্যটক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের বাগেরহাটের ছেলে বাদল ফরাজী তাজমহল দেখতে ভারতে প্রবেশ করেন। কিন্তু নাম বিভ্রাটের কারণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ভুল করে বাদল ফরাজীকে গ্রেপ্তার করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ইংরেজি বা হিন্দি জানা না থাকায় বিএসএফ সদস্যদের কাছে নিজের পরিচয় পরিষ্কার করতে পারেন নি বাদল। তাই তাকে পাঠানো হয় দিল্লির এক কারাগারে। পাসপোর্ট অনুযায়ী বাদলের বয়স তখন ছিল মাত্র ১৮ বছর।

২০১৫ সালের ৭ আগস্ট এই মামলায় খুনের দায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় দিল্লির সাকেত আদালত। বাদল দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশী হাই কমিশনের সাহায্য নিয়ে আদালতের এই রায়ের প্রেক্ষিতে দিল্লি হাইকোর্টে আপিলও করেন। কিন্তু হাইকোর্ট একই সাজা বহাল রাখে। ফলে বাদলের জায়গা হয় দিল্লির তিহার কারাগারের ৩ নম্বর সেলে।

এরই মধ্যে বাদল নিজের একান্ত চেষ্টায় কারাগারে থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কারাগারের ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন। এমনকি স্নাতকের পর আটটি ডিপ্লোমা কোর্সও শেষ করেন নিরপরাধ বাদল। তিহার কারাগারে অন্য বন্দিদের ইংরেজি পড়িয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল বাদলের। এর মধ্যে একদিন তিহার কারাগারের বন্দীদের কাউন্সিলিং এর কাজ করতে আসা রাহুল কাপুরের সাথে যোগাযোগ হয় বাদলের। বাদল তার নিজের সব কথা রাহুলকে খুলে বললে রাহুল নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে বাদলের ব্যাপারটি সবার সামনে নিয়ে আসেন। বাদলকে মুক্ত করতে তিনি দিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনে যোগাযোগ করেন। ‘জাস্টিস ফর বাদল’ নামে একটি অনলাইন আবেদনে স্বাক্ষর অভিযানও শুরু করেন রাহুল। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বাদলের দণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

বাদলের নির্দোষ হওয়ার বিষয়টি জানার পর ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জরুরী বৈঠক করে বাদলকে দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।  ২০১৮ বছরের জুলাই মাসে বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাদলকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় তারপরও মুক্তি মেলেনি বাদলের। নিজের দেশেই প্রায় ১ বছর ধরে আটকা পরে আছেন বাদল।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাদল ফরাজীকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি-তা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। কিন্তু এরপরে গণমাধ্যমে বাদল ফরাজীকে নিয়ে আর কোনো খবর আসেনি।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী বাদলকে দেশে ফিরানোয় কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ ভারতের আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশেও সাজার পূর্ণ মেয়াদকাল পূরণ করতে হবে বাদলের। ভারতের প্যানাল কোড অনুযায়ী বাদলের সাজা ১৪ বছর হলেও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তা ৩০ বছর। কোন আইনে বাদলের সাজা কার্যকর হবে সেটি নিয়েও এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। অনেকের মতে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমার যে সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে, সে অনুযায়ী বাদলকে বিশেষ ক্ষমার অধীনে এনে মুক্ত করা যেতে পারে।

বাদল নিজের নাম পরিচয় পুলিশের কাছে বলতে পারেননি ব্যাপারটি অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এমনকি বাদল ফরাজি যে বাদল সিং নয়, পাসপোর্ট দেখেও কিন্তু সেটি প্রমাণ করা যেত। এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর বাদল তিহার জেল থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে ভারতের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে বাদল বিস্তারিতভাবে তার সাথে ঘটা সব ঘটনা তুলে ধরেন। তাজমহল দেখতে ভারতে গেলে সেখানে তিনি একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্রের কবলে পড়েন। তার পাসপোর্ট এবং অন্যান্য সবকিছু কেড়ে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় সেই চক্র। পরবর্তীতে পুলিশ নির্যাতনের মাধ্যমে সাদা কাগজে বাদল সিং নামে তার স্বাক্ষর নিয়ে তাকে এই মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় বলে সেই চিঠিতে জানান তিনি।

লেখক- হাসান উজ জামান 

Exit mobile version