বাংলাদেশ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘মাস্তানি’ ও সাংবাদিকদের ‘ধর্ষণ উপভোগের চেষ্টা’1 min read

নভেম্বর ১৫, ২০১৯ 4 min read

author:

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘মাস্তানি’ ও সাংবাদিকদের ‘ধর্ষণ উপভোগের চেষ্টা’1 min read

Reading Time: 4 minutes

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন পর্যায়ে আছে তা সচেতন মানুষকে এখন আর বুঝিয়ে বলতে হয় না। তারা নিজেরাই জানেন। সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেইজগুলোতে মানুষের মন্তব্য নিয়মিত মনিটরিং করলে বুঝা যাবে, মানুষ খুব গভীরভাবে বুঝে এবং বিশ্বাস করে যে, এই দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজেদের মাথাকে ভয়ে অথবা স্বেচ্ছায় ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের কাছে বন্ধক দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা বড় ঘটনা ঘটলে সেটির খবরের জন্য দেশের মানুষ বিদেশি গণমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিকট অতীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় দেখা গেছে ছাত্ররা সামাজিক মাধ্যমে ক্যাম্পেইন চালিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এমনকি বিদেশি ব্লগার, ইউটিউবারদের কাছে পর্যন্ত তারা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে নিজেদের বক্তব্য প্রচারের জন্য, নিজেদের ওপর চলা নিপীড়ন তুলে ধরার জন্য। সেসময় তারা দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষমও হয়েছিল। ছোট ছোট স্কুল শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত বুঝেছিল সত্য প্রকাশের জন্য এই দেশের সংবাদমাধ্যমের ওপর তাদের ভরসা করার কিছু নেই। কারণ তারা সরকারের মন বুঝে চলে, সরকারের ন্যারেটিভের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষমতা তাদের নেই।

শুধু দেশের মানুষের পারসেপশন নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও জানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি কেমন। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ গণমাধ্যম পরিস্থিতির দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ, এবং এই পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে অধঃপতনের দিকে রয়েছে। চলতি বছর বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০ তম, যা আগের বছরের চেয়ে চার ধাপ অবনতি। বিশ্বের সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার এই সূচক প্রকাশ করে। চলতি বছর এপ্রিলে সর্বশেষ এই সূচক প্রকাশ করেছিল। মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের এই অধঃপতনের খবরটিও প্রকাশিত হয়নি!

এত খারাপের মধ্যেও এতদিন এমন কোনো নজির ছিল না যে, সরকারের কোনো অঙ্গ এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সংবাদমাধ্যমের ওপর অফিসিয়ালি ‘মাস্তানি’ করেছে। হ্যাঁ, এটাকে ‘মাস্তানি’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ দিয়ে বুঝালে সঠিকভাবে বুঝানো হবে না।

সব সময়ই সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি, মারধরের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা, সরকারি দলের গুণ্ডাদের হাতে খুন হয়েছেন সংবাদকর্মীরা (বিরোধীদের হাতেও যে নির্যাতিত হননি তা নয়)। এমনটা সব দলীয় সরকারের অধীনেই বাংলাদেশে ঘটেছে। দলবিহীন স্বৈরাচারের সময়েও সাংবাদিকরা স্বাভাবিকভাবে নিরাপদ ছিলেন না। নানান সরকারের সময়, এবং বিশেষভাবে বর্তমান সরকারের সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সাংবাদিকরা এবং অনেক সংবাদমাধ্যম অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। অসংখ্য ঘটনায় পুলিশসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের দ্বারা হয়রানি, হুমকির শিকার হয়েছে।

তবে কখনো কোনো সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অফিসিয়াল গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে পরোক্ষ হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু নজিরবিহীন সেই ঘটনাই ঘটেছে এই বছর(২০১৯) ১৪ নভেম্বর।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলোকে “আদেশ” করেছে তাদের মনের মতো করে সংবাদ ছাপাতে। এত সেন্সরশিপ এবং মোসাহেবির পরও নাকি সংবাদমাধ্যমগুলোতে “বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে”। এমনটাই বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়!

বিডিনিউজের প্রতিবেদন থেকে পড়ুন:

“গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক’ সংবাদ প্রকাশের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এই গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “স্পর্শকাতর বিষয়ে যথাযথভাবে যাচাইপূর্বক বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।”

প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন সংবাদপত্রের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিভিন্ন ‘বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ’ দেখে এই গণবিজ্ঞপ্তি এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

এতে বলা হয়, “যার ফলে জনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষুণ্ন ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিসহ জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।” জনশৃঙ্খলার অবনতি ও সামাজিক অস্থিরতা রোধে গণমাধ্যমের ‘ইতিবাচক ভূমিকার’ প্রতি সরকার যথেষ্ট আস্থাশীল বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছু নামমাত্র অনলাইন পোর্টাল মানুষের চরিত্র হনন করে আজেবাজে নিউজ করছে, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেইসব খবর ছড়াচ্ছে। এসব বিষয় রোধ করার জন্যই এই গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।” [সূত্র- বিডিনিউজ ২৪]

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সরাসরি কথা বলতে গিয়ে একটু পিছুটান মেরেছেন। সরকারের গণবিজ্ঞপ্তির টার্গেট হিসেবে “কিছু নামমাত্র অনলাইন পোর্টাল” এবং সামাজিক মাধ্যমকে বুঝানোর কসরত করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে, “প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন সংবাদপত্রের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে…”। প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চয়ই “কিছু নামমাত্র অনলাইন পোর্টাল” নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশের পুরো সংবাদমাধ্যম জগতকে নতুন করে চাপে রাখার উদ্দেশ্যে পরোক্ষে হুমকি দেয়া হয়েছে এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।

এর একটা অনুমিত কারণও থাকতে পারে। সম্প্রতি শেখ হাসিনার দলের অভ্যন্তরে চালানো কথিত ‘শুদ্ধি অভিযান’ এর সুযোগে দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম একটু ‘সাহসী’ হয়ে উঠেছে! যেহেতু সংবাদমাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিরা দেখেছেন, সরকারের সর্বেসর্বা শেখ হাসিনা নিজেই নিজের দলের একাংশের বিরুদ্ধে নেমেছেন, ফলে এই সুযোগে ঝুঁকিহীনভাবে কিছু সংবাদ ছাপিয়ে দেয়া যায়!

“পাতি নেতারা দুর্নীতি করে শেখ হাসিনার সুনাম নষ্ট করছেন”, “শেখ পরিবারের নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতিবাজরা শেখ পরিবারের সুনাম নষ্ট করছেন”, এই ধরনের সেন্টিমেন্টের অধীনে কিছু লোকের দুর্নীতি উন্মোচিত করে দিয়ে শেখ হাসিনার “আরও ভালো শুভাকাঙ্খী” হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার প্রয়াস পেয়ে গিয়েছিলেন কিছু সংবাদমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা। এর মাধ্যমে হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ভঙ্গুর সংবাদপত্র জগতে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের এক যুগপৎ চেষ্টা চলছিল সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেরর মধ্যে। এতে ক্ষমতাসীন অনেক পাতি লেভেলের লোকজনের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ছিলো।

কিন্তু শেখ হাসিনা তো এটা চাননি। তিনি দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে নিজের পারিবারিক কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দেখাতে চেয়েছেন। তার সাথে যোগ হয়েছে কিছু এলিট নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা টপ লিডারশিপের পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দেয়ার বিষয়টি। তাই বলে পুরো দলে তার খুঁটিগুলো নষ্ট করতে চাননি। ইতোমধ্যে তার পারিবারিক চ্যালেঞ্জারদেরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে সংস্কার এনে ফেলেছেন। ফলে এখন কথিত ক্যাসিনো অভিযানও শেষ হয়েছে। নতুন আর কোনো ক্যাসিনোর সন্ধান করা হচ্ছে না। অন্যান্য খাতের দূর্নীতিবাজদের ধরা তো দূর কী বাত! অভিযানের প্রথম ধাক্কায় যে তালিকা নিয়ে নামা হয়েছিল মাঠে পুলিশ এখন সেই তালিকার কয়েকজন লোক নিয়েই নাড়াচাড়ায় ব্যস্ত।

কিন্তু বেরসিক কিছু সাংবাদিক এখনও ‘দুর্নীতি’ নিয়ে মাতামাতি শেষ করছে না। সরকারের নানান সেক্টরের বেশ কিছু লোককে নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। এমনটা চলতে দিলে শেষমেশ শেখ হাসিনাকেই বিপাকে পড়তে হতে পারে। ফলে তিনি এখন আর হাছান মাহমুদের (তথ্যমন্ত্রী) মতো “লিপ সার্ভিস” নির্ভর অপেক্ষাকৃত লুজ মন্ত্রীর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমগুলোকে হুঁশিয়ার করার পন্থায় অবলম্বন করেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন অস্ত্রওয়ালা মারদাঙ্গা বাহিনীর ‘মালিক’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। মূলত এখানেই ‘মাস্তানি’র বিষয়টি লুক্কায়িত। সরকারি লোকজনকে নিয়ে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের ‘বাড়াবাড়ি’ চালিয়ে যেতে থাকলে, এবং সেসব সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে দেখে মানুষ উত্তেজিত হয়ে কিছু ঘটিয়ে ফেললে ‘লাঠির বাড়ি’ একটিও মাটিতে পড়বে না- সরকার এটা বুঝাতে চেয়েছে।

মজার বিষয় হলো, এই নজিরবিহীন মাস্তানির পরও কোনো সংবাদমাধ্যমে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে কোনো সাংবাদিক সংগঠনের উল্লেখযোগ্য সাংবাদিকদের কোনো টু শব্দও কোথাও দেখা যায়নি! সম্ভবত, ‘নিশ্চিত ধর্ষণকে উপভোগের’ চেষ্টায় আছেন তারা।

লেখক- আকিব আহমেদ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *