ইতিহাস

প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি1 min read

সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯ 5 min read

author:

প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি1 min read

Reading Time: 5 minutes

তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি। 

কি আমার অপরাধ?’

মানবীর সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে সাহিত্যগান রচনার ঢল আজও অবিরত। ক্লিওপেট্রা, হেলেন, পদ্মাবতীর জন্য তো বীরেরা যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। এডগার এলান পোরশিতে অমর সৌন্দর্যের অধিকারিণী যুগের পর যুগ রাজ্য শাসন করেছিলেন তাঁর অমোঘ রূপ আর ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে। 

এতো গেল মানবীর রূপ ঘিরে নানা কাণ্ডের বিবরণ। কিন্তু দেবরাজ্যে? সেখানেও আছেন এমন নন্দিত,মায়াবিনী রূপসীআফ্রোদিতি। প্রেম,কাম, যৌনতার এই দেবী গোটা দেবপুরীতে ফেলে দিয়েছিলেন সাড়া। তাঁর স্বামী হওয়ার জন্য ব্যগ্র ছিল প্রায় প্রতিটি দেবতা। স্বর্গীয় সৌন্দর্য আর প্রেমের দেবী হিসেবেই গ্রিক রোমান পুরাণে জনপ্রিয় আফ্রোদিতি বা ভেনাস। 

জন্মপরিচয়

সৌন্দর্যের এই দেবীর জন্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁকে দেবরাজ জিউস দেবী ডিওনের কন্যা মেনে নেয়া হয়। এছাড়া ইউরেনাসের কাহিনীও বেশ আলোচিত। এতে জানা যায়, সময়ের দেবতা ক্রনস ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁর পিতা ইউরেনাসের জননাঙ্গ কেটে পৃথিবীর সপ্তসমুদ্রে ফেলে দেন। ইউরেনাসের প্রভাবে ক্রমে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে আর এর মধ্য থেকেই উঠে আসে অনিন্দ্য সুন্দরী এক দেবীআফ্রোদিতি বা ভেনাস। গ্রিক ভাষায় আফ্রোদিতি শব্দের অর্থই হলোসমুদ্রোদ্ভুতামানে যার জন্ম সমুদ্র থেকে। ভেনাস নামটি রোমানদের দেয়া। এই ভাষ্যে ভেনাসের বাড়ি সাইথেরা সাইপ্রাস দ্বীপে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তিনি ইজিয়াস সাগর পার হয়ে মূল ভূখণ্ডে আসেন। 

সমুদ্রের মধ্য থেকে উঠে আসছেন ভেনাস- বত্তিচেলির ‘বার্থ অফ ভেনাস’; Photo Source: Ancient Origins

গ্রিক কবি হিসিওড প্রথম তত্ত্বের পক্ষে গেলেও সাহিত্যিক হোমার ইউরেনাসের তত্ত্বেই বিশ্বাসী। তবে এটাই শেষ নয়।  দার্শনিক প্লেটো আরও দুই ধাপ এগিয়ে আরেক তত্ত্ব দাঁড় করান। তাঁর মতে একই নামে দুই আফ্রোদিতি বিদ্যমান ছিল দেবালয়ে। এর একজন ছিলস্বর্গীয় প্রেমের দেবী’, আর অপরজন ছিলদৈহিক প্রেমের দেবী এই দুই ধারার প্রথমটি পরিচিতইউরানিয়ামনামেযা প্রেমের বিশুদ্ধ রূপটি তুলে ধরে। অন্যদিকেপ্যান্ডিমিয়ানহলো দেহগত ইন্দ্রিয়লালসার রূপ।

নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক

গ্রিক রোমান পুরাণসাহিত্যে আফ্রোদিতির উত্থান ঠিক কবে হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, যেসব এলাকায় এই দেবীর পূজা করা হতো তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। গ্রিস এবং পূর্বইউরোপেই কাম প্রেমের দেবীর প্রথম সাক্ষাত পাওয়া যায়। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের দিকে রূপসী পূজারী হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসের মতে সবচেয়ে পুরনো আফ্রোদিতিঅর্চনার তথ্য পাওয়া যায় এসকেলনে (বর্তমান ইসরায়েল) তবে এই দেবীর উত্থান আঞ্চলিক রীতিতেও হতে পারে, যেমনভেনাসকেসাইপ্রিসনামেও ডাকা হয়। এর মানেসাইপ্রাস এর 

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নির্মিত আফ্রোদিতির টেরাকোটা মূর্তি; Photo source: Ancient Eu

আফ্রোদিতি বা ভেনাসকে বিভিন্ন নান্দনিক নামেও ডাকা হয়; যেমনআফ্রোদিতি পণ্টিয়া বা গভীর সমুদ্রের রানি, আফ্রোদিতি ইউপ্লোইয়া বা শুভ সমুদ্রযাত্রার দেবী। এছাড়া ভেনাস নামটিও এসেছে সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্রহ ভেনাসের নাম থেকে। প্রাচীনকালে নাবিকরা এই গ্রহের অবস্থান নির্ণয় করেই সমুদ্রপথে চলাচল করতো। 

আফ্রোদিতির কলঙ্কজনক অধ্যায়

দেবরাজ্যে তখন ভীষণ কাড়াকাড়ি। সকলেই রুপের আধার ভেনাসের প্রেমে মশগুল। সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। সেই অবস্থাকে সুস্থির করতেই জিউস আর হেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আফ্রোদিতির বিয়ে দেবেন আগুন শিল্পের দেবতা হেফাইস্টুসের সাথে। ভেনাস আগে থেকেই ছিল ছলাকলায় পারদর্শী। জাদুকরী ক্ষমতার গুনে ক্ষণিকের মাঝেই প্রেমে ফেলত পুরুষদের। অপরকে প্রেমে পর্যুদস্ত করলেও নিজেকে সে সমর্পিত করতো না।

মোহনিয়া এই সুন্দরীর ভাগ্যে যখন হেফাইস্টুস জুটলো তখন থেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ভেনাস। তবে ছলনাময়ী এই দেবী বসে থাকার নয়। সেও এরেস, হারমেস, ডায়নসিস প্রমুখ দেবতার সাথে মিলিত হতে থাকলো। স্ত্রীর পরকীয়ার কথা জানলেও হেফাইস্টুস চুপ ছিলেন। তবে বুদ্ধি দক্ষতার গুনে দেবীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধও নেন তিনি। 

হেফাইস্টুস এমন একটি বিছানা তৈরি করেন যেখানে কেউ রতিক্রিয়ায় মত্ত হওয়া মাত্রই সোনার শেকলে আটকা পড়বে। একদিন এরেস আফ্রোদিতি যখন প্রবল প্রেমে মত্তপ্রায় তখন এই শেকলে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আটকা পড়ে তাঁরা। দেবপুরীর সকল দেবদেবীর সামনে আপত্তিকর অবস্থায় উপস্থিত হওয়ায় দুয়োও শুনতে হয় তাঁদের। তবে অপমানের ষোলোকলা পূর্ণ হয় তখনই যখন সূর্যদেব হেলিওস আচমকা এই জুটির উপর আলো ফেলেন। তবে দেবতা পসেইডন তাঁদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন।

প্রেমলীলায় মত্ত আফ্রোদিতি- এরেস; Photo Source: Ancient World Magazineআফ্রোদিতির প্রেমিক প্রবরের সংখ্যা অগুনতি। বহু মানবই তাঁর প্রেমে পড়ে উন্মাদের জীবন বেছে নিয়েছিলো। তাঁর সন্তান সংখ্যাও অল্প নয়। তবে সবচেয়ে খ্যাতনামা হলো এরস বা কিউপিড এরসের কাজও তীর ধনুক হাতে কপোত কপোতীর মাঝে প্রেম ঘটিয়ে দেয়া। এরসের বিপরীত এক দেবতাও আছে, যার নাম এন্টিরস। এর কাজ হলো প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বা আঘাত পেলে প্রতিহিংসার জন্ম দেয়া। এর বাইরেও এনচিসেসের সাথে অ্যানাস, বুটসের সাথে সিসিলির রাজা এরিক্স, এডনিসের সাথে প্রিপাসের জন্ম দেয় ভেনাস।

অ্যাডোনিস-আফ্রোদিতির প্রেম ও পরিণতি

এই প্রেম কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে যখন এসেরিয়ার রাজা সিনিরাস জনে জনে তাঁর কন্যার রূপের কীর্তন করতে থাকেন। কন্যা মিরহাকে তিন আফ্রোদিতির চেয়েও সুন্দরী বলে মানতেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কূটচাল আঁটেন ভেনাস। এরসের সাহায্যে মিরহাকে তাঁর পিতার প্রেমে ফেলেন এবং যৌন মিলনে উদ্বুদ্ধ করেন। সিনিরাস টের পেলে মিরাহকে হত্যার নির্দেশ দেন। ফলে মিরহা পালিয়ে যান। এসময় সে গর্ভবতী ছিল। নিজ অপকর্মের জন্য দেবতাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাঁরা মিরহাকে মিরহ গাছে পরিণত করেন। 

শিল্পীর তুলিতে আফ্রোদিতি- অ্যাডোনিসের প্রেম; Photo Source: Ancient Eu

নয় মাস পর মিরহ গাছ ফুঁড়ে জন্ম নেয় অ্যাডোনিস। মায়ের রূপ নিয়েই জন্ম হয়েছিল এই পুত্রের। অ্যাডোনিসকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়ে যান ভেনাস। অন্য দেবীদের দৃষ্টি থেকে লুকাতে অন্ধকার জগতের দেবী পারসেফোনের কাছে অ্যাডোনিসকে গচ্ছিত রাখেন। কিন্তু অ্যাডোনিস তারুণ্যে পা দিলে পারসেফোনেও তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। ফলে দুই দেবীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। জিউসই পরে এর সমাধান করেন। তাঁর নির্দেশমতে অ্যাডোনিস বছরের চারমাস থাকবে পারসেফোনের কাছে, চারমাস থাকবে আফ্রোদিতির সাহচর্যে আর বাকি চার মাস থাকবে নিজের ইচ্ছেমত যেকোনো স্থানে। 

অ্যাডোনিস ছিল শিকারে দক্ষ। আফকা জঙ্গলে শিকারের সময় এক শূকরের আক্রমণে মারা যায় সে। অ্যাডোনিসের ক্ষতস্থানে আফ্রোদিতি অমৃতসুধা মিশিয়েও শেষরক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু তাঁদের অমর প্রেমের স্মৃতি স্বরূপ জন্ম নেয় অ্যানেমন ফুল। এই ফুলের গন্ধ ভেনাসের অমৃতের মতো আর এর রং অ্যাডোনিসের রক্তের মতো তীব্র লাল। 

ট্রয়ের যুদ্ধে প্রভাব

ট্রোজান যুদ্ধের জন্য পরোক্ষভাবে হলেও আফ্রোদিতি দায়ী। তবে এই ঘটনার সূত্রপাত আরও আগে। দেবতা পেলেউস থেটিসের বিয়েতে বিবাদের দেবী এরিস একটি সোনার আপেল নিয়ে আসেন এবং সবচেয়ে সুন্দরী দেবীকে দেয়ার কথা জানান। এই প্রতিযোগিতায় এথেনা,হেরা এবং আফ্রোদিতিই ছিলেন শীর্ষে। শেষমেশ জিউসের আদেশে ট্রোজান রাজপুত্র প্যারিসের উপর দায়িত্ব বর্তায়। প্যারিস আফ্রোদিতিকে সেরা সুন্দরী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে দেবীও তাঁকে স্পারটার হেলেনের সাথে প্রেম ঘটিয়ে দেন। এদিকে হেলেন মেনেলাওসের স্ত্রী হওয়ায় প্যারিস তাঁকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসে। মেনেলাওস তাঁর ভাই আগামেননকে ট্রয় দখলের নির্দেশ দেয় ।এর ফলেই শুরু হয় ট্রয়ের যুদ্ধ।

ট্রয়ের যুদ্ধে- হেলেনকে হত্যা করতে যাওয়াও পুত্র এনাসকে সরিয়ে দিচ্ছেন ভেনাস; Photo Source: Ancient Home

শিল্পে ভেনাস

অবর্ণনীয় সুন্দরী দেবীর প্রেমে শুধু সমকালীন দেবতা মানুষই মত্ত ছিল না, যুগে যুগে সাহিত্যিকভাস্করচিত্রকরও তাঁদের কল্পনায় বহুবার প্রেমে পড়েছেন। জন কীটস, টেনিসন তাঁদের বহু লেখায় ভেনাসের উল্লেখ করেছেন। শেক্সপিয়র তাঁর লেখনীতে অ্যাডোনিসভেনাসের অপূর্ব প্রেমের শ্রেষ্ঠ বর্ণনা দিয়েছেন। হেসিওড তাঁকে বর্ণনা করেছেন সমুদ্রের ফেনা থেকে জন্ম নেয়া দেবী, হাস্যময়ী স্বর্ণালী প্রেমিকা হিসেবে। হোমারের ইলিওডেও ভেনাসের লাস্যময়ী রূপের প্রস্তাব পাওয়া যায়। 

‘ভেনাস ডে মিলো’ ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামের সংরক্ষিত; Photo Source: Wikipedia

ভাস্করদের হাতেও বারবার নির্মিত হয়েছেন কামনার এই দেবী। প্রথম দিকে ভেনাসকে বস্ত্রে সজ্জিত দেখানো হলেও পরবর্তী ভাস্করেরা তাঁকে নগ্না দেবী হিসেবেই নির্মাণ করতে থাকেন। এন্টিওকের আলেক্সজান্ডার নামক এক ভাস্কর নির্মিতভেনাস ডে মিলোহলো আফ্রোদিতির সবচেয়ে বিখ্যাত মূর্তি। গ্রিক সংস্কৃতিতে ভেনাসকে সম্ভ্রান্ত, ফুল সজ্জিত দেবী হিসেবেই দেখা হয়। 

চিত্রকরদের হাতে এখনও নিয়ত রঙিন হচ্ছেন আফ্রোদিতি। তাঁকে কেন্দ্র করে এত ছবি আঁকা হয়েছে যে সেগুলোর তালিকা করতেও গলদঘর্ম হতে হবে। তবে ১৪৮৬ সালে অর্থাৎ রেনেসাঁ কালে স্যান্ড্রো বত্তিচেলিরবার্থ অফ ভেনাসঅন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করেছে এই অপার রূপেরপ্রণয়ী দেবীর।

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *