ইতিহাস

পৌরাণিক জাপান: ভূমিকম্পের দৈত্য নামাজু1 min read

জুলাই ১৫, ২০১৯ 4 min read

author:

পৌরাণিক জাপান: ভূমিকম্পের দৈত্য নামাজু1 min read

Reading Time: 4 minutes

একটা সময় ছিল যখন সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকতো– ‘ভূমিকম্পের দেশ জাপান।তবে যতই দিন গেছে মানুষ জানতে পেরেছে জাপানকে। এখন অবশ্য জাপানকে আমরা সুশির দেশ কিংবা চেরি ব্লসমের দেশ হিসেবেই বেশি চিনি। জাপানের কৃষ্টিসংস্কৃতি, আকর্ষণীয় এনিমে, সুমো রেসলিং ইত্যাদিও ক্রমে আমাদের সামনে আসছে।

জাপানের রয়েছে সহস্র বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এর স্থাপত্য, চিত্রকলায় স্থানীয় প্রভাবের পাশাপাশি বৌদ্ধ দর্শনও প্রতিফলিত হয়েছে অনেকাংশে। তবে আর দশটা দেশের মতো এরও রয়েছে কিছু উপকথা, রুপকথা এবং পৌরাণিক গল্প। আজ শুনবো সেগুলোর একটির কথা–  ভূমিকম্পের দানব নামাজু। 

নামাজু কে? 

জাপানি পৌরাণিক মাগুর মাছের নামই হলো নামাজু। তবে নামাজুর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো সে ভূমিকম্প তৈরি করে। পানির নিচেই এর বাস। তাহলে ভূমিকম্প হয় কী করে? সাধারণত যখন এক মহাসাগর থেকে আরেক সাগর বা এক নদী থেকে আরেক নদীতে যায় নামাজু, তখনই থরথর করে কেঁপে ওঠে গোটা বিশ্ব চরাচর। মাঝে মাঝে সামান্য লেজ নাড়ানোতেই ভূকম্পন হয়।

ভূমিকম্পের প্রকোপে কেঁপে ওঠা জাপানের জন্য নতুন কিছু নয়। বিশ্বের মোট ভূমিকম্পের ১০ ভাগই হয় জাপানে। নামাজুর গল্প গড়ে ওঠার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।

নামাজুর বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হলো বিদ্যুতের দেবতা তাকেমিকাজুচিনোমিকোতো বা কাশিমা। এই কাশিমাই নামাজুকে মাঝে মাঝে ভয়ানক দুর্যোগে বাধা দেন। নাই নো কামি নামে জাপানিদের আরেক দৈত্যও আছেন যাকে প্রথম সপ্তম শতাব্দীতে দেখা যায় এবং নামাজুরই আরেক রূপ মনে করা হয়। পরে মেইজি রাজ্যকালে (১৮৬৮১৯১২) নামাজু থেকে আলাদা করে দেয়া হয়। 

জাপানি চিত্রকরের কল্পনায় কাশিমার নামাজু বধ; Image Credit: Wikipedia

দেবতা কাশিমা দাইমিয়োজিন এক অদ্ভুত পাথরের মালিক যার নাম কানামেইশি। নামাজু যখন অস্থির হয়ে ওঠে তখনই কাশিমা এই পাথর সর্বশক্তিতে চেপে ধরে মাছটির মাথায়। ফলে এর নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে যায়। টোকিওর অদূরেই কাশিমা মন্দিরীই পাথরের ১৫ সেন্টি মিটার অংশ সংরক্ষিত আছে। এমনকি নিয়ে জনপ্রিয় এক প্রবাদও আছে,’ মাটি কাঁপলেও ভয় পেয়ো না, কারণ কাশিমা এখনো কানামেইশি (পাথর) ধরে আছেন।অনেকটাবিপদে যেন না করি ভয়‘- এর মত সাহসের বাণী। 

এই মিথের সাথে যুক্ত আছে আরও গল্প। আরেক দেবতা তকুগাওয়া মিতসুকুনি একবার কৌতূহলের বশেই কানামেইশি পাথরের দৈর্ঘ্য মাপতে জলের তলে গিয়েছিলেন। টানা সাতদিনসাত রাত খোঁড়াখুঁড়ি আর খোঁজের পরও এর শেষ মাথা দেখতে পান নি। 

তবে নামাজু কিন্তু বছরের প্রতিদিনই আটকা থাকেনা কাশিমার পাথরে। প্রায়ই দেবতারা রাজ্যের এটা সেটা নিয়ে আলোচনা করতে বসেন ইজোমু মন্দিরে। নিয়মিতই সেখা যান কাশিমা। আর সে সুযোগেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে নামাজু। মাঝে সাঝে আবার অল্প লেজ নাড়ানোতেই ঘটে প্রলয়। তবে কাশিমাও কখনো অন্যমনস্ক আর ঝিমিয়ে যান। তখনও নামাজু ব্যগ্র হয়ে ওঠে। 

অনেক গল্পে বিশাল কুমড়া দিয়ে নামাজুকে আটকে রাখার কথাও আছে; Image Credit: SanAndreasFault

নামাজুর অন্যরূপ

ধ্বংস আর বিপর্যয়ের জন্য নামাজুকে দায়ী করা হলেও এর কিছু ভালো দিকও আছে। এই মাগুর মাছ কিন্তু পৃথিবীকে আবার নতুন করে শুরু করবার প্রেরণা জাগায়। জাপানিরা মনে করেন, এই কম্পনগুলোর ফলে ধনীগরীবের সমতা ফিরে আসে। জরা, মৃত্যু, ব্যাধি যে সব বয়সের, সব শ্রেণির জন্য সত্য তাই দেখিয়ে দেয় নামাজু। নতুন দুনিয়ার এই ভাবনাকেইয়ো নাওশিবলা হয়। 

এই ধারণা আসার পেছনে রয়েছে এক ছোট্ট ইতিহাস। এডো পিরিয়ড(১৬০০১৮৬৮) ঘটে যাওয়া টানা কিছু ভূমিকম্প তৎকালীন ধনীদের প্রচুর সম্পদের বিনাশ করে। আবার উল্টো দিকে গরীবেরা নতুন কিছু কাজের এবং অর্থ লাভের সুযোগ পেয়ে যায়। বলা যায়, তখন বৈষম্য অনেকাংশেই কমে আসে। 

তারা মনে করে, একসময় ধনীদরিদ্র বলে আলাদা কোন জাত থাকবেনা। সে জন্য কিছু ধর্মীয় আচারও পালন করে। অন্যের কাছ থেকে নানা সময় ধার করা দ্রব্য তারা অবশ্যই ফেরত দেয় এবং আচার পালন করেযাকেকুরমায়াঅনুষ্ঠান বলা হয়। তাদের বিশ্বাস, কারো প্রাপ্য ফেরত না দিলে নামাজু তাদের ক্ষতি করবে। 

জাপানে সতর্কতার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হিয় নামাজুর ছবি; Image Credit: Time Out

সংস্কৃতিতে নামাজুর গল্প

কাশিমা নামাজু জাপানি চিত্রকলার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাপানি বই, তৈজসপত্র, দেয়ালচিত্র সবখানেই নামাজুর জয়জয়কার। এডো পিরিয়ডেই এর চর্চা বেশি হয়। মানুষ তখন নিজেদের ঘরের দেয়ালে কাশিমানামাজুর ছবি এঁকে রাখতো এবং প্রার্থনা করতো। 

এর প্রভাব আছে এখনো। জাপানি এনিমেদ্য নামাজুতো এই মাগুর মাছকে নিয়েই নির্মিত। তাছাড়াও বিভিন্ন ছবি, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রে এর ছাপ পাওয়া যায়। ব্যঙ্গচিত্রেও এর বিশাল রাজ। অনেক শিল্পীই একেমোমের পুতুলবাবোকার হদ্দপ্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন এজেন্সিও সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপন ব্যানারে ব্যবহার করে নামাজুর ছবি। আর জাপানের রাস্তায় তো হামেশাই দেখা যায়সতর্কতা চিহ্ন’, সাথে নামাজুর মস্ত বড় ছবি

জাপানি কাঠ শিল্পে নামাজু ; Image Credit: KOZAK & CERMAK

নামাজুর অদল বদল আর শিক্ষা

১৮ শতকের দিক থেকে নামাজুকে হটিয়ে চীনাদের অনুকরণে ড্রাগন নিয়ে কড়চা শুরু হয়। তবে খুব বেশি টেকেনি। কারণ কল্পনার ড্রাগনের চেয়ে বাস্তবের মাগুর ছিল বিশ্বাসজনক। ১৮৫৫ সালে এই ধারণাকে পোক্ত করে অক্টোবরের ভূকম্পন। তখন থেকেই মনে করা হয়, জাপানে ধনীদের করা সব পাপের ফলই এই প্রলয়। এর মাধ্যমে নামাজু সম্পদের সমবন্টন নিশ্চিতের কথাই জানান দেয়।

১৮৫৫ সালের ভূমিকম্পে হাজার মানুষের মৃত্যু হয়; Image Credit: Vienna University

আরও কিছু নামাজু-কাশিমা

অনেক গল্পে দেখা গেছে, কাশিমা পাথর নয় তরবারি অথবা জাদুকরী কুমড়ার আঘাতে ধরাশায়ী করেছে নামাজুকে। তবে এই নাম ছাড়াও নামাজুর মতোই দুই দৈত্য আছে যার মধ্যে জিনশিন উও হলো আর জিনশিন মুশি হলো এক গুবরে পোকা। 

গল্প গল্পই। তবে সবদেশের উপকথা, পুরাণ ঘাঁটলেই বুঝবেন সেগুলো আসলে মানুষের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। এই যেমন নিরীহ মাগুর নামাজুর মাধ্যমে জাপানের ভূমিকম্প আর শ্রেণি বৈষম্যের গল্পই প্রতিফলিত হয়েছে এখানে। 

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *