বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত : মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা হয় যেভাবে1 min read

এপ্রিল ২৫, ২০১৯ 4 min read

author:

পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত : মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা হয় যেভাবে1 min read

Reading Time: 4 minutes

সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের দ্বারা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে। একটি সময় ছিল কোনো মানুষ অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে কিংবা কাউকে হত্যা করা হলে, ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর যথাযথ কারণ এবং কে বা কারা হত্যা করেছে, কিসের সাহায্যে কীভাবে হত্যা করেছে ইত্যাদি বিষয়গুলো অজানাই থেকে যেতো। কিন্ত এই বিজ্ঞানের প্রসারের কারণে বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে এই বিষয়গুলো আর অজানা থাকে না। একটি সময় ছিলো এগুলো জানতে পারা অসম্ভব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, এখন এসব বিষয় আমাদের কাছে সম্ভবপর এবং বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই সব তথ্যগুলো জানতে পারাকে যা সহজ করেছে, তাকে আমরা পোস্টমর্টেম, অটোপসি, নিক্রোপসি ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকি।

পোস্টমর্টেমের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ময়নাতদন্ত শব্দটি। কেনো পোস্টমর্টেমের প্রতিশব্দ ময়নাতদন্ত হলো তা নিয়েও রয়েছে রহস্য। পোস্টমর্টেম কী আজকের আবিষ্কার নাকি এর ইতিহাস সুদীর্ঘ? পোস্টমর্টেম কীভাবে করা হয়, কেন করা হয় এরকম আরও অনেক তথ্য জানতে আমাদের মন উৎসুক হয়ে থাকে। আমাদের এই মনের কৌতূহল পূরণ করাই এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য। এই লেখাটি পড়লে পোস্টমর্টেম  বিষয়ে আপনার ধারণা একেবারেই পরিষ্কার হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে চলুন পোস্টমর্টেম নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক-

পোস্টমর্টেম কী? 

পোস্টমর্টেম (Postmortem) শব্দটি অটোপসি(Autopsy), নিক্রোপসি (Necropsy), পোস্টমর্টেম এক্সামিনেশন (Postmortem Examination) ইত্যাদি শব্দের দ্বারাও বোঝানো হয়ে থাকে। অটোপসি(Autopsy) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটোপসিয়া (Autopsia) থেকে। মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করার পদ্ধতিকে বলা হয়ে থাকে অটোপসি। আর বাংলায় পোস্টমর্টেম, আটোপসি, নিক্রোপসি ইত্যাদি শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ময়নাতদন্ত শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র মানুষের দেহেরই ময়নাতদন্ত করা হয় না, বরং অন্যান্য জীবের মৃতদেহেরও ময়নাতদন্ত করা যায়। স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে সাধারণত ময়নাতদন্ত করা হয় না। অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-পতঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে তার মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করার জন্য এই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। অপরাধের ধরন এবং অপরাধীকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে এই ময়নাতদন্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুলিশের কাজে সহায়তা করার ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেমের বিকল্প কল্পনা করা কঠিন।

পোস্টমর্টেমের ইতিহাস

পোস্টমর্টেমের ইতিহাস বেশ সুপ্রাচীন। প্রাচীনকালের ঘটনা প্রবাহে চোখ রাখলে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে বর্তমানকালে ময়নাতদন্তকে যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালের উদ্দেশ্য ঠিক ভিন্ন ছিলো। প্রাচীনকালে সাধারণত ধর্ম, রাজনীতি, অশরীরী ও জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে পোস্টমর্টেমের নিবিড় সম্পর্ক  ছিলো। মৃতদেহ থেকে আত্মা ফিরিয়ে নিয়ে আসা, স্বপ্নে ভয় দেখানো, আমাবস্যার রাতে শব্দ করে ডাকাডাকি করা, পিচাশের আকৃতিতে মানুষের ক্ষতি করা ইত্যাদি বিষয়কে পুঁজি করে পোস্টমর্টেম নিয়ে বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসে তৈরি হয়েছে।

গ্রীসের হিপোক্রেট, মিশরের চিকিৎসক হেব্রিয়ান এবং চীন ও ইতালির কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি পোস্টমর্টেম নিয়ে বেশ কিছু বই রচনা করেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে মিশরীয়রা তাদের মমি তৈরির জন্য মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করতো। তাদের এ ময়নাতদন্তের উদ্দেশ্য ছিলো মূলত ধর্মীয় বিষয়। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পোস্টমর্টেম করার বিষয়টি চালু হয় গ্রিসে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে এবং রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর তার তদন্ত করা হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে। আবার প্রাচীনকালের আরবদের মধ্যে আন নাফিসের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আর আধুনিক কালে এসে ময়নাতদন্ত ব্যবস্থা প্রচলন করেন ইভোননি মরগাগনি। আর এই ব্যক্তিকেই ময়নাতদন্তের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

পোস্টমর্টেমকে কেনো বাংলায় ময়নাতদন্ত বলা হয়?

পোস্টমর্টেম শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে সরাসরি ময়নাতদন্ত শব্দটি ব্যবহার করা একেবারেই যুক্তিসংগত মনে হয় না। কিন্ত তারপরেও কেনো পোস্টমর্টেম শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলা ভাষায় ময়নাতদন্ত শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই কৌতূহল কাজ করে। ময়না পাখির গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং এদের ঠোঁট হলুদ হয়ে থাকে। ময়না পাখি কমপক্ষে তিন থেকে বারোটি  স্বরে ডাকতে পারে। ময়না পাখির গায়ের রং কালো হওয়ায় অন্ধকারের মধ্যে ময়না পাখির অবস্থান ঠিক বোঝা যায় না।  অন্ধকারের মধ্যে আপনি যদি ময়না পাখি চিহ্নিত করতে চান, তবে তার ডাক শুনে অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে। তাই  ময়না পাখির ডাক সম্পর্কে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ মানুষ ছাড়া কেউই অন্ধকারে থাকা  ময়না পাখিকে সনাক্ত করতে পারে না।

একইভাবে পোস্টমর্টেমের ক্ষেত্রেও একটি ব্যক্তির মৃত্যুর রহস্য ও কারণ অজানা বা অন্ধকারে থাকে। সেই অন্ধকার ও  রহস্যময় মৃত্যুর কারণসমূহ উদঘাটন করতে হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব সূত্রের মাধ্যমে; যা অনেকটা ডাক শুনে ময়না পাখি সনাক্ত করার মতোই। আর এই জন্যই পোস্টমর্টেমকে বলা হয় ময়নাতদন্ত।

পোস্টমর্টেমের ধরণ 

অস্বাভাবিকভাবে মৃত ব্যক্তির মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য পোস্টমর্টেম কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও পোস্টমর্টেমের বেশ কিছু ধরণ রয়েছে, যেমন:

১.মেডিকেল পোস্টমর্টেম

কোনো ব্যক্তি অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে, তার দেহ সাধারণত মেডিকেল পোস্টমর্টেম করা হয়ে থাকে। এটি আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে অধিক প্রচলিত একটি ময়নাতদন্ত পদ্ধতি।

২. ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম

কোনো ব্যক্তি অসুস্থতাজনিত মৃত্যুবরণ করলে এবং ঐ ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে যদি বিতর্ক তৈরি হয়, তবে যে পোস্টমর্টেম করা হয়, তাকে বলে ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম।

৩. একাডেমিক পোস্টমর্টেম

চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের  ময়নাতদন্ত বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর এ ধরনের ময়নাতদন্তকে একাডেমিক পোস্টমর্টেম বলা হয়।

পোস্টমর্টেমের কারণ

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের জন্য ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে। চলুন এবার আমরা এক নজরে ময়নাতদন্তের বিভিন্ন কারণগুলো জেনে নেই।

১. মৃত্যুর কারণ উদঘাটন, সেটা স্বাভাবিক হোক কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুই হোক।

২. মৃত্যুর সময় নির্ধারণ, মৃত ব্যক্তিকে কখন মারা হয়েছে বা সে মারা গেছে তা জানা।

৩. কীভাবে মৃত্যু হলো বা কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তা উদ্ঘাটন করা।

৪. মৃতদেহকে সনাক্ত করা।

৫. মৃত্যুর যন্ত্র বা অস্ত্র নির্ধারণ।

পোস্টমর্টেম করার প্রক্রিয়া

আতস কাঁচের মাধ্যমে গবেষণা করে মৃত দেহের প্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল, কেমিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল, সেরোলজিক্যাল ইত্যাদিসহ দৈহিক অঙ্গ-পতঙ্গের পরীক্ষণের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। সাধারণত পেশাদার চিকিৎসকগণ তথা ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসদের দ্বারা এই ময়নাতদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশের সাধারণত সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রফেসর, জেলা হাসপাতালের সিভিল সার্জন, সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে আবাসিক মেডিকেল অফিসার, এই ময়নাতদন্ত করে থাকেন। ময়নাতদন্ত করার জন্য পুলিশ কর্তৃক চালান, সুরতহাল রিপোর্ট, ডেথ সার্টিফিকেট, পুলিশকর্তৃক লাশ সনাক্তকরণ ইত্যাদির বিষয়ের প্রয়োজন হয়। আর ময়নাতদন্ত কার্যক্রম অবশ্যই দিনের আলোতে পরিচালনা করা হয়। ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে প্রথমে ডাক্তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। তারপর সুরতহাল রিপোর্ট পড়েন, এরপর মৃতদেহের বাহ্যিক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারপর মৃতদেহকে ব্যবিচ্ছেদ করে দেহের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অবশেষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে লাশ সেলাই করে দেওয়া হয়। মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করার পর চূড়ান্ত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লেখা হয়। আর এর মাধ্যমেই রহস্যময় পুরো ঘটনাটিকে তুলে ধরা হয়।

অপরাধী শনাক্তকরণ করা ছাড়াও বিভিন্নক্ষেত্রে  ময়নাতদন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে আমাদের দেশে ময়না তদন্তের কার্যক্রম অনেকটাই সেকেলে পর্যায়ে রয়ে গেছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়াকেও যুগোপযোগী ও আধুনিক করে তুলতে হবে, তবেই ময়নাতদন্ত থেকে আমরা প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারবো।

লেখক- আমিনুল ইসলাম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *