ইতিহাস

হারিয়ে যাওয়া পম্পেই শহর1 min read

জুলাই ১, ২০১৯ 4 min read

author:

হারিয়ে যাওয়া পম্পেই শহর1 min read

Reading Time: 4 minutes

হঠাৎ চোখ ধাঁধানো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো ভিসুভিয়াসের চূড়া। বিশাল কয়েকটা ফাটল দেখা গেল সেখানে। ফাটলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তরল আগুন। বিশাল নদীর মতো ঢেউ এর পর ঢেউ তুলে নেমে আসতে লাগলো শহরের দিকে। মানুষের তৈরি প্রাসাদ, মন্দির, পথ ঘাট ভেঙে, চুরে, গুঁড়িয়ে, পুড়িয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে আসতে লাগলো।‘ 

লর্ড লিটনেরলাস্ট ডেইজ অফ পম্পেই’- এভাবে বর্ণিত হয়েছে ইতালির শহর পম্পেই ধ্বংসের প্রারম্ভ। চলুন জেনে নেই ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া এই নগরের গল্প। 

পম্পেইয়ের যাত্রা

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে যখন গ্রীকরা এই শহরের গোড়াপত্তন করে তখন থেকেই বণিক শ্রেণির পছন্দের তালিকায় শীর্ষে এই শহর। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কারণেই নয়, ভ্রমণপ্রমোদের জন্যও খ্যাতি বাড়তে থাকে এর। রিসোর্ট আর প্রাসাদসম স্থাপত্যের জন্য পরিব্রাজক বাড়তে থাকে এখানে। ফলে নানারকম কারখানা, রেস্তোরাঁ, যৌনপল্লি গড়ে ওঠে। 

ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি থেকে  মাইল দূরে অবস্থিত এই শহরে বণিকপরিব্রাজক ছাড়াও স্থানীয়দের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০। পম্পেই সময়ের তুলনায় বেশ আধুনিকই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক স্থাপত্যের আদলে বেশিরভাগ দালান গড়ে ওঠে। ঘরগুলোও ছিল দৃষ্টিনন্দন। তবে সবচাইতে আকর্ষণীয় বোধহয় বাগানগুলোই ছিল। প্রতিটি বাগানেই থাকতো নান্দনিক সব দেব দেবীর মূর্তি শহরে ছিল বিনোদনের যথেষ্ট আধুনিক কিছু ব্যবস্থা এবং পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও। 

পম্পেইয়ের নাট্যশালা;
Image Source: Pexels

ভিসুভিয়াসের আঘাত

৭৯ সালের গ্রীষ্মকালে আচমকাই মৃত মাছ ভেসে উঠতে থাকে সারনো নদীতে, কুয়াপুকুর তাবৎ শুকিয়ে কাঠ, এমনকি বাগানের আঙুরলতাও ক্রমে শুকনো হয়ে যেতে থাকে। এতসব পূর্বাভাসের পরেও অধিবাসীরা অন্যস্থানে যাবার কথা ভাবেনি।

আগস্টের ২৪ তারিখে (অনেকের মতে অক্টোবর) আচমকাই ধোঁয়া বেরুতে থাকে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি থেকে। সকালের এই ঘটনাকে অনেকেই তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু দিনের মাঝামাঝি সময়েই বদলে যায় চিত্র। ভিসুভিয়াস থেকে ক্রমাগত ধোঁয়া উদগিরণ হতে থাকে, আকাশের প্রায় ২৭ মাইল ছেয়ে ফেলে সেই কালো রং। এরপরেই আসে সর্বশেষ আঘাত। 

ছড়িয়ে যাওয়া ধোঁয়া মাটিতে নামতেই ঢেকে ফেলে গোটা শহর। সেই মৃত্যু মেঘে আসলে ছিল একরাশ পাথর আর দাহ্য বস্তু। এর মাঝে অনেকেই ভিটে ফেলে পালাতে থাকেন। রাত টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ঘটে লাভার প্রবল উৎপাত।   আগ্নেয়গিরির লাভায় মুহূর্তের মধ্যেই গোটা শহর চাপা পড়ে যায়।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেশ অনেক সময় থাকলেও দূরদর্শিতার অভাবে মৃত্যু হয় হাজারেরও বেশি মানুষের। এই বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল হিরোশিমা বিপর্যয়ের প্রায় লক্ষ গুণ বেশি। 

আবার আবিষ্কার

পম্পেইয়ের পরিণতি সম্পর্কে উত্তরাধুনিক বিশ্ব বেশ অন্ধকারেই ছিল। ১৫৯২ সুয়ারেজ লাইন সারনো নদীর স্রোত বদলের জন্য বেশ খননকাজ চললেও মূল আবিষ্কার সামনে আসেনি। 

তবে মূল আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিল নেপলসের রাজা চার্লস বোরবন এবং তাঁর স্ত্রী মারিয়া আমালিয়া। নেপলসের রাজপ্রাসাদের বাগানে পৌরাণিক স্থাপত্য দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এই দম্পতি। তবে এক ফরাসি রাজপুত্রের তাগাদায় ৩০ বছর আগে ভিসুভিয়াসের কাছে বেশ খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছিল। তবে সেটা বেশিদূর এগোয়নি। পরে সেই সূত্র ধরেই এগোয় রাজদম্পতি। পাশাপাশি ১৭৪৮ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিকের আগ্রহে বের হয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া শহর পম্পেই। 

৬০ ফুট লাভা প্রস্তরের নিচ থেকে বের হয়ে আসে নকশা করা থামব্রোঞ্জ নির্মিত ঘোড়া এবং একরাশ সিঁড়ি। ক্রমেই প্রকাশ্যে আসতে থাকে হারিয়ে যাওয়া শহর হারকিউলেনিয়াম। খননের ফলে আলোর সামনে আসে গোটা পম্পেই শহর। 

পম্পিয়ে ছাই হওয়া মানুষ; Image Source: Jauting Jen

প্রত্নতত্ত্ববিদ সি ডব্লিউ সেরাম তাঁরGods, Graves and Scholars: The Story of Archaeologyবইয়ে লেখেন

শহরের সড়ক জুড়ে ছড়িয়ে ছিল সোনা আর রূপার মুদ্রা এর পাশেই কংকাল। বোঝাই যাচ্ছিল সম্পত্তি বাঁচাতে মরিয়া ছিল তারা‘ 

বিস্ময়ের ব্যাপার , লাভার আগুনে একটুও বদলায়নি সেগুলো। উল্টে ছাইয়ের নিচে অবিকল সংরক্ষিত হয়েছে সেসব। তৈজসপত্র, বাগান, দালান, মন্দির, সাজ সরঞ্জামাদি সব অগ্ন্যুৎপাতের বিভীষিকার আগের অবস্থাতেই পায় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। এমনকি সেসময় চুলায় কী রান্না হচ্ছিল তাও স্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায়। আর এক ঝুড়ি ভর্তি ফল রুটিও আবিষ্কার করে ফেলেন পুরাবিদেরা। 

আজকের পম্পেই, পেছনে ঘাতক ভিসুভিয়াস; Image Source: Blue Grotto Tours

১৮৬০ সালে ইতালিয় প্রত্নতত্ত্ববিদ জিসেপ ফিওরেলি প্রাপ্ত দেহগুলোতে প্লাস্টার লাগিয়ে অভঙ্গুর আঁকার দেন। তাঁর কাজ এতই নিখুঁত হয় যে, দুর্যোগের সময় মৃত ব্যক্তিদের মুখের অঙ্গভঙ্গি, ভয়আতংক সব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। 

প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ ছিল পুরাতাত্ত্বিকদের জন্য একেবারে তথ্যের খনি। সমগ্র শহর খোঁড়ার পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেকালে ব্রোঞ্জই ছিল মূল ধাতু। লোকজন বেশ কিছু স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগতো। এর মাঝে শীর্ষে ছিল দাঁত ক্ষয়। এছাড়াও ম্যালেরিয়া, অপুষ্টি, হাড় ক্ষয় এবং অতিরিক্ত কাজের ফলে ঘাড় কাঁধের ক্ষতি ছিল উল্লেখযোগ্য। 

আজকের পম্পেই

পম্পেইয়ের দুর্যোগের পরেও ডজন খানেকবার  ভিসুভিয়াস ক্ষেপে উঠেছিল। তবে শেষবার জাগ্রত হয়েছিল ১৯১৩১৯৪৪ সালের মধ্যে। এরপরে যদিও কোন জাগরণের চিহ্ন পাওয়া যায় নি, তবে এটি এখনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি হিসেবেই পরিচিত। এর আশেপাশে এখন প্রায় মিলিয়ন লোকের বাস। ২৫০ বছর ধরেই ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে পরিচিত এই প্রাচীন শহর। 

ইউনেস্কো পম্পেইকেবিশ্ব ঐতিহ্যেরমর্যাদা দেয় ১৯৯৭ সালে। প্রতি বছর প্রায় আড়াই মিলিয়ন পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে এই মৃত শহর। এখনো এর অনেক অংশ অনাবিষ্কৃত, ক্রমেই নানান উপকরণ খুঁজে পাচ্ছেন আবিষ্কর্তারা। 

রোমান সাম্রাজ্যের বৈভবের শহরের দেয়াল চিত্র আর অভাবনীয় স্থাপত্য দেখতে ঘুরে আসতে পারেন পম্পেই। দেয়াল ছুঁয়ে হয়তো আপনারও মনে হবে, দুই হাজার বছর আগে নয়, যেন গতকালই আঁকা

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *