বিশ্ব

নেলসন ম্যান্ডেলাঃ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক1 min read

জুন ১১, ২০২০ 4 min read

author:

নেলসন ম্যান্ডেলাঃ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক1 min read

Reading Time: 4 minutes

“টুয়েলভ ইয়ারস অ্যা স্লেভ” চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? ২০১৩ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ১৮৫৩ সালের নিগ্রোদের উপর দাসপ্রথার বিভীষিকাময় এক চিত্র। বর্ণবাদের আয়েশে দাসপ্রথার নির্মমতা কাঁদিয়েছিল সকল দর্শককে।

তৎকালীন বর্ণবাদের আগ্রাসী পরিস্থিতি কাঁদিয়েছিল আরেকজনকে। বাধ্য করেছিল সংগ্রামের পথ বেছে নিতে। মানুষটি তার সারাজীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন কালো এবং সাদা চামড়ার বৈষম্য দূর করতে। লোকে তাকে ভালবেসে ডাকে “মাদিবা”। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। প্রকৃতপক্ষে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজনীন, সারা দুনিয়ার মানুষের নেতা। তাঁর আর্দশকে ধারণ করে আজও এগিয়ে চলছে সংগ্রামশীল মানুষ।

১৮ জুলাই, ১৯১৮ সাল। ব্রিটিশ দক্ষিণ আফ্রিকার মভেজোর এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ম্যান্ডেলা। ইস্টার্ণ কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর ছিলেন তাঁর বাবা। তৎকালীন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রমিক হিসাবে শাসকগোষ্ঠী জন্য করতে হতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কয়েকজন সৌভাগ্যক্রমে পেত পড়াশোনার সুযোগ৷ নেলসন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন৷ রাজবংশের সন্তান হিসাবে ভর্তি হয়েছিলেন মিশনারী স্কুলে।

স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন ফোর্ডহেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেখানে থেকেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ১৯৪৩ সালে মাদিবা যোগ দেন আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) নামক সংগঠনটিতে। ১৯১২ সালে শুরু হওয়া এই সংগঠনটির মূলমন্ত্র ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধী চেতনা জাগ্রতকরণের মাধ্যমে বৈষম্যবাদী আফ্রিকান সরকার পতন। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনটি ছিল গান্ধীজীর অহিংসবাদে বিশ্বাসী। ম্যান্ডেলা যোগদানের পরপরই এএনসিতে আসতে থাকে ব্যাপক পরিবর্তন। বলতে গেলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল বীজটি বপন করেন তিনিই।

১৯৪৮ সালে ক্ষমতায় আসে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ন্যাশনাল পার্টি। বাড়তে থাকে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের বর্বর অত্যাচার। বিরোধিতার অগ্নি দাউদাউ করে জ্বলে উঠে মাদিবার মনে৷ ১৯৫২ সালে এএনসির ডাকা সম্মেলনে প্রথমবারের মতো নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৫৫ সালে জনগণের সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি মুক্তি সনদ প্রণয়ন করেন তিনি। এতে ক্ষেপে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার।
১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মাদিবাসহ ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে চলা এ মামলায় তারা একজনকেও দোষী প্রমাণ করতে পারেনি।

১৯৬০ সালে শার্পভিল শহরে নিরীহ শ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ৬৯ জন। এ ঘটনার পর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন তখন প্রশ্নবিদ্ধ। এ সময় এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিস্ফল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ২৫ বছর পূর্তিতে ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা

১৯৬১ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-এর সশস্ত্র শাখার নেতৃত্বে আসেন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এতে বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনে গেরিলা যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা নেন। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন সরকার ১৯৬২ সালে এএনসিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে।

শ্রমিক ধর্মঘটে উষ্কানি দেওয়া ও অবৈধভাবে দেশত্যাগের কারণে ১৯৬৩ সালে সহযোদ্ধাসহ গ্রেফতার করা হয় মাদিবাকে। আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেদিন মাদিবা বলেছিলেন,

‘আফ্রিকার মানুষের লড়াইয়ের জন্য আমি আমার এই পুরো জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধেও। আমি সেই গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের জয়গান গেয়েছি, যেখানে সবাই সমান সুযোগ নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকবে। এটা এমন এক আদর্শ, যা আমি অর্জন করতে চাই, যার জন্য বাঁচতে চাই আমি। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, এটি সেই আদর্শ, যার জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।’

পরবর্তীতে রোবেন দ্বীপে ২৭ বছর ধরে খেটেছিলেন সশ্রম কারাদণ্ড। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ম্যান্ডেলার কারাদন্ড যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো ছিল। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর মুক্তির দাবিতে গড়ে উঠতে থাকে আন্দোলন। দিনদিন পরিস্থিতি ঘোলা হতে থাকে এবং এক সময় তা ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা মুভমেন্ট’ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে অধিগত হয়।

এসবের মধ্যে করা হয় মাদিবাকে হত্যার ষড়যন্ত্র। কিন্তু জন্মই যার আজন্ম মৃত্যু তাকে হত্যা করা সহজ ছিলনা। কারাগারে থেকেই তিনি আন্দোলনে নেতৃত্বের পাশাপাশি আইনে স্নাতক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৮৫ সালে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়ার শর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড মওকুফের সুযোগ বিনা দ্বিধায় প্রত্যাখান করেন তিনি। ২৭ বছর কারাবাসের পর ১৯৯০ সালে ১১ ফেব্রুয়ারী কারামুক্ত হন। জাতির উদ্দেশ্যে সেদিনের ভাষণেও অতীত ভুলে জানিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ ও কৃষাঙ্গদের সম্প্রীতির আহ্বান।

একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ অন্যান্য বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে ম্যান্ডেলার ফলপ্রসূ শান্তি আলোচনার সুবাদে ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। সেইসাথে দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ারও সম্মান লাভ করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা এবং এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককে ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন ম্যান্ডেলা। ততদিনে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পরেছে সমগ্র বিশ্বব্যাপী। কিন্তু এত অর্জনের পরেও তিনি জীবনে সর্বদাই ছিলেন অমায়িক, বিনয়ী ও খাঁটি মানবতাবাদী একজন মানুষ।

২০০৪ সালে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন মাদিবা। আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন এবং বিভিন্ন মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করতেন। তিনি দারিদ্র দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল প্রতিবাদমুখর। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ব্যাপক সমালোচনা করার পাশাপাশি মার্কিনীদের বিভিন্ন কপটতার বিরুদ্ধেও অপকটে নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন আপোষহীন এ মানুষটি।

২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ভক্তকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এ কিংবদন্তী। এ সময় তার বয়স ছিল ৯৫। মাদিবার মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০ দিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংগ্রামে মুক্তির বন্ধুর পথে আজীবন হেঁটেছেন ম্যান্ডেলা। রেখে গেছেন বিশ্বনেতা হওয়ার অকৃত্রিম নিদর্শন। বিশ্বকে বুঝাতেন চেয়েছেন -“সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। মনুষ্যত্বকে আজীবন ভালবেসে বলে গেছেন-” ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।’

লেখক- ঐশ্বর্য মীম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *