সাহেদ আলম,
নিউইয়র্কের সানি সাইডে বসবাস করা এক বাংলাদেশী কাগজপত্রহীন নাগরিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলছিল বেশ কয়েকদিন।ফেব্রুয়ারীর শুরুতে যেদিন আদালত তার বিরুদ্ধে চলা মামলায় তাকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে, সেদিন-ই তার বাসার সামনে থেকে গ্রেফতার করে ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস পুলিশ। পাঠিয়ে দেয় নিউজার্সির ডিটেনশন সেন্টারে। সেখানে আগে থেকেই বন্দী ছিলেন, কুইন্স এর হলিস এর বাসিন্দা রিয়েলেটর কাজী আরজু এবং নিউজার্সি থেকে গ্রেফতারকৃত আমিনুল ইসলাম। আটলান্টিক সিটিতে বসবাস কারী আরো একজন বাংলাদেশী সহ নিউজার্সির এই ডিটেনশন সেন্টারে থাকা প্রায় ১২ জন বাংলাদেশীকে ৫ ফেব্রুয়ারী নিয়ে যাওয়া হয়েছে টেক্সাসের লুইজিয়ানায়। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ছাড়াও, টেক্সাস, পেনসিলভেনিয়া, ক্যালিফোনিয়া, মিশিগান , ফ্লোরিডার নানান জায়গা থেকে আটক করা এমন বাংলাদেশীদের সংখ্যা ৫০-৬০ জন হবে বলে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারীর ১২ তারিখে ইমিগ্রেশন পুলিশের অনিয়মিত ফ্লাইট করে, তাদের সবার গন্তব্য এখন বাংলাদেশের পথে। সংশ্লিষ্টদের পরিবার, অভিবাসন অধিকার কর্মী, আর আইনী পরামর্শকদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
আমেরিকার মুলধারার মানবাধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর বড় সহযোগী সংগঠন ‘ড্রাম’র একজন বাংলাদেশী সংগঠক কাজী ফৌজিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এখন যেটা হচ্ছে সেখানে, আগে থেকে আটক থাকা ডিটেনশন সেন্টারগুলি খালি করা হচ্ছে।নিউজার্সিতে ১৯ মাস আটক থাকার পর এক পাকিস্থানীকেও পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে এই ১২ তারিখের ফ্লাইটে। এমনকি ডিপোর্টেশন বিরোধী আন্দোলনের নেতা ল্যাটিন আমেরিকার অভিবাসী রাজীব রাগবীরকেও (যিনি বাংলাদেশী রিয়াজ তালুকদারের ডিপোর্টেশন আন্দোলনে শীর্ষে ছিলেন) পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জেনেছি। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, এখন সামান্য অপরাধ রেকর্ড আছে এমন কাগজপত্রহীনদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেননা, এরই মধ্যে ডিটেনশন সেন্টারগুলিতে আটকদের পাঠিয়ে দেয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।এগুলো শেষ হলেই সাধারন আনডকুমেন্টেড বা কাগজপত্রহীনদের ধর পাকড় শুরু হতে পারে।
ব্রঙ্কস এ বসবাসকারী বাংলাদেশী আমেরিকান আইনী পরামর্শক নাসরিন আহমেদ জানিয়েছেন, ডিপোর্টেশন যদিও একটি চলমান প্রক্রিয়া তবে আগের চেয়ে এটা এখন অনেক বেড়েছে।সাধারন অপরাধীদের ডিপোর্টেশন হার এখন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন কারীদের বেলায়ও ডিপোর্টেশন রায় বেড়েছে অন্তত ২০ ভাগ। এমন অনেক বিচারক ছিলেন, যাদেরকে আমরা চিনতাম যে তারা অভিবাসী বান্ধব, সামন্য যুক্তি আর কাগজপত্র উপস্থাপন করলেই যার কাছে কেইস এপ্রুভ হয়ে যেত, তিনিও এখন ডিপোর্টেশন রায় দিচ্ছেন বেশি বেশি। সব কিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে তারা ‘অভিবাসন বিরোধী স্রোতে ঢুকে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইনজীবিরা এমন সব বিষয় যুক্তি তর্কে নিয়ে আ্সছেন, যেখানে বিচারকরা প্রভাবিত হচ্ছেন ডিপোর্টেশন রায় দিতে।
এই পাঠিয়ে দেয়া সম্পন্ন করতে ইমিগ্রেশন দপ্তর নিবিড় ভাবে কাজ করছে দুতাবাসগুলির সাথে। গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ২৩টি দেশের সাথে ডিপোর্টেশন কার্যকর করার চুক্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সেই চুক্তি অনুযায়ী যে যেই দেশের নাগরিক তাদেরকে সেই দেশ গ্রহন করবে বলে বলা আছে। গত বছরে, যুক্তরাষ্ট্রের এল পাসো কারাগারে অনশনকারী বাংলাদেশীদের একসাথে দেশে ফেরত পাঠানোর পর, এবার-ই প্রথম বড় আকারের আরো একটি দল বাংলাদেশে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। পরিবারগুলিতে এখন একেবারে ভেঙ্গে পড়ার কান্না প্রতীয়মান হয়েছে।
কাজী আরজুর স্ত্রী উম্মে হানি লুবনা’র সাথে এই প্রতিবেদকের যখন কথা হয় তখন তিনি একটি দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন ‘আসলেই তার আর এখানে থাকার কোন উপায় নেই ?’। লুবনা জানান, আরজু’র সাথে টেলিফোনে তার কথা হয়েছে, এখন তাকে টেক্সাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সাথে অনেক বাংলাদেশীকেও সেখানে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডিপোর্টেশন এ মানবিকতাও রক্ষা হচ্ছে কম
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য গ্রেফতার করা কাগজপত্রহীন বাংলাদেশী নাগরিকদের আইনী সুরক্ষার পথ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়েছে। কাজী আরজুর স্ত্রী উম্মে হানি লুবনা জানান, আমার স্বামী ২৫ বছর ধরে এই দেশে বসবাস করছেন, ট্যাক্স পরিশোধ করেছেন।তার ৩টি সন্তান যারা এই দেশের পার্সপোর্টধারী নাগরিক, আমি নিজেই এই দেশের নাগরিক। ছোট মেয়েটি স্কুলে কান্না কাটি করে এজন্য আমাকে ৩ বার স্কুল থেকে ডেকেছে। আমি সব বলেছি তাদের। এই সন্তানরা যেন বাবার আদর স্নেহ থেকে বন্চিত না হয় সেজন্য আমি আবেদন করতে চেয়েছিলাম স্থানীয় কংগ্রেস অফিসে।তারা প্রমান হিসেবে বাচ্চার স্কুল থেকে একটি চিঠি নিয়ে আসতে বলেছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব কিছুই জানে, তবুও তারা আমার বাচ্চার পক্ষে একটি চিঠি দিতে অপরাগতা জানিয়েছেন। এমনকি, কারাগারে আটক অবস্থায় কাজী আরজুর সাথে প্রতি মিনিট কথা বলতে গিয়ে প্রায় ৬০-৭০ ডলার করে খরচ করতে হচ্ছে।আমেরিকার নাগরিক হয়েও তার সন্তানেরা তাদের বাবার পক্ষে কথা বলতে পারবে না কেন, এই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নিউজার্সি থেকে গ্রেফতার হওয়া আমিনুল হকের এক মেয়ে, দুই ছেলে। বড় মেয়ে ইভানার বয়স ১৯ বছর। সে ইউনিয়ন কাউন্টি কলেজে পড়ছে। একটি ফার্মেসিতে খন্ডকালীন কাজও করছে ইভানা। কিন্তু বাবার গ্রেফতারে তার ভবিষ্যত এখন অনিশ্চয়তার মুখে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে গ্রেফতার করায় তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন রোজিনা আক্তার। আমিনুল হক ২০০৪ সালে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এরপর এখানে তার ছোট ছেলের জন্ম হয়। এখন উপার্জনক্ষম পিতার অবর্তমানে এসব পরিবার কিভাবে দিন কাটাবে সেই চিন্তায় দিশেহারা আমিনুলের স্ত্রী আর সন্তানেরা।
এমন একটি সময়ে খুব কম মানুষের পক্ষেই জোরালো আন্দোলন হচ্ছে অথবা এটি নিয়ে গনমাধ্যমে কথা হচ্ছে। সর্বশেষ কানসাস থেকে গ্রেফতার হওয়া একজন রশায়নের প্রফেসর সৈয়দ জামিলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মুল ধারার সবগুলো গনমাধ্যম এক যোগে প্রতিবেদন প্রকাশ করেলেও, তার ভাগ্যে কি জুটবে সেটা বলা যাচ্ছে না। সৈয়দ জামালের তিন সন্তানের ভবিষ্যত বলা চলে অন্ধকার ,কেননা, তার স্ত্রী বেচে আছেন মাত্র একটি কিডনি নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে ডিপোর্টেশন হলে, পরিবারগুলি যেখানে আমেরিকায় জন্ম নেয়া সন্তানেরা আছেন তাদের অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে সেটারও কোন দিক নির্দেশনা নেই।
আইসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ২০ জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আড়াই লাখ অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা কয়েক শত হতে পারে। এছাড়া, গ্রেফতার ও বহিষ্কারের আতংকে আরো ৫/৬ হাজার বাংলাদেশী স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন। এদের অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন কানাডায়।