বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

চীনের আকাশে কৃত্রিম চাঁদ  1 min read

আগস্ট ১৬, ২০১৯ 3 min read

author:

চীনের আকাশে কৃত্রিম চাঁদ  1 min read

Reading Time: 3 minutes

সৌরজগতের নিয়মানুযায়ী পৃথিবীতে নির্দিষ্ট ২৪ ঘন্টাকে দিন ও রাতের হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। কখনো দিন বড়, কখনও বা রাত বড়। আবার কোন কোন সময় উভয়ই সমান। এভাবেই দিন ও রাতের হিসাবের কথা মাথায় রেখে এ গ্রহের সমস্ত কাজকর্ম পরিচালিত হয়। তবে এবার দিন-রাতের পার্থক্য কমাতে  কৃত্রিম চাঁদ বানাচ্ছে চীন। কী অবাক কাণ্ড! চীনের আকাশে থাকবে না কোন অমাবস্যা। সবসময়ই পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাবে চীন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়, মহাকাশ বিষয়ক বেসরকারি একটি কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের মধ্যেই তারা এটিকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করতে চান। মূলত বিদ্যুতের উপর চাপ কমাতে এবং রাতের আঁধার কমিয়ে আনতে এ ধরণের উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংডু শহরে অবস্থিত তিয়ানফু নিউ ডিস্ট্রিক্ট সিস্টেম সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান ইউ চুনফেং এবিসি সংবাদ সংস্থাকে জানান, ২০২০ সালের মধ্যে তিনটি কৃত্রিম চাঁদ তৈরি করবে চীন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃত্রিম চাঁদ তিনটি মহাকাশে পাঠানো হবে। তিনি আরো বলেন, কৃত্রিম চাঁদগুলো স্থাপিত হলে প্রতিবছর প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

চাঁদগুলো হবে মূলত স্যাটেলাইট বা উপগ্রহের মতো। এগুলোর গায়ে থাকবে বড় বড় আয়না। এসব আয়না দিয়ে সূর্যের আলোকে চাঁদের চেয়ে আটগুণ বেশি প্রতিফলিত করে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে দেবে। আয়না থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোক প্রায় ৩৬০০-৬৪০০ এলাকা আলোকিত করবে। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ৩৮০,০০০ কিলোমিটার দূর থেকে। আর চীনা মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কৃত্রিম চাঁদগুলোকে পৃথিবী থেকে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে বসানো হবে। তবে কোন কক্ষপথে কীভাবে রাখা হবে তা এখনও ঠিক হয় নি।

শুধু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ই নয়, কৃত্রিম চাঁদের ব্যবস্থা করলে যেসব এলাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেসব এলাকায় কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা যাবে। রাতে বিভিন্ন ধরণের জরুরি উদ্ধার কাজেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই কৃত্রিম চাঁদ। আলো এতটাই তীব্র হবে যে, রাতের বেলা চলাচলের জন্য আর কোন অতিরিক্ত বাতি বসাতে হবে না।

কৃত্রিম চাঁদ উৎক্ষেপনের সফলতা নিয়ে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেস সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষক ড. মাত্তেও সিরিওত্তি বলেছেন, কৃত্রিম চাঁদ বসানো সম্ভব। তিনি আরো যোগ করেন, যে উদ্দেশ্যে এটি মহাকাশে পাঠানো হবে সেটি পূরণ করতে হলে কৃত্রিম চাঁদটিকে চেংডুর আকাশে স্থায়ীভাবে থাকতে হবে। কিন্তু এই বিশাল মহাকাশে সেই নির্দিষ্ট স্থানটি খোঁজা মোটেও সহজ কিছু নয়। একমাত্র সমস্যা হলো শতভাগ ফল পেতে হলে এটাকে একেবারে সঠিক জায়গায় স্থাপন করতে হবে। যদি সামান্য এদিক সেদিক হয় তাহলে সেই আলো অন্য এলাকায় গিয়ে পড়বে।”

সব জিনিসেরই ভালো দিকের পাশাপাশি মন্দ দিকও থাকে। কৃত্রিম চাঁদের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। অনেকেই এটাকে তামাশা বলেও মন্তব্য করেছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন কৃত্রিম চাঁদের ফলে দিন-রাতের তারতম্যে পার্থক্য হয়ে পৃথিবীর জীবনচক্রে বিঘ্নতা ঘটতে পারে। আবার অনেকেই বলছেন, এর ফলে রাতে চলাচলকারী বা নিশাচর প্রাণিরা বিভ্রান্ত হবে। চীনে অনেক শহরে আলোর দূষণ ঘটে গেছে। এই কৃত্রিম চাঁদ বসানোর ফলে সেটা আরো তীব্র হবে। ড. সিরিওত্তি নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন, “আলো যদি খুব বেশি উজ্জ্বল হয় তাহলে সেটা রাতের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করবে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে প্রাণিরা।

চুনফেং ছাড়াও হারবিন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিচালক ক্যাং ওয়েইমিন পিপলস ডেইলিকে বলেছেন, কৃত্রিম চাঁদের আলো হবে অনেকটা সন্ধ্যার আলোর মতো। তাই প্রাণিকূলের উপর তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে সফলভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে এবং প্রকৃতির ওপর যাতে কোন বিরূপ প্রভাব বা পড়ে তা নিশ্চিত করতে এ ব্যাপারে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানান চুনফেং। তিনি বলেছেন, “আমরা আমাদের পরীক্ষাগুলো চালাব জনমানবহীন একটি মরুভূমিতে। যাতে কৃত্রিম চাঁদের আলো মানুষ বা অন্য কোন কিছুর ক্ষতি করতে না পারে।”

মহাকাশ নিয়ে চীনের মতো এ ধরণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প এই প্রথম নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এর আগে রাশিয়া ১৯৯০ সালে দিনের আলো না পাওয়া রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের সাইবেরিয়ার কয়েকটি শহরে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করার এরকমই একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সেজন্য তারা বিশেষ পদ্ধতির আয়না স্থাপন করেছিল যা সূর্যের আলো প্রতিফলিত করতে সক্ষম। কিন্ত পরবর্তী সময়ে বায়ুমণ্ডলের প্রভাবে আয়নাটি তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে সে প্রকল্প বাতিল করা হয়। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতো।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রকেট ল্যাব’ আকশে একটি কৃত্রিম নক্ষত্র স্থাপন করে। কিন্তু আলো দূষণ ও পৃথিবীর কক্ষপথে জটিলতা সৃষ্টির জন্য বিজ্ঞানীরা মানবসৃষ্ট ওই নক্ষত্রের সমালোচনা করেন। তবে চীনে কৃত্রিম চাঁদ স্থাপনের ক্ষেত্রে এ ধরণের সমস্ত বিতর্ককে বিজ্ঞানী চুনফেং তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, যেহেতু পুরো প্রকল্পটিই মানবসৃষ্ট তাই একে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও মানুষের থাকবে। আর এ চাঁদগুলোকে পৃথিবী থেকে উজ্জ্বল তারার মতোই লাগবে।

লেখক- নিশাত সুলতানা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *