বিনোদন

একজন ক্রিস্টোফার নোলান এর গল্প 1 min read

আগস্ট ৭, ২০২০ 5 min read

author:

একজন ক্রিস্টোফার নোলান এর গল্প 1 min read

Reading Time: 5 minutes

“ইউ ক্যান টেল আ লট অ্যাবাউট পিপল ফ্রম দেয়ার স্টাফ” –ফলোয়িং(১৯৯৮)

একজন নিজ শহরের আশপাশের মানুষের ব্যপারে ব্যাপক আগ্রহ বোধ করতো। তিনি জানতে চাইতেন তাঁদের গল্প। এরই মাঝে একদিন তাঁর এপার্টমেন্টে চুরি হয়। সেই চুরি হওয়ার ঘটনায় হতাশ হওয়ার পরিবর্তে লোকটি উল্টো খুঁজে পায় অনুপ্রেরণা। ছিঁচকে চোরের জায়গায় বসিয়ে দেন এক গল্পকারকে। যে কিনা অপরিচিত লোকের পেছনে গল্পের জন্য ঘুরে বেড়ায়। এরপর তা নিজের মতো করে সাজিয়ে লিখে ফেললেন একটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট।

মাত্র ৫ হাজার ডলারে সেই কাহিনী অবলম্বনে বানান ৬৯ মিনিটের একটি সাদাকালো সিনেমা। সেই সিনেমা মুক্তির পর মাস ঘুরতেই আয় করে বসে ৫০ হাজার ডলারের বেশি! সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের হয়ত এতক্ষণে ধরে ফেলার কথা কার কথা এতক্ষণ বলা হয়েছে। তিনি দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্রকার, পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান।

আজকের দিনে তাঁর নির্মিত ‘ফলোয়িংকে বিবেচনা করা হয় ক্লাসিক ন্যয়ার (Noir) হিসেবে। এটি নোলানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। ফলোয়িং এর আগেই অবশ্য নোলানের সিনেমায় হাতেখড়ি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তার প্রথম নির্মাণ করা শর্টফিল্মের নাম ‘ডুডলিবাগ’। এরপরের বছর বানান ‘ফলোয়িং’।

৫ হাজার ডলারে প্রথম নির্মিত সিনেমা ফলোয়িং আয় করে ৫০ হাজার ডলারের বেশি

ফলোয়িং পর্ব শেষ হতে না হতেই নোলানের ভাই জোনাথন তাঁকে একটি গল্প শোনান। মূলত জোনাথনের শিকাগো থেকে লস এঞ্জেলসে কার ভ্রমণে গিয়ে এই গল্পের আইডিয়া আসে। জোনাথনের ‘মেমেন্টো মোরি’ নামক অদ্ভুত সুন্দর সে গল্পে দেখা যায় বিরল অ্যামনেশিয়া (স্মৃতিশক্তিজনিত সমস্যা) আক্রান্ত এক লোকের স্ত্রী হত্যার প্রতিশোধের কাহিনী। পর্দায় ‘মেমেন্টো’ নাম নিয়ে একেবারে ব্যতিক্রমভাবে নোলানের পরিচালনায় সেই গল্পের উপস্থাপন দর্শক দেখতে পায় এই শতাব্দীর শুরুতে ২০০০ সালে। আর এই সিনেমা দিয়েই নোলান প্রথিতযশা সমালোচক, চলচ্চিত্রকার আর প্রযোজকদের চোখে পড়েন।

‘মেমেন্টো’র খাতিরে পরবর্তীতে নোলান তাঁর তৃতীয় সিনেমায় অভিনেতা হিসেবে পেয়ে যান আল পাচিনো, রবিন উইলিয়ামস আর হিলারি সোয়াঙ্কের মত হলিউডের অনন্য অভিনয় শিল্পীদের। সিনেমার নাম ‘ইনসোমনিয়া’। ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত এক পুলিশের সিরিয়াল কিলার ধাওয়া করার গল্প দেখে দর্শক।

৫ হাজার ডলার দিয়ে শুরু করা নোলানের এই সিনেমার বাজেট উন্নীত হয় ৪৫ মিলিয়ন ডলারে। সেই সাথে ছিল পরীক্ষিত খ্যাতিমান কলাকুশলী। আর এতে করে ক্যারিয়ারের দৌড়ে এগিয়ে আসে নোলান। ইনসোমনিয়া বক্স অফিসে ১১৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে।

ডিসি কমিক্সের অমর সৃষ্টি ব্যাটম্যানকে ঘিরে নোলানের ছিল সবসময়েরই আগ্রহ। সেই ব্যাটম্যানকে পর্দায় নতুন ঢঙে উপস্থাপন করে দর্শককে আরেকবার তাক লাগিয়ে দেন নোলান। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় ‘ব্যাটম্যান বিগিনস”। ব্যাটম্যান চরিত্রে পারফেকশনিস্ট খ্যাত ক্রিশ্চিয়ান বেলের চমৎকার অভিনয় আর নোলানের দারুণ জমজমাট স্ক্রিপ্টের ফলে বক্স অফিসে এটি আয় করে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এরপর প্রযোজক ‘নিউমার্কেট ফিল্মস’ ও বন্ধু অ্যারন রাইডারকে নিয়ে নতুন প্রজেক্টে হাত দেন। ক্রিস্টোফার প্রিস্ট নামক এক লেখকের বইয়ের নাম ছিল ‘দ্য প্রেস্টিজ’। মূলত ভিক্টোরিয়া আমলের দুই জাদুকরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বইটির উপজীব্য। একই নামের সিনেমায় ২০০৬ সালে নোলান আবারো পর্দায় হাজির করেন ক্রিশ্চিয়ান বেল আর উলভারিন খ্যাত হিউ জ্যাকম্যানকে। সাথে ছিলেন স্কারলেট জোহানসেন। বরাবরের মতই দর্শক সমাদৃত হয় সিনেমাটি।

নোলানের এরপরের সিনেমা আবার ব্যাটম্যানকে নিয়ে। ব্যাটম্যান বিগিনসের পর নোলান এর সিকুয়েল হিসেবে আনেন ‘দ্য ডার্ক নাইট’। সুদর্শন হিথ লেজারকে খলনায়ক জোকারের চরিত্রে শুরুতে অনেকে মেনে নিতে না পারলেও স্থিরচিত্র আর ট্রেলারের ঝলক দেখে দর্শক আর টু শব্দটি করতে পারেনি। আর ২০০৮ সালে মুক্তির পর গোটা দুনিয়ায় একে নিয়ে শুরু হয় বিশাল মাতামাতি।

‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমার সেটে

প্রথমবারের মত দুনিয়া প্রত্যক্ষ করে একজন হিরোর চাইতে ভিলেনকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে বেশি। দর্শক আর সমালোচকদের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা ভিলেনের তকমা জোটে দ্য ডার্ক নাইটের জোকারের। জোকারকে ধারণ করতে নিজের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হিথ লেজার পরে আত্মহত্যা করে বসেন। কিন্তু এক জোকার চরিত্র দিয়েই ভক্তকুলের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন তিনি। আর সেজন্য প্রথমবারের মতো কোনো কমিক বুকের চরিত্রে অভিনয় করে হিথ লেজার পেয়ে যান শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রের অস্কার। ১৮৫ মিলিয়ন ডলারের বাজেটের সিনেমাটি আয় করে এক বিলিয়ন ডলার। আর সেই সাথে দ্য ডার্ক নাইট পরিণত হয় কিংবদন্তীতে।

এরপর নোলানের সিনেমার পরবর্তী সিনেমা ‘ইনসেপশন’ আসে ২০১০ সালে। এই সিনেমার উপজীব্য স্বপ্ন। মূলত এই কাহিনী নোলানের মাথায় এসেছিল প্রায় ৯ বছর আগে। কিন্তু তখন কারিগরি দক্ষতা আর বাজেট স্বল্পতার অভাবে তার এই প্রজেক্ট করার দুঃসাহস দেখাননি তিনি। স্বপ্নের মধ্য স্বপ্ন- এমন কিছু দেখার জন্য যেন মোটেও প্রস্তুত ছিল না দর্শক। আর তাঁতে যেন নোলানীয় ঢং এর সিনেমায় বুঁদ গোটা দুনিয়ার সিনেমাপ্রেমীরা।

একে একে মেমেন্টো, ব্যাটম্যান বিগিনস, দ্য প্রেস্টিজ, আর দ্য ডার্ক নাইটের মতো সুপারহিট সিনেমার পর ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ব্যাটম্যান সিরিজের তৃতীয় কিস্তি ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’-এ  নোলান কিছুটা হতাশ করেন দর্শকদের। আর এতে ব্যাটম্যান ট্রিলজির সফল সমাপ্তিও হয়নি দর্শকের মন মতো। কিন্তু নোলান তো আর হাল ছাড়ার লোক নন। তিনি এরপর হাত দেন সায়েন্স ফিকশন নির্মাণে।

বসবাসের উপযুক্ত আরেক পৃথিবীর সন্ধানে যাওয়া একদল মহাশূন্য গবেষকের নানান  চড়াই উৎরাইয়ের গল্পের সাথে বাবা মেয়ের মধ্যকার আবেগের দারুণ সংমিশ্রণ দর্শককে একইসাথে হতবাক আর মুগ্ধও করেছে। একেবারে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র মেনে নিজের মতো করে বাস্তবধর্মী গল্প অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। পাঠক হয়ত ধরে ফেলেছেন এতক্ষণে যে ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমার কথাই বলা হচ্ছে। এর নান্দনিক আর বাস্তবধর্মী উপস্থাপন একে এ যাবতকালের অন্যতম সেরা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার তকমা দিয়েছে। আর সমালোচকদেরও পছন্দের তালিকায় উঠে আসে এটি। ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ইন্টারস্টেলার।

স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন- এমন জটিল ধারণার ওপর ভিত্তি করে বানান ‘ইনসেপশন’

এতকাল ধরে কল্পকাহিনী নিয়ে সিনেমা বানানো নোলান এবার তার পরের সিনেমা বানালেন বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে তৈরি এই সিনেমার নাম ‘ডানকার্ক’। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রক্তের হলিখেলাকে এড়িয়ে নোলান সিনেমাটিকভাবে দেখালেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানব বিপর্যয়ের করুণ দিক। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে ডানকার্কে নয় দিনের লড়াইয়ে নাৎসি বাহিনী আর মিত্রবাহিনীর যুদ্ধে কয়েক হাজার সৈন্যের মৃত্যুর বিষয়টি আশ্চর্য মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেন নোলান। ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ডানকার্ক।

নোলানের নতুন যে সিনেমাটি সামনে আসছে সেটি ‘টেনেট’। ইতিমধ্যে তার ট্রেলার আর ফার্স্টলুক ঝড় তুলেছে সিনেমাপ্রেমীদের মনে। সিনেমা বানানোর এই ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে নোলান মুক্তি দিয়েছেন সাকুল্যে ১০টি সিনেমা। সেসব থেকে ২৬টিরও বেশি বিভাগে তাঁর সিনেমা অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে আর বাগিয়ে নিয়েছে সাতটি অস্কার।

এছাড়া আইএমডিবি রেটিং এ সেরা ২৫০টি সিনেমার মধ্যে নোলানের নির্মাণ করা ১০টির ৭টি সিনেমা জায়গা করে নিয়েছে। এরমধ্যে ইনিসেপশন ,দ্য ডার্ক নাইট ও দ্য প্রেস্টিজ সেরা দশের তালিকায় আছে।

হলিউডের স্রেফ ফ্যান্টাসি, একশন আর যৌনতা নির্ভর সিনেমার ভিড়ে আলাদা করে একেবারে নিজস্ব দক্ষতায় বানানো সিনেমার আলাদা ফ্যানবেজ বানিয়ে ফেলা নোলানের ব্যক্তিগত পরিচয় জানা যাক এবার।

১৯৭০ সালের ৩০শে জুলাই লন্ডনে জন্ম নেওয়া নোলানের পুরো নাম  ক্রিস্টোফার জোনাথন জেমস নোলান। নোলানের মা আমেরিকান আর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ। ফলাফল বেড়ে ওঠা দুই দেশেই। মূলত উদ্ভিদবিদ্যায় আগ্রহ থাকা নোলানের বাবার ক্যামেরা হাতে পেয়ে ভিডিও করার নেশা পেয়ে বসে। তাইতো ৭ বছর বয়সেই সুপার এইট ক্যামেরা দিয়েই ভিডিওর কাজ শুরু করেন।

১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘স্টার ওয়ার্স’ নোলানকে ভীষণ মুগ্ধ করে আর সিনেমায় আগ্রহী করে তোলে। ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন নোলান। ১৯ বছর বয়সে এমা থমাস নামের এক নারীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে নোলানের। আর ২৭ বছর পর দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দুজন মিলেই বানান নিজেদের প্রোডাকশন হাউজ ‘SYNCOPY INC’।

নোলানের সিনেমার স্ক্রিপ্টে হাত আছে তার ভাই জোনাথন নোলানের। ভীষণ চা প্রেমী নোলান লাল সবুজ কালার ব্লাইন্ড। ২০১৫ সালের টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তির তকমা পাওয়া নোলান ব্যক্তিগত জীবনে চার সন্তানের জনক।

জেনে অবাক হবেন তার নাকি ব্যক্তিগত কোনো সেলফোন নেই এমনকি নেই কোন ই-মেইল। কাজের ক্ষেত্রে শতভাগ আপোষহীন নোলান বাজেটের মধ্যে কড়া গন্ডায় উসুল করে নেন কাজ। যেন বাজেটের চেয়ে বাড়তি এক টাকাও না খরচ হয়। এছাড়া ভীষণ গোপনীয়তার সাথে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি।

একজন পরিচালক যখন সিনেমা বানান তখন তিনি সচরাচর মাথায় রাখেন দর্শকের রুচির কথা । কিন্তু নোলান যেন তা নিয়ে মোটেও ভাবতে রাজি নন। তিনি নিজস্ব আইডিয়া দর্শককে দেখান নিজস্ব ঢং এ। অত্যন্ত কৌশলে যত্ন করে বানানো নোলানের সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য দেখতেও তাই দর্শক যেন সদা সতর্ক। ক্ষণিকের জন্য অন্যমনষ্ক হলেই যেন সিনেমা বলে বসে,’’আর ইউ ওয়াচিং ক্লোজলি”!

এই অল্প সময়ে চমৎকার সব সিনেমা বানিয়ে হলিউডে যে সামর্থ্য দেখিয়েছেন তার ফলেই কোয়েন্টিন টারান্টিনো, মার্টিন স্করসেসি কিংবা স্ট্যানলি কুব্রিক এর মত পরিচালকদের নামের পাশে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। তাঁকে নিয়ে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন জীবিত কিংবদন্তীরাও। একইসাথে সৃষ্টিশীল, ভিন্নধর্মী গল্পের উপস্থাপন আর ব্যবসাসফল হওয়ার বিরল এক দৃষ্টান্ত ক্রিস্টোফার নোলান। তাইতো তার নির্মিত সিনেমাগুলো গোটা বিশ্বে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসা করেছে।

লেখক- মাহের রাহাত

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *