ইতিহাস

কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ: যে যুদ্ধে ছিল না অস্ত্রের কারসাজি1 min read

অক্টোবর ১১, ২০২০ 6 min read

author:

কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ: যে যুদ্ধে ছিল না অস্ত্রের কারসাজি1 min read

Reading Time: 6 minutes

‘যুদ্ধ’ বলতেই আমাদের মাথায় আসে অস্ত্রের কারসাজি, সামরিক শক্তি, কৌশলগত আক্রমণ কিংবা প্রাণহানি। তবে  আধুনিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী যুদ্ধে না ছিল সরাসরি অস্ত্রের ব্যবহার, না ছিল প্রাণহানীর মতো ঘটনা। ক্রমাগত উত্তাপ ছড়িয়েছে দুই পক্ষ। কৌশলের সাথে একের পর এক চাল দিয়েছে দুই পক্ষ। এ যেন দাবার বোর্ডে দুই দক্ষ দাবাড়ুর যুদ্ধ। বলছিলাম কোল্ড ওয়ারের কথা। যে যুদ্ধে দুই প্রতাপশালী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেতে উঠে একের পর এক প্রতিযোগিতায়। তাদের প্রতিযোগিতা ছিল পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে, মহাকাশের দখল নিয়ে। যা মানুষকে দেখিয়েছে স্পুৎনিক আর অ্যাপোলোর মত মহাকাশযান।

মনে রাখা দরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানিকে ঠেকাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছিলো। কিন্তু যুদ্ধের সময়ই দুই পক্ষ টের পায় এক দেশ আরেক দেশের জন্য কতটা ভয়ানক প্রতিপক্ষ হতে পারে। বিশেষ করে এই চিন্তাটি প্রথম আসে সোভিয়েতের মাঝে। সোভিয়েতকে নিজেদের অস্তিত্ব নিজেদেরই টেকাতে হতো। বিশেষ করে হিটলার রাশিয়া দখল করার পর সোভিয়েত বুঝতে পারে তাদের কোন মিত্র নেই। বরং যেকোন সময়েই আসতে পারে বড় আঘাত। দেশের সব মানুষকে আর্থিক ও সামরিক নিরাপত্তা দিতে জোসেফ স্ট্যালিন গ্রহণ করেন কম্যুনিজমের ধারা।

অন্যদিকে যুদ্ধের পর পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে নিজেদের গড়ার দিকে মন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই সাথে তারা কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্ত অবস্থান নেয়। দ্বন্দে জড়িয়ে পরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ যেখানে ধনিক শ্রেণীর জন্য কিংবা শিল্পায়নের সহায়ক পরিবেশ দেয়, সেখানে সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্য হলো সবাই সমান।

একটি টেলিগ্রাম এবং সোভিয়েত দমননীতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো কেবল। এই সময়েই মার্কিন কূটনৈতিক জর্জ কিগ্যান বিশাল এক টেলিগ্রাম পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে। বিশাল সেই টেলিগ্রামের মূল বক্তব্য ছিল, আমেরিকা যদি সোভিয়েত হুমকি কাটিয়ে উঠতে চায়, তবে তাদের দরকার হবে কঠোর দমননীতি। তার বক্তব্য ছিল, যেহেতু যুদ্ধের পর পূর্ব জার্মানি বা জাপানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সোভিয়েত খুব একটা সমীহ দেখাচ্ছে না, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনভাবেই সোভিয়েতদের আগ্রাসী মনোভাবকে এড়িতে যাওয়া চলবে না। তার প্রস্তাবনা ছিল, একটি দীর্ঘমেয়াদী পর্যায়ে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে দমননীতি গড়ে তোলে। ১৯৪৭ সালের তার এক টেলিগ্রামই গড়ে দেয় স্নায়ুযুদ্ধের ভিত্তি।

১৯৪৯

১৯৪৯ সালটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এ বছরেই জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়- পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। পশ্চিম জার্মানি ছিল যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের দখলে, অপরদিকে পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েতের দখলে। এমনকি বার্লিন শহরকেও দু’ভাগে বিভক্ত করে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।

এ বছরেই সোভিয়েতের আগ্রাসন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে ন্যাটো গঠন করে। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্রের কথা বিশ্বকে জানায়।

অপরদিকে ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং এর হাত ধরে চীনে কম্যুনিস্ট সরকার গঠিত হয় এবং জন্ম নেয় পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। এতে সেসময় পুরো দুনিয়াজুড়ে কার্ল মার্ক্সের কম্যুনিজমের ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে কম্যুনিস্টরা সরকার গঠন করে। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকাতেও কম্যুনিজমের চেতনায় উদবুধ চে গুয়েভারা ও ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতো বিপ্লবী নেতার জন্ম হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র সমস্যা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী নীতির কারণে দেশটিতে প্রচুর শিল্পায়ন হচ্ছিল। বিনিয়োগের জন্য ছিল সুস্থ পরিবেশ। অন্যদিকে কম্যুনিস্ট দেশগুলোও একই নীতি অবলম্বন করায় তাদের নিজেদের মাঝে বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমেই উন্নত হচ্ছিল। যার কারণে অনেকটা বিপাকে পড়তে হচ্ছিল মার্কিনীদের। এ কারণেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সরাসরি সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের, NSC-68 রিপোর্ট অনুযায়ী সুপারিশ করা হয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের। এই রিপোর্ট মূলত প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের ইচ্ছেরই প্রতিফলন ছিল। ‘যেখানেই সমাজতন্ত্র সেখানেই প্রতিরোধ’ নীতি করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পা রেখেছিল ভিয়েতনাম পর্যন্ত।

পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী। অন্যদিকে স্ট্যালিন বুঝতে পেরেছিলেন, রাশিয়ার দুর্দিনে রাশিয়াকে দেখার মতো কেউই নেই। তাই রাশিয়াও  তৈরি হতে থাকে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য। ১৯৪৯ সালে রাশিয়া প্রথমবারের মতো নিজেদের ক্ষেপনাস্ত্র পরখ করে। সাথে সাথেই পাল্টা জবাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ঘোষণা করেন, আমেরিকা এরচেয়ে বড় এবং বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করবে। আরো বেশি ধ্বংসাত্মক সেই হাইড্রোজেন বোমা বা সুপারবোমা যেদিন পরখ করা হয় সেদিন রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছিল সবার।

মার্শাল আইল্যান্ডে চালানো প্রথম পরীক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাইড্রোজেন বোমা ২৫ বর্গ মাইলের এক ধোঁয়ার কুন্ডলী তৈরি করেছিল। সাগরতলে তৈরি করেছিল বিশাল এক গর্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতই আগ্রাসী হয়ে পড়ে যে মার্কিন জনগণ ভীত হয়ে পড়ে।সোভিয়েত হামলা করতে পারে এই ভয়ে  অনেক আমেরিকানদের বাড়িতেই তৈরি করা হয়েছিল বোম শেল্টার। মার্কিন স্কুলে চলতো ড্রিল কার্যক্রম।

যদিও এই ক্ষেত্রে শেষ হাসি হেসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই। মার্কিনিদের হাতে থাকা বিজ্ঞানী এবং প্রজেক্ট ম্যানহাটন তাদের এতই এগিয়ে রেখেছিল যে, রাশিয়া একসময় পারমাণবিক অস্ত্রের প্রশ্নে পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়। তবে সোভিয়েতের হাতে যে ক্ষমতার পারমাণবিক অস্ত্র ছিল সেটিও হেলাফেলা করার মতো কিছু ছিল না। পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে দু’দেশই নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানতো। তাই দুনিয়ার অনেক জায়গায় তারা প্রক্সি যুদ্ধে মেতে উঠলেও সরাসরি যুদ্ধে যাবার সাহস কেউই দেখায় নি।

ভূমি ছাড়িয়ে মহাকাশে

পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশেও দুই দেশ জড়িয়ে পড়েছিল এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায়। বিশ্বযুদ্ধের পর অন্য গ্রহে  মানব বসতির পরিকল্পনা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সেই সাথে শুরু হয় চন্দ্র অভিযান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এগিয়ে ছিল এই কাজে। নিয়মিতভাবেই জানানো হচ্ছিল তাদের অগ্রগতি। কিন্তু পাশার প্রথম দান দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নই। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন আচমকা ঘোষণা দেয়, তারা স্পুৎনিক নামের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে। বিষয়টি মোটেই সহজভাবে নেয়নি আমেরিকা। এছাড়া যে মিসাইলের মাধ্যমে রাশিয়া এই কাজ করেছিল তাও ছিল বিপজ্জনক। সতর্ক হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি চলে আসে নিরাপত্তার প্রশ্নও। পরের বছরই আমেরিকা উৎক্ষেপণ করে কৃত্রিম উপগ্রহ- এক্সপ্লোরার ১। সেই সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার এর আদেশে গঠিত হয় নাসা। তবে প্রথম মানুষ পাঠানোতেও এগিয়ে ছিল রাশিয়া। ইউরি গ্যাগরিন মহাকাশে উড়াল দেন ১৯৬১ সালের এপ্রিলে।

আইজেনহাওয়ারের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন কেনেডি। কেনেডির সময় স্নায়ুযুদ্ধ পেয়ে যায় অন্য এক মাত্রা। কম্যুনিস্ট দেশ কিউবার সাথে সংঘাত, ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে খুন করতে চাওয়া, সেই সাথে সোভিয়েতের সাথে বিরোধও চরমে উঠে। কেনেডির সময়ে ১৯৬৯ সালে প্রথম চাঁদে পা রাখে মার্কিন নভোযান অ্যাপোলো ১১। যেটি ছিল সোভিয়েতকে ডিঙ্গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় জয়।

স্নায়ুযুদ্ধের অন্যান্য যত দিক

স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাস্ট্র-সোভিয়েত সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও বিভিন্ন প্রক্সি যুদ্ধে ঠিকই একে অপরকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মূলত এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার যেসব দেশে কলোনিয়াল সরকার ছিল, সেসব দেশের কম্যুনিস্ট দলগুলোকে তাদের সমর্থন দিতো। অপরদিকে গণতন্ত্রের গান গাওয়া যুক্তরাষ্ট্র কম্যুনিজমের ধারা বন্ধ করতে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকার চালিত দেশগুলোকে তাদের সমর্থন দিতো। ইরান, গুয়েতমালা, ডমিনিকা, চিলি, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের স্বৈরাচারী সরকার সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছিল।

১৯৫০ সালে সোভিয়েতের পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তর কোরিয়ার ব্ল্যাক আর্মি পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ চালায়। একে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক আগ্রাসন হিসেবে। সেসময় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান দক্ষিণ কোরিয়ায় সেনা মোতায়েন করেন। এবং ১৯৫৩ সালে এই বিরোধ মীমাংসা হয়।

১৯৫৫ সালে ন্যাটো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানিকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে। রাশিয়া পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আলবেনিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি এবং বিশেষ করে পূর্ব জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে WARSAW নামের আরেকটি সামরিক জোট তৈরি করে। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি। কারণ সামরিক দিক থেকে ন্যাটো অনেক বেশি এগিয়ে ছিল।

১৯৫৯ সালে লাতিন আমেরিকান দেশ কিউবাতে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে কম্যুনিস্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো ক্ষমতায় আসে। যেটি যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। যার ফলাফল স্বরূপ ১৯৬০ এর পর কেনেডি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে কিউবান মিসাইল, বে অফ পিগস অভিযানের মতো বড় কিছু ঘটনা সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে মার্কিনীদের আগ্রাসন ফুটিয়ে তোলে। যদিও এক্ষেত্রে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো টিকে যান কিউবায় আর হার মানতে হয় মার্কিনীদের।

এছাড়া  ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসন ঠেকাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন দেয়। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ১৯৭৫ সালে আমেরিকা সে যুদ্ধে হার মানে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের নবগঠিত কম্যুনিস্ট সরকারকে সাহায্য করতে সোভিয়েত সেদেশে তাদের সৈন্য পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র সেসময় আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট সরকার বিরোধী মুজাহিদিনদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সরাসরি সমর্থন দেয়।

আরও পড়ুন- ভিয়েতনাম যুদ্ধ- স্বাধীনতার লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস

আরও পড়ুন- সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ

আরও পড়ুন- ‘দ্য বে অব পিগস ইনভেশন’ : পিগ উপসাগর আক্রমণ

আরও পড়ুন- ১৯৬৯: চীন-সোভিয়েত ইউনিয়ন সীমান্ত যুদ্ধ

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান

১৯৬০ এর দশকে চীনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে যুক্তরাষ্ট্র ছিল তৎপর। ১৯৭২ সালে প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিচার্ড নিক্সন চীনে সফর করেন। এতে দুদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এর আগে দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয় নি।

১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েতের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য Strategic Arms Limitation Talk (SALT) শীর্ষক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার নিউক্লিয়ার অস্ত্র কমিয়ে আনতে হবে মর্মে চুক্তি হয়।

কিন্তু সত্তর দশকের শেষের দিকে SALT2 নামের আরেক চুক্তির সময় ঝামেলা দেখা দেয়। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মুখোমুখি অবস্থান নেয়। যদিও আগের চুক্তি মোতাবেক এই সামরিক আগ্রাসন বন্ধ থাকার কথা ছিল। ১৯৮০ সালের দিকে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্নায়ুযুদ্ধ আবারও শুরু হয়। সে সময়েই রকি ফোর, স্টার ওয়ার্সের মত বিভিন্ন চলচ্চিত্র বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মার্কিনীদের মাঝে সোভিয়েত বিদ্বেষের বীজ প্রবেশ করানো হয়।

রোনাল্ড রিগ্যান সামরিক ক্ষাতে খরচ অনেক বাড়িয়ে দেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতো খরচ করা সম্ভব ছিল না। এছাড়া সেসময় যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক প্রযুক্তির “Strategic Defense Initiative Plan” হাতে নিয়েছিল। সব দিক থেকেই সোভিয়েত পরিস্কারভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পিছনে পড়ে যাচ্ছিল।

১৯৮৫ সালে মিখাইল গরবাশেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হন। গরবাশেভ এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি অস্ত্রের চেয়ে জনগণকে বেশি ভালবেসেছিলেন। একে একে মিসাইল আর পারমাণবিক অস্ত্র থেকে সরে আসেন গরবাশেভ। সেই সাথে স্টালিনের প্রবল পশ্চিমাবিরোধী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে চালু করেন উদার নীতি। তিনি বাক-স্বাধীনতা, স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও তিনি পরিবর্তন নিয়ে আসেন।

এর প্রেক্ষিতে নমনীয় হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানও। ১৯৮৬ সালে আইসল্যান্ডে এবং ১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটনে গরবাশেভ এবং রিগ্যান দুটি বৈঠকের মাধ্যমে অবসান ঘটান স্নায়ুযুদ্ধের। ১৯৮৯ সালে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। একই বছর বার্লিন ওয়াল ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৯০ সালে পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি আবারো এক হয়ে যায়।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ, হাসান উজ জামান

আরও পড়ুন- সোভিয়েত ইউনিয়ন: পতিত পরাশক্তি

আরও পড়ুন- কেন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *