বিশ্ব

কালাহারি মরুভূমি ও স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশল1 min read

ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০ 4 min read

author:

কালাহারি মরুভূমি ও স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশল1 min read

Reading Time: 4 minutes

সভ্যতার ছিটেফোঁটা এখনো যেখানে পৌঁছায়নি তার নাম কালাহারি মরুভূমি। কালাহারি সম্পর্কে আংশিক কিছু ধারণা পেয়েছিলাম “The Gods Must be Crazy (1980)” মুভিটা দেখার মাধ্যমে। সেই কালাহারির আদ্যোপান্ত নিয়ে পাঠকদের কিছুটা ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

ভৌগোলিক অবস্থান

আফ্রিকান ভাষায় Dorsland বা তৃষ্ণার্ত অঞ্চল বলা হয়ে থাকে এই মরুভূমিকে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের মালভূমিতে অবস্থিত একটি অববাহিকার মত সমতল ভূমি এটি। বতসোয়ানার প্রায় পুরো অঞ্চল, নামিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এক তৃতীয়াংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নর্দার্ন কেইপ প্রদেশের সর্ব উত্তরের অংশটুকু এর মধ্যে রয়েছে। কালাহারি উত্তর দক্ষিণে সর্বোচ্চ ১০০০ মাইল পর্যন্ত দীর্ঘ এবং পূর্ব পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০০ মাইল। ছোট করে বললে কালাহারি মরুভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বৃহত আধা-শুকনো বালুকাময় নিষ্পাদপ প্রান্তর যা ৯,৩০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৩,৬০,০০০ বর্গ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত, বোতসোয়ানা, নামিবিয়ার বেশিরভাগ অংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে এর অবস্থান।

A satellite image of the Kalahari by NASA World Wind

জলবায়ু

উত্তর এবং পূর্বে শুকনো বন, উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের বৃক্ষহীন তৃণভূমি ও লবনের হ্রদ বিরাজমান। কালাহারির জলবায়ু আংশিক শুষ্কের চেয়ে বেশি আর্দ্র।

দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশের উদ্ভিদগুলি মূলত জেরিক স্যাভানা (উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের তৃণভূমি) অথবা বলা যায় ওখানকার জলবায়ু আংশিক-মরুভূমি ও আংশিক-শুষ্ক অঞ্চল। যার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি বা তার সমান হয়। মরুভূমির চূড়ায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। শীতকালীন মৌসুমে কালাহারির মাসিক তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে। বলে রাখা প্রয়োজন, বছরের মোট ছ’মাসই সেখানে শীতকাল।

কালাহারিয়ান জলবায়ু কেন গ্রীষ্মমন্ডলীয় নয় তার ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে এর উচ্চতাকে যুক্ত করা হয়; উচ্চতা ৬০০ থেকে ১৬০০ মিটার (সাধারণত ৮০০ থেকে ১২০০ মিটার)। যার ফলে সাহেল বা সাহারার চেয়ে শীতল জলবায়ু থাকে। সাধারণত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এখানে শীতের তুষারপাত হয়, যা উষ্ণ সাহেলিয়ান অঞ্চলগুলিতে খুব কমই দেখা যায়। একই কারণে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা অবশ্যই খুব উষ্ণ হতে পারে, তবে সাহেল বা সাহারার নিম্ন উচ্চতার অঞ্চলের তুলনায় নয়।

প্রাণী

কালাহারিতে রয়েছে নানান প্রজাতির পশু-পাখি। সিংহ ও চিতা বাঘের মতো শিকারী প্রাণীদের থেকে রক্ষা পেতে হাতি থেকে জিরাফ বা অন্যান্য বন্য প্রাণীর জন্য উপযোগী আশ্রয়স্থল এটি। কালাহারির নদীর তীর গুলোতে এখন বেশিরভাগই চরাঞ্চল, যদিও চরাঞ্চল গুলোতে এখনও চিতা বাঘ পাওয়া যায়।

image.jpegOryx gazella. Photo © Jaro Nemčok

দক্ষিণ গোলার্ধের মরুভূমির মধ্যে, কালাহারিটি অক্ষাংশ এবং এর গঠনের পদ্ধতির সাথে অস্ট্রেলিয়ান কিছু মরুভূমির সান্নিধ্যের সাথে মিল রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশ গঠনের পাশাপাশি কালাহারি মরুভূমি প্রায় ষাট মিলিয়ন বছর আগে অস্তিত্ব লাভ করেছিল। তবে বলে হয়ে থাকে কালাহারিতে কিছু স্থানীয় প্রজাতির বণ্য প্রানী রয়েছে যা শুধু অই অঞ্চলেই দেখা মিলে এই যেমন; সিংহ (Panthera leo), চিতা বাঘ (Acinonyx jubatus), Leopard [চিতা বা গুলবাঘ বলা হয়] (Panthera pardus), দাগযুক্ত হায়েনা (Crocuta crocuta), বাদামী হায়েনা (Hyaena brunnea) এবং কেপ বন্য কুকুর (Lycaon pictus pictus)।

মানুষ

কালাহারি নিয়ে জানা ও‌ লিখার আগ্রহটা মূলত ওখানকার মানবজাতির বসবাস নিয়েই। কালাহারিতে বসবাসরত মানুষদের মূলত San People বা Bushman বলা হয়, বাংলায় যার ভাবানুবাদ সম্ভবত বন মানুষ বুঝায়। তবে বলে রাখা প্রয়োজন San people and Mowgli’র মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে, এই দুই জাতিকে আবার এক দৃষ্টিতে বা এক অর্থে জানার সুবিধে নেই।

image.jpegCHEETAH and San man @ Kalahari desert

শিকারি হিসেবে প্রায় ২০ হাজার বছর ধরে কালাহারিতে বসবাস করে আসছে স্যান পিপল। “The Gods Must Be Crazy” চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছিলো ওদের নিজস্ব ভাষায় অপরাধ বলতে কোনো শব্দ নেই, নিজেদের মধ্যে ক্রোধ কিংবা হিংসা বলতে কিছু নেই। এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে কিছু কথা বললে স্যান পিপলদের ব্যাপারে পাঠকবর্গ আরেকটু  পরিষ্কার ধারণা পাবেন (Spoiler Alert)।

কালাহারির উপর দিয়ে যাওয়া এক হেলিকপ্টার থেকে পড়ে যায় একটি কোককোলার বোতল আর সেটি কুড়িয়ে পাওয়ার পরই শুরু হয় আকস্মিক যত কান্ড। সবাই মনে করতে থাকে বোতল টি সম্ভবত দেবতারা উপর থেকে তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন কাছে শুরু হয় বোতলের ব্যবহার। বোতলের মুখে ফুঁঃ দিয়ে নানান ভঙ্গিমায় সুর তোলা, বোতল দিয়ে চামড়া মসৃণ করা, নারিকেল ফাটানো। বেশি মানুষের মধ্যে একটি মাত্র বোতলের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়াতে তাঁদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাঁধতে শুরু করে, দলের সবার মধ্য এক ধরণের ক্রোধ তৈরি হতে থাকে। তাঁরা লক্ষ্য করে যে; বোতলটি তাঁদের মধ্যে আরও ঝামেলার সৃষ্টি করছে। কখনো বোতলটিকে অনেক দূরে গর্ত করে পুতে রেখে আসে, কখনো বা বিরক্ত হয়ে দেবতাদের কাছে ফেরৎ পাঠানোর জন্য বোতলটি আকাশে ছুঁড়ে মারে। সবাই মিলে তখন সিদ্ধান্ত নেয় বোতলটিকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেয়ে ফেলে রেখে আসবে। যার জন্য তাকে ২০দিন রাত অথবা ৪০ দিন-রাত হেঁটে পথ পাড়ি দেওয়া লাগতে পারে। এই বোতল ফেলে দিতে যেয়েই সভ্য জগতের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।

সব মিলিয়ে তাঁরা একে অপরের প্রতি খুবই আন্তরিক। বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতা বা কৃষ্টি কালচারের কোন ছোঁয়াই নেই তাঁদের মধ্যে। আমাদের পাঠ্য বইয়ে পড়ানো হয় প্রাচীন যুগ, মধ্য যু্‌গ বা আধুনিক যুগ সম্পর্কে, ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে নানান সভ্যতার। কিন্তু, কালাহারির স্যান পিপলদের মধ্যে সভ্যতা কিংবা আধুনিক-আদিম যুগ বলতে কিছু নেই। তাঁদের নেই স্রষ্টা ধারনা। তাঁরা ধনুক এবং বিষাক্ত তীরের সাহায্যে বিভিন্ন বন্য প্রাণী শিকার করে। শিকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ভোজ্য উদ্ভিদ যেমন বেরি, বাঙ্গি এবং বাদাম, পাশাপাশি পোকামাকড় সংগ্রহ করে রাখে।

খরাকালীন মৌসুমে পানির বদলে বন্য তরমুজ খেতে হয় তাঁদের। প্রয়োজনীয় পানির বেশিরভাগই বিভিন্ন উদ্ভিদের শিকড় অথবা মরুভূমির তলে বা তার নীচে পাওয়া তরমুজ থেকে সংগ্রহ করে। মজার ব্যাপার হলেও সত্য যে; বাস্তবতার তাগিদে তাঁরা উঠ পাখির ডিমের খোলসের মধ্যে পানি সঞ্চয় করে রাখে।

Photo Credit © Isewell

আদিম কালের মতই বাশ-কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানোর কাজ সেরে নেয়। ২০২০ সালে এসেও দিয়াশলায়ের ব্যাপারে কোনো ধারনা নেই তাঁদের।

লেখক- আলী রেজা রাজু 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *