Site icon Bangla Info Tube

কম্পিউটারেই সিনেমা!!!

Reading Time: 5 minutes

রাকিবঃ একটা নতুন ল্যাপটপ কেনা দরকার।

শিহাবঃ আমারও ট্যাবটা কাজ করছে না। কিনবো কিনা ভাবছি। 

আপাতদৃষ্টিতে দুই বন্ধুর সাধারণ কথোপকথন বলেই মনে হয় উপরোক্ত সংলাপকে। কিন্তু ওদের পাশে রাখা স্মার্টফোনেরও কি তা মনে হয়?

দশ সেকেন্ডের কথোপকথনের সূত্র ধরে মুহূর্তেই বিলিয়ন বিলিয়ন তথ্য পৌঁছে গেছে অন্তর্জালের দুনিয়ায়। ফলাফল, খানিক বাদেই রাকিব, শিহাবের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইলের বিজ্ঞাপন।

বর্তমান জমানায় তথ্যই অর্থ। এই তথ্য আর প্রযুক্তিকে একসূত্রে গাঁথতে ভুল করেননি সিনেমা পাড়ার মানুষ। স্রেফ অন্তর্জালের বিশাল তথ্যভাণ্ডার, অ্যাপস, কম্পিউটার আর মোবাইল স্ক্রিনকে উপজীব্য করেই নির্মাণ করেছেন দারুণ কিছু ফিল্ম।

আজ সেই কম্পিউটার স্ক্রিন সিনেমারই পাঁচখানি নিয়ে আড্ডা হোক।

Searching(২০১৮

জার্মান, স্প্যানিশ,ফ্রেঞ্চ,রুশ, ইতালিয়ান,পর্তুগিজ- সব ভাষার জন্যই পৃথক পৃথক স্ক্রিন তৈরি করেন নির্মাতারা; Photo: The New Yorker

দেড় ঘণ্টা টানটান উত্তেজনায় কাটাতে চান? তাহলে নিঃসন্দেহে বেছে নিতে পারেন আনিশ চ্যাগান্টির থ্রিলার ‘Searching’.

গল্পের শুরুতেই দর্শক চমকে উঠবেন। কেননা, প্রথাবদ্ধ ছবির কৌশলের দিকে মোটেই যাননি এর পাঁচজনের নির্মাতা দল। গোটা ছবিই উঠে এসেছে কম্পিউটারের স্ক্রিনে, কখনো চ্যাটবক্সে, কখনো Tumblr, কখনো ভিডিও ফাইলে।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর ডেভিডের সাথে ষোড়শী কন্যা মার্গোটের দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেকটাই। মেয়ে কোথায় যায়, সারাদিন কম্পিউটারে মুখ গুঁজে কী করে- কিছুই জানেন না ডেভিড।

আচমকাই একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় মার্গোট। পুলিশের শরণাপন্ন হলেও লাভের খাতায় শূন্য দেখে নিজেই নেমে পড়েন তদন্তে। আর এই সমস্ত তদন্তে তাঁর একমাত্র হাতিয়ার ইন্টারনেটের সুবিস্তৃত তথ্য ভাণ্ডার। শুধু কম্পিউটার ঘেঁটেই কি রহস্যের কিনারা করতে পারবেন ডেভিড? নাকি গোলক ধাঁধাতেই আটকে যাবেন?

মজার ব্যাপার হলো, পরিচালক আনিশ প্রথমে একে আট মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন। পরে এক বছর  এর গল্প নির্মাণের পেছনেই ব্যয় করেন। তখনই একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার কথা মাথায় আসে।

ছবিতে ব্যবহৃত কম্পিউটার স্ক্রিন বা অ্যাপস কোনটাই আদতে আসল ছিল না। বেশিরভাগই শুধুমাত্র ছবিতে দেখানোর জন্য নতুনভাবে ডেভেলপ করা হয়। মাত্র ১৩ দিনে শুটিং হলেও সম্পাদনাতেই চলে যায় দেড় বছর।

ছবির মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জন চো, ডেবরা মেসিং, মিশেল লা। মাত্র ৮,৮০,০০০ মার্কিন ডলারে নির্মিত ছবিটি বিশ্বব্যাপী অ্যায় করে ৭৫ মিলিয়নেরও বেশি।

C U Soon (২০২০)

মুখোমুখি নয়, স্ক্রিনে ভিডিও দিয়েই একে অপরের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ফাহাদরা; Photo: Amazon

লকডাউনের ভেতরই তাক লাগিয়ে দিলো ‘ফাহাদ ফাসিল এন্ড ফ্রেন্ডস’।

মহামারীর কারণে দুনিয়ার চলচ্চিত্রপাড়া যখন স্থবির, তখনই মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রি জানান দিলো ‘সৃজনশীলতার সীমা নাই। সে ঘরের বাইরেও যা, ঘরেও তা।‘

কাহিনী আবর্তিত হয় দুই কপোত কপোতী আনুমল সেবাস্তিয়ান (দর্শনা রাজেন্দ্রান) এবং জিমি কুরিয়েনকে (রোশান ম্যাথু) কেন্দ্র করে। অনলাইন ডেটিং সাইটেই পরিচয় হয় তাদের, প্রেমটাও জমে ক্ষীর হয় স্বল্পকালেই।

সরল মনেই আনুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে জিমি। তখনই বদলে যায় মিঠে কাঁচা রোমান্স। অনলাইনের কৃত্রিম দুনিয়া থেকে বাস্তবে ভূপাতিত হয় দুজন। বেরিয়ে আসে ভয়ংকর এক সত্য। আর সেই সত্য উদ্ঘাটনে যুগলের পাশে দাঁড়ায় কেভিন( ফাহাদ ফাসিল)।

ছবি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মহেশ নারায়ণ। সেপ্টেম্বরের পয়লা দিনেই অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তি পায় ছবিটি। বিগত সপ্তাহ ধরে গোটা ছবিটিই আইফোনে শ্যুট করা হয়। এর কলাকুশলীরা টানা তিন সপ্তাহ ছিলেন ফাহাদ-নাজরিয়া দম্পতির বাড়িতে। দুই সপ্তাহ নির্মাণ আর এক সপ্তাহ সম্পাদনার পরই দুর্দান্ত এই থ্রিলার দর্শকের দুয়ারে পৌঁছে দেয় টিম ‘C U Soon’.

Host(২০২০)

ভিডিও কলেই গল্পের বুনন, ওতেই সমাপ্তি
Photo: The Guardian

কৈশোরে ‘প্ল্যানচেট’ নিয়ে আগ্রহী হননি- এই কথাটাকে ডাহা মিথ্যের কাতারেই ফেলে দিচ্ছি। ভূত প্রেত, আত্মা নিয়ে উন্মাদনা সেকালেও ছিল, এখনও বহাল তবিয়তে আছে।

কিন্তু জুম মিটিঙয়ে ভূত ডাকা! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ছয় বন্ধুর ‘প্ল্যানচেট’ কে ঘিরে রব স্যাভেজ এই কোয়ারেন্টিনে নির্মাণ করেছেন মাত্র ৫৭ মিনিটের এই ছবি।

উত্তেজনা আর ভৌতিক আবহে টইটম্বুর সিনেমার গোটাটাই কিন্তু জুম ভিডিও কলে তৈরি। খুব অল্প অংশেই বাড়তি ক্যামেরা ব্যবহার করেছে নির্মাতা দল। এমনকি দৃশ্য ধারণ, লাইটিং, সাজসজ্জার কাজগুলোও করেছেন এর কুশীলবেরা।

জেমা মুর, হ্যালি বিশপ, এমা লুইস, টেডি লিনারড অভিনীত ছবিটি মুক্তি পায় ৩০ জুলাই।

Open Windows (২০১৪)

ঝরঝরে থ্রিলারের স্বাদ দেবে Open Windows; Photo: IMDb

‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর ক্যাবলের হাতে…
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী…’

বর্তমানতা আরও কয়েক কাঠি সরেস। টেলিভিশনে আকারে স্লিম হয়েছে, সেই তরুলতাকে পেছনে ফেলেছে হালের আইফোন, এন্ড্রয়েড, স্মার্টওয়াচেরা। পৃথিবীটা এখন মাইক্রো চিপের কোটরে বন্দি বলাও অত্যুক্তি নয়।

যেই প্রযুক্তির হাতে আমরা ‘সঁপেছি প্রাণ’ তা কি আদতেই নির্ভরযোগ্য? নাকি সেই অজগরের মতো একদিন আমাদের গিলে খাবার মতলব আঁটছে গোপনে?

জিল গদার খ্যাতনামা অভিনেত্রী। ভক্তের সংখ্যাও যেমন অজস্র তেমনি ঘৃণাকারীর ভাঁড়ও খালি নয়। এক বদ্ধ উন্মাদ ভক্ত দীর্ঘদিন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। জিলকে অপহরণ করবার মতলবে ফাঁসিয়ে দেয় আরেক ভক্ত নিক চ্যাম্বারসকে। আর অন্যদিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে একের পর এক অপরাধ করতে থাকে সেই পাগলাটে ব্যক্তি। কিন্তু পরিচয় কী তার? জিল আর নিককে হেনস্থাই বা করছে কেন?

ফ্যান্টাসি-থ্রিলারে মোড়কের এই ফাউন্ড ফুটেজ ছবি পরিচালনা করেন নাচো ভিগালোন্দো। এলিজাহ উড ও সাশা গ্রে অভিনীত ছবিটি নির্মাণ শৈলীর জন্য নন্দিত হলেও ক্লাইমেক্সে হতাশ করে দর্শকদের।

Unfriended (২০১৪

ছবির প্রাথমিক নাম ছিল Offline; Photo:IMDb

কম্পিউটার স্ক্রিন চলচ্চিত্রের দিকপাল এই Unfriended. হরর ঘরানার ছবিটি মুক্তির পর থেকেই চলে আসে আলোচনার টেবিলে। আড়ম্বরহীন গল্প আর কম বাজেটেও যে জবরদস্ত সৃষ্টি সম্ভব, এর মাধ্যমেই টের পান দর্শক।

হাইস্কুলের একঝাক তরুণ মুখ। গতানুগতিক বন্ধু দলের মতো তারাও ভিডিও কলে আড্ডা জমিয়েছিল। আচমকাই সেই গ্রুপ কলে এসে জুটল অনাকাঙ্ক্ষিত এক অতিথি- লরা বার্নস।

কিন্তু এ কী করে সম্ভব! এই সহপাঠী তো এক বছর আগেই আত্মহত্যা করেছে। ফেইক আইডি ভেবে এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় লিলি, জেসরা।

ম্যাকবুকে ভিডিও এবং স্ক্রিনশট দিয়েই তৈরি করা হয় ৮৩ মিনিটের কম্পিউটার স্ক্রিন-হরর। লেভান গ্যাব্রিয়াডজের পরিচালনায় ছবিটি নির্মাণে ব্যয় হয় মোটে ১৬ দিন। এতে অভিনয় করেন মসেস স্টরম, শেলি হ্যানিগ, উইল পেল্টজ প্রমুখ। ১ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ছবিটির বক্স অফিস আয় ৬৫ মিলিয়ন।

‘কোম্পানিগুলো অনুমতি ছাড়াই আপনার তথ্য নিচ্ছে, আপনার কেনাকাটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, দরকার হলে তথ্য লুকিয়েও ফেলছে। এত সব অন্যায়ের মূলে সমস্যা একটাই, সেটা তথ্য অধিকারে অসাম্য।

আমরাই কাজ করছি, পয়সা দিচ্ছি, কিন্তু পাপেটের মত ব্যবহৃত হচ্ছি। এর পেছনের কলকাঠি নাড়ছে সরকার এবং রাঘব বোয়াল কোম্পানিগুলো।‘

এডওয়ার্ড স্নোডেনের কটা বাক্যই চমকে দেবার জন্য যথেষ্ট। তথ্যকে পুঁজি করে জলঘোলা করবার ঐতিহ্য বহু পুরনো। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই বলুন বা সিআইএর গোপন নথির কথাই বলুন।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট ছাড়া এক কদম ফেলাও অসম্ভব। সেই প্রয়োজনের বস্তুর মাধ্যমেই বিঘ্নিত হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত অধিকার। আপনার তথ্য কার হাতে যাচ্ছে, কে দেখছে, কেই বা ব্যবহার করছে- তার পুরোটাই অজানা। তাই সাধু, সাবধান!

লেখক- সারাহ তামান্না

Exit mobile version