ইতিহাস বিশ্ব

মিখাইল কালাশনিকভ: যার হাত ধরে জন্ম নিয়েছে একে-৪৭ রাইফেল   1 min read

জুলাই ১২, ২০১৯ 3 min read

author:

মিখাইল কালাশনিকভ: যার হাত ধরে জন্ম নিয়েছে একে-৪৭ রাইফেল   1 min read

Reading Time: 3 minutes

কবিতা আর অস্ত্র কী কখনো একই পাত্রে থাকতে পারে? যেখানে কবিতা মানুষের মধ্যে নিয়ে আসে প্রশান্তি বাতাস, সেখানে অস্ত্র নিয়ে আসে ধ্বংসযজ্ঞের ধোঁয়াঅথচ এমন বিপরীতধর্মী দুটি জিনিস এক ব্যক্তির মাথায় স্থান করে নিয়েছিল, তিনি  মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ ১০ই নভেম্বর ১৯১৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম সাইবেরিয়া, যা বর্তমানে রাশিয়ার অন্তর্গত; এই অঞ্চলেরকুরইয়া নামক গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন

কিশোর বয়সে তার কবিতা চর্চা করা দেখে অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন মিখাইল কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করবেবার তিনি নিজেও কবি হতে চেয়েছিলেন; এমনকি তার টি কবিতার বই বের হয়েছে। কিন্তু তিনি কবি হিসেবে মোটেও মানুষের কাছে সমাদৃত নন বরং তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে পরিচিত একে-৪৭ আবিষ্কারের মাধ্যমে 

এই রাইফেলের এমন নামকরণে কিছু বিষয়ের আদ্যাক্ষরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ(A) এসেছে রাশিয়ান শব্দ “Avtomat” থেকে, যার বাংলা প্রতিশব্দ স্বয়ংক্রিয় আর এই অস্ত্রের আবিষ্কারকের নামের প্রথম অক্ষর থেকে নেওয়া হয়েছে কে(K)। আর ১৯৪৭ সালে এই অস্ত্র প্রস্তুত হয় ফলে এই সালকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়েছে ৪৭। এভাবে সব মিলিয়ে এই রাইফেলের নামকরণ করা হয় একে-৪৭এটি কালশনিকভ রাইফেল নামেও পরিচিত

 মিখাইল কালাশনিকভের বাল্যকালেই কবিতার প্রতি তার বেশ আগ্রহ জন্মে, তবে একই সঙ্গে বিভিন্ন অস্ত্রের প্রতিও তিনি বেশ আকর্ষণ বোধ করতেনকিন্তু দরিদ্রতা অসুস্থতার কারণে সপ্তম শ্রেণীর বেশি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি প্রয়োজনের তাগিদে চাকরি নেন একটি ট্রাক্টর স্টেশনেসোভিয়েত সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ১৯৩৮ সালে রেড আর্মিতে যোগ দিতে বাধ্য হন তিনি অস্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ বুঝতে পেরে কর্তৃপক্ষ তাকে একজন ট্যাংকার মেকানিক হিসেবে নিয়োগ দেয় সেখানে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সেই তরুণ বয়সেই ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সেনাবাহিনীতে তরুণ উদ্ভাবকের স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন তিনি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে ব্রায়ানস্কের যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটানহাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি ভাবতে থাকেন, কীভাবে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের পরাজিত করতে পারবে এই চিন্তা থেকেই তিনি নতুন ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের চাহিদা অনুভব করেন এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই মিখাইল কালাশনিকভ অস্ত্র তৈরির নেশায় ঝাঁপিয়ে পড়েন১৯৪৪ সালে একটি অস্ত্রের নকশা তৈরি করতে সক্ষম হোন, কিন্তু সোভিয়েত বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাছে এই নকশা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নিপ্রথম বার ব্যর্থ হয়েও তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে এসে পূর্ববর্তী ডিজাইনের উন্নত ও আধুনিক নকশা নিয়ে হাজির হন এই নকশাই নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৯৪৭ সালে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একে-৪৭ হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে

একে-৪৭ হাতে মিখাইল কালাশনিকভ; Image Credit: politico.com

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে এই অস্ত্রের কথা ও ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে দুঃখজনক হলেও সত্য এই অস্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে মিখাইল কালাশনিকভ কোনো অর্থ আয় করতে পারেননি। এমনকি প্যাটেন্টও নিজের দখলে রাখতে পারেননিনকশার স্বত্বাধিকার না থাকায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে এই অস্ত্র তৈরি করা শুরু করে ফলে বর্তমানে বিভিন্ন ডিজাইনের একে৪৭ রাইফেল বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশের তৈরিকৃত একে-৪৭ রাইফেলগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো হাঙ্গেরীয়ান একে৪৭তারপর চায়নারা ১৯৮৮-৮৯ সালে একেএস-৭৬২ (AKS-762) ভার্সনের একে৪৭ বানানো শুরু করেকম দাম এবং কার্যকারিতা একই হওয়ায় চায়নাদের তৈরিকৃত এই একে৪৭ রাইফেলটি বিশ্ব বাজারে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে

বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক এই রাইফেলটির অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি দ্বারা ব্যাক ফায়ার হয় না শীতে, গরমে, জলে, স্থলে, কাদায়  যেকোনো পরিবেশে গ্যাস চালিত একে৪৭ রাইফেলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই অস্ত্রের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরির একটি রোলার মেশিন নিয়ে যাওয়ার পরও ঐ অস্ত্রের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাইনি। একে-৪৭ রাইফেলের মাধ্যমে ৭.৬২×৩৯ মিলিমিটার বুলেটকে ৭১৫মিটার /সেকেন্ডে ছু্ড়ে দেওয়া সম্ভব হয়; যা ৮ ইঞ্চি কাঠ কিংবা ৫ ইঞ্চি কংক্রিট ভেদ করে যেতে সক্ষম হয়

এছাড়াও এতে কাস্টমাইজ বুলেট ব্যবহার করা যায় আর সিঙ্গেল শট, ব্রাস্ট অব ফায়ার ও গ্রেনেড ছুড়ার সুযোগসুবিধা তো আছেইঅসাধারণ কার্যক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার কারণে বর্তমানে ৫০টিরও বেশি দেশের সেনাবাহিনীরা এই অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং বিশ্বজুড়ে ১০কোটিরও বেশি একে৪৭ রাইফেল তৈরি হয়েছে এই অস্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে মিখাইল কালাশনিকভ অর্থ না পেলেও পেয়েছেন অসাধারণ সব সম্মাননা, সম্মান ও প্রচুর জনপ্রিয়তা

২০০৯ সালের ১০ই নভেম্বরে তার জন্মদিনে তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট  তার হাতে হিরো অব রাশা” পদক তুলে দেন ২০০৪ সালে প্লে-বয় নামক ম্যাগাজিন বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এমন ৫০টি পণ্যের তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখানে স্থান করে নিয়েছিল মিখাইল কালাশনিকভের একে৪৭ রাইফেলটি২০১১ সালে লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়াম ধ্রুপদী নকশাধারী কিছু পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করে আর এই তালিকাতেও স্থান করে নেয় রাইফেলটি

২০১৩ সালের ২৩ই ডিসেম্বরে ৯৪ বছর বয়সে মিখাইল কালাশনিকভ ইহজগত ত্যাগ করলেও তার আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি মানুষের মাঝে উজ্জ্বলভাবে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে সন্ত্রাসীদের হাতে একে-৪৭ দেখে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখি, তখন কষ্ট পাই।’

লেখক- আমিনুল ইসলাম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *