বিশ্ব

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বঃ একটি বিষফোঁড়া সংকটের আদ্যোপান্ত (প্রথম পর্ব)1 min read

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০ 4 min read

author:

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বঃ একটি বিষফোঁড়া সংকটের আদ্যোপান্ত (প্রথম পর্ব)1 min read

Reading Time: 4 minutes

হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের লাশের পাহাড় আর ইহুদীদের আগ্রাসনের কাহিনী প্রায় ৮০ বছর পেরিয়েছে। অথচ সমাধানের কথা কেবল খবরের কাগজেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে এর চিহ্নটুকু নেই। দুই জাতির মধ্যে এত দীর্ঘকালীন সময় পর্যন্ত অমানবিক দ্বন্দ্বের ঘটনা বোধ করি মানুষ আগে দেখেনি। এখনো অব্দি চলমান এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সারা বছর জুড়েই গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনা হয়ে থাকে।

উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। তাঁরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়। সেই সময় ‘জাওনিজম’ তথা ইহুদীবাদ আন্দোলনের শুরু হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদীদের জন্য স্বাধীন একটি ভূখণ্ড গড়া। ইহুদীদের দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় ব্রিটিশরা। মূলত ইহুদী উপনিবেশ গড়ে তুলতে সহায়তার হাত বাড়ায় ব্রিটিশরা। ইসরাইল ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের আসল সূত্রপাতও ঘটে তখনই।

প্যালেস্টাইন তথা ফিলিস্তিন মুসলিম, খ্রিস্তান ও ইহুদীদের নিকট পবিত্র স্থান। ভূমধ্য সাগরের পূর্বে  ১০,৪২৯ বর্গ মাইলের ফিলিস্তিন ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন। উনিশ শতকের শেষের দিকটায় ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের অংশ। সে সময়টায় আদতে তা অটোমান সাম্রাজ্য হিসেবেই পরিচিত ছিল। তখনকার সময়ে ফিলিস্তিনের ৯৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ছিল মুসলিম ও খ্রিস্টান। আর ইহুদির সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ।

১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল এই সময়টুকুতে ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা কয়েক হাজার বেড়ে যায়। পরের ৩০ বছরে ক্রমেই এই সংখ্যাটি ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। ব্রিটিশদের সহযোগিতায় সে সময় প্রায় ৬ লক্ষ ইহুদি প্রবেশ করে ফিলিস্তিনে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একেবারে পতন ঘটে অটোমান সাম্রাজ্যের। ফলে ফিলিস্তিন সহ বেশ কিছু আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস বেলফোর ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসস্থান’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সমর্থনের ঘোষণা দেন। ইতিহাসে একে বলা হয় ‘বেলফোর ঘোষণা’। বেলফোর ঘোষণার ফলশ্রুতিতে ইউরোপ থেকে ঝাকে ঝাকে ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে ঘাটি গাড়তে শুরু করে। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেন আরব ও ইহুদী উভয় পক্ষের কাছেই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ফিলিস্তিন নিয়ে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৮ সালে ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ‘হাগানাহ’ নামী এক গোপন বাহিনী গড়ে ওঠে। শুরুর দিকে এটি ইহুদিদের সাহায্য করার জন্যই কাজ করতো। কিন্তু পরবর্তীতে এটি সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়।  ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষেত খামার দখল করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিত এই ‘হাগানাহ’ বাহিনী। বর্তমানে ইসরাইলি সেনা বাহিনী এই জঙ্গি সংগঠনটিরই পরিবর্তিত রূপ।

চল্লিশের দশকে ঘটে যাওয়া ২য় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয়। ফলে ইহুদীদের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের চাপ বাড়ে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দুই ভাগ করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তৎকালীন লীগ অব নেশন’সের তথা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ।

সেই সময়টায় ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেয়ে বসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের ৫৭ শতাংশ। বাকী ৪৩ শতাংশ জোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের। তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিম সীমানা অনির্ধারিত রাখা হয়। যাতে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা আরো বাড়াতে পারে। এভাবেই জাতিসংঘের একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের ফলে একটি নব্য ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিনিরা।

মিত্রদের সহযোগিতায় ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনে তাদের অত্যাচার দিনকে দিন লাগামহীন হতে শুরু করে। ইহুদি সন্ত্রসবাদী দলগুলো জোর জবরদস্তি করে মুসলমানদের বাড়িঘর ও ধন সম্পত্তি দখল করে নেয়। জাতিসংঘের প্রস্তাবের মাত্র ৩ মাসের মাথায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ইন্ধন ও সহযোগিতায় ১৭ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

১৯৪৮ সালের ১২ই মে রাত ১২.০১ মিনিটে ইহুদীদের নেতা ডেভিড বেনগুরিয়ন ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন একই পথে হাটে। অর্থাৎ স্বীকৃতি দেয়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিন তথা প্যালেস্টাইন ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণার পরদিনই মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশদের অধীনস্ত অঞ্চলে। ইতিহাসের পাতায় সেটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নামে পরিচিত।

সেই অমানবিক যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ৫০০ গ্রামের ৪০০টি কেই জনশূন্য করে ফেলে ইসরায়েল। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। ফিলিস্তিনের যে অংশটুকু ইসরায়েল দখলে ব্যর্থ হয় তা দখলে যায় প্রতিবেশী দুই দেশ জর্ডান ও মিশরের মধ্যে। ভাগাভাগি হয় সে অংশের ভূখণ্ড। বহুল পরিচিত গাজা উপত্যকা যায় মিশরের দখলে আর পশ্চিম তীরের ভাগ পায় জর্ডান। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয় শুরু হয় আদতে তখন থেকেই । এটিকে তাঁরা বলে ‘নাকাবা’ বা বিপর্যয়।

আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে আরো ৩ টি যুদ্ধ হয় পরবর্তী সময়ে। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের সেইসব যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে কেবলই বেড়েছে দুর্ভোগের পাল্লা। এরমধ্যে ১৯৬৭ সালের মাত্র ৬ দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। যথারীতি বিজয়ী হওয়া ইসরায়েল দখল করে নেয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ। পূর্বে যা মিশরের অধীনে ছিল। সেই সাথে পশ্চিম তীরও জর্ডানের থেকে দখলে নিয়ে নেয় ইহুদীরা। একই সময় তাঁরা সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। এই যুদ্ধের ফলে আরো ৫ লাখ ফিলিস্তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

প্রায় অর্ধযুগ পর ১৯৭৩ সালে আরব ইসরায়েলের তৃতীয় যুদ্ধটি বাঁধে। অক্টোবর মাসে ঘটা এই যুদ্ধের নাম ‘ইয়েম কিপুর’। এই যুদ্ধে একদিকে মিশর আর সিরিয়া জোট বাঁধে, অপরদিকে ইসরায়েল। মিশর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলের কিছু ভূমি উদ্ধার করতে সমর্থ হয় কিন্তু গাজা আর গোলান মালভূমি অধরাই থেকে যায়।

এই যুদ্ধের ৬ বছর পর মিশর প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সাথে করে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি। পরবর্তীতে অবশ্য জর্ডানও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের সংঘাতের কোনো সুরাহা হয় না।

এরপর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরণের সংঘাত হয় ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে। সে সব যুদ্ধে ইসরায়েল তাঁদের উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক সামরিক বাহিনীর পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে হামলা চালায়। আর প্রতিরোধকারী ফিলিস্তিন সেখানে ছিল যেন অনেকটা তাসের ঘর।

ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনের জনগণ শুরু করে ‘প্রথম  ইন্তিফাদা’। আভিধানিক অর্থে যার মানে দাঁড়ায় ‘জেগে ওঠা’। প্রথম ইন্তিফাদার কার্যকাল ছিল ৫ বছর অর্থাৎ ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। প্রথম ইন্তিফাদায় একেবারে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি তরুণ ও কিশোরেরা  ইসরায়েলি সৈন্যদের দিকে ইট-পাথর মেরে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেসবের ছবি আজো ইন্টারনেটের কল্যাণে খুঁজে পাওয়া যায়। গাজা ভূখণ্ড যেটি কিনা ইহুদীদের দীর্ঘদিন দখলে ছিল তা ১৯৯৪ সালে তারা ফিলিস্তিনের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

এরপর নতুন শতাব্দীতে ২০০০ সালে শুরু হয় ২য় ইন্তিফাদা। এটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত গড়ায়। এই গণজাগরণের ফলশ্রুতিতে আরো বেশি রক্তাক্তের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। তিন হাজারের ও বেশি ফিলিস্তিনি এই সময় সংঘাতে নিহত হয়। আর ইসরায়েলের নিহত হয় এক হাজার সেনা।

জাতিসংঘ আর ক্ষমতাধর দেশগুলো বিশেষত ইসরায়েলের বন্ধু রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি প্রক্রিয়ার পদক্ষেপের কচ্ছপ গতি বলতে গেলে মন ভেঙ্গেই দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের। এদিকে পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় দিনকে দিন আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ইসরায়েল। আর কত ফিলিস্তিনি লাশ হলে তাঁরা তাদের স্বপ্নের স্বাধীন ফিলিস্তিন পাবে তা কারোই জানা নেই।

লেখক- মাহের রাহাত

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *