রত্নরহস্য- ইতিহাসের ৫ অভিশপ্ত রত্ন1 min read
Reading Time: 4 minutesচকচকে একখন্ড পাথরের টুকরা যাকে আমরা রত্ন বলি- তার জন্য কিনা করতে পারি আমরা। হীরা, রুবি, চুনি পান্না- চকচক করলেই হল। তবে অনেক রত্ন এমন আছে যারা সাথে করে শুধুমাত্র অর্থ প্রতিপত্তি বা সন্মান আনে না, সাথে আনে অভিশাপ। হ্যাঁ, অভিশাপ। আপনি জেনে অবাক হবেন যে এই এক টুকরা পাথরের জন্য কত মানুষ তার রক্ত ঝড়িয়েছে। এমন কিছু রত্ন আছে যাদের ঘিরে রয়েছে রক্তশীতল করা কাহিনী। যদিও তাতেও থেমে নেই সেইসব রত্ন পাবার আকাঙ্খা।
আজ জানাবো এমন কিছু মহামূল্যবান রত্নের কথা যাদের সাথে জড়িয়ে আছে রক্ত, ধোঁকা আর অভিশাপের ছায়া-
দ্য হোপ ডায়মন্ড
হীরা নিয়ে সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে কিন্তু হোপ ডায়মন্ডের কথা শোনেনি এমন মানুষ বিরল। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে চর্চিত একটি রত্ম। যারা যারা এই হীরার মালিকানার সুখ পেয়েছেন তাদের সবারই ফলাফল হয়েছিল করুণ- অন্তত গুজব তো তাই বলে। পাগল হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে পাগল কুকুরের হাতে নৃশংস মৃত্যু- কি নেই এর মধ্যে। যদিও এর সত্যতা সম্পর্কে নেই তেমন শক্ত দলিল। তবুও যা রটে তার কিছুতো ঘটে বটেই। কথিত আছে, হোপ ডায়মন্ড এককালে এক হিন্দু দেবতার মূর্তিতে খচিত ছিল। পরে জিন-ব্যাপ্টিস্ট ট্রেভানিয়র এটি চুরি করে নিয়ে আসেন। (মজার ব্যাপার হল, বেশির ভাগ রত্মের ব্যাপারে এটাই শোনা যায় যে সেগুলো উপমহাদেশে একসময় কোন না কোন দেবতার মূর্তিতে ছিল)। পরবর্তীতে ট্রেভানিয়র বন্য কুকুরের কামড়ে মৃত্যু বরণ করেন। এরপর যারা যারা এই হীরকখন্ড নিজের কাছে নিয়েছেন তাদের সবার ভবিষ্যত খুব একটা সুখকর হয় নি। যেমন- মেরি এন্টোনেট ও রাজা লুইসের- শিরচ্ছেদ এর মাধ্যমে মৃত্যু। রাজকুমারি দ্য ল্যাম্বেল ক্রোধান্বিত জনতার হাতে মারা পড়েন। জ্যাকেস কোলেট আত্মহত্যা করেন। সুরবানয়া মারা যান তার রয়্যাল প্রেমিকের হাতে যিনিই আবার তাকে এই হোপ উপহার দিয়েছিলেন। সাইমন মন্থারিজ সপরিবারে ঘোড়ার গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা পড়েন।
আরেকটি বিখ্যাত ঘটোনা হল মিসেস ইভলিন ম্যাকলিন এর। তিনি ১৯১১ সালে হোপ কিনে নেন। তিনি দাবি করেছিলেন তিনি হোপের এই অভিশাপ কাটাতে পারবেন। এর মালিকানা পেয়ে তিনি অত্যন্ত সাড়ম্বড় পার্টি দিতেন যেখানে তার অতিথিদের জন্য ‘ফাইন্ড দ্য হোপ’ নামের খেলার আয়োজন করতেন। তিনি পার্টিতে কোন এক জায়গায় হোপ লুকিয়ে রাখতেন এবং আতিথিদের তা খুঁজে বের করতে হতো। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মিসেস ম্যাকলেন এর কপালে এই সুখ বেশি দিন সইলো না। তার ছেলে গাড়ী দূর্ঘটানায় মারা যায়, মেয়ে ড্রাগ ওভারডোজে মারা যায় এবং তার স্বামী অন্য এক মহিলার জন্য তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং পরবর্তিতে হাসপাতালে রোগে ভুগে মারা যান।
দ্যা ব্লাক অরলভ ডায়মন্ড
অনেক দূর্লভ কিন্তু অসামান্য সুন্দর। কিন্তু সেই একই কথা- অভিশাপ! ব্ল্যাক অরলভের ব্যাপারে কথিত আছে এটি নাকি হিন্দু দেবতা ব্রহ্ম’র চোখে ছিল। তাই একে ‘দ্য আই অফ ব্রহ্ম’ বা ‘ব্রহ্ম’র চোখ’ বলা হয়। যা পন্ডিচেরি থেকে চুরি হয়ে যায়। তাহলে বুঝতেই পারছেন অভিশাপটা কিসের। এই অভশাপের কারণেই কিনা এর মালিকেরা সবাই আত্মহত্যা করেছিল।

জে ডব্লিউ পারিস, যিনি ১৯৩২ সালে এই হীরা ইন্ডিয়া থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন, তিনি নিউইয়র্কের একটি বহুতল ভবন থেকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পরবর্তীতে দুইজন রাশিয়ান রাজকুমারি এই হীরার মালিক হন, প্রিন্সেস ভাইজিন এবং প্রিন্সেস লিওনিলা, যাদের দুজনই রোমে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। এরপরই একজন জুয়েলার এই হীরাকে তিনটি খন্ডে বিভক্ত করে আলাদা আলাদা জুয়েলারিতে পরিণত করেন। তিনি মনে করেছিলেন এতে হয়ত এর অভিশাপ কেটে যাবে। হয়তো সত্যিই। কারণ তার পর এর সম্পর্কে আর তেমন কোন কথা শোনা যায় নি। ২০০৬ সালে অভিনেত্রী হফম্যান অস্কারে এই হীরক খন্ড পড়ে যাবেন বলে শোনা গিয়েছিল। যদিও শেষ মুহুর্তে অজ্ঞাত কারণে তিনি মত পাল্টান। বুদ্ধিমতি বটে!
কোহিনূর
কোহিনূরের নাম কেনা জানে। এই বিশালাকৃতির হীরাটি আজো লন্ডন টাওয়ারে স্বমহিমায় সুসজ্জিত আছে, রানীর মুকুটের অংশ হিসেবে। কোহিনূর ১৮৫০ সালে ইন্ডিয়ে থেকে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ রাজ পরিবারকে দেয়া হয়। বর্তমানে এটি রানী এলিজাবেথের মুকুটে লাগানো আছে। এই মুকুটটিই প্রদর্শনীর জন্য রাখা। রানীদের জন্য সুখের খবর হল, এই হীরার অভিশাপ কেন জানি শুধুমাত্র রাজাদেরই লেগেছিল। যারা যারা এই হীরা হাতে পেয়েছেন তাদের কারোরই রাজ সিংহাসন কপালে থাকে নি। হয়তো একারণেই রাণী আলেকজান্দ্রা তার মুকুটে পড়ার সময় থেকে আর কোন পুরুষই এই হীরায় হাত লাগাননি।

দ্য দিল্লি পার্পল স্যাফায়ার
এই রত্নটি মাত্র ৩০ বছর আগে লন্ডন ন্যাচার হিস্টোরি মিউজিয়ামের কিউরেটর পিটার ট্যান্ডি আবিষ্কার করেন। মিউজিয়ামেরই মিনারেল ক্যাবিনেট নামক একটা অংশে অনেক মোড়ক লাগানো একটা বক্সে পেয়েছিলেন। এই বক্সে খোদাই করা ছিল জাদুমন্ত্র আর সতর্কবাণী-
“যে এই বাক্স প্রথম খুলবে, প্রথমে সতর্কবাণী পড়বে, তারপর যা ইচ্ছা হয় সে তা করতে পারে। তার প্রতি উপদেশ রইল সে যেন এটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করে”।
অনেকেই ধারণা করে এই রত্নটি আসলে একটি চুরি করে আনা সম্পদ এবং এটি ১৮৫৭ সালে ভারতের কানপুরের একটি ইন্দ্র মন্দিরে ছিল। যদিও এটিকে স্যাফায়ার বলা হচ্ছে কিন্তু আসলে এটা একটা কোয়ার্জ পাথর। পাথরটি কর্ণেল ডব্লিউ ফেরিস ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে দেউলিয়া হয়ে যান। তার মৃত্যুর পর যখন তার ছেলে পাথরটির মালিকানা পায়, বাবার মতো সেও দেউলিয়া হয়ে যায়।

এরপর এটিকে লেখক এডওয়ার্ড হেরন-এলেন কিনে নেন কিন্তু পরে তা বন্ধুদের বিলিয়ে দেন কেননা তিনি দাবি করেন এই পাথরটি তার জীবনে দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই আনেনি। তার বন্ধুদের মধ্যেও এর হাত বদল হতে থাকে কারণ তাদের মধ্যেও দূর্ভাগ্যের ছায়া পড়ছিল, এমনকি এক সঙ্গীতশিল্পী বন্ধু তার গানের গলাই হারিয়ে ফেলেন।
দ্য লিডিয়ান হোর্ড
লিডিয়ান হোর্ড কোন একটি রত্ন নয় বরং অনেকগুলো গহনার সমষ্টি। এর মধ্যে ছিল সোনার পাত্র, গহনা আর পাথর। এরা সবাই অভিশপ্ত না হলেও এদের মধ্যে একটী ব্রোচ আর নেকলেস ছিল যা্কে অভিশপ্ত বলে মনে করা হত। কারণ এরা তাদের মালিকের জন্য দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই আনেনি। এগুলো মূলত ছিল রাজা ক্রোসিয়াস এর সম্পদের একাংশ যা লুট হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে যখন এদের মাটি খুড়ে উদ্ধার করা হয় তখনই এর আসল বিপদ শুরু হয়। এক নাম না জানা রাজকুমারির মন্দিরে পাওয়ার পর থেকেই হাত বদল হতে শুরু করে। এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে সবারই পরিণতি হয় অসুখ, দূর্ভাগ্য আর মৃত্যু।

এ যুগে এসে এসব কথা আর তেমন বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এত পেছনের অলৌকিক গালগল্প চলে আসছে অনেক সময় ধরে। অনেকে মনে করে এসব শুধু মাত্রই রত্ন গুলো চুরি ঠেকাতে ছড়ানো হয়েছিল আবার অনেকে মনে করে যে কিছু তো রয়েছে। তবে সত্য হোক না না হোক, কিছুটা রহস্য না হয় থাকলো।