বিশ্ব

ইরাকের আবু গারিব কারাগারঃ মানবতা যেখানে ঠাঁই পায়নি1 min read

জুলাই ৬, ২০১৯ 3 min read

author:

ইরাকের আবু গারিব কারাগারঃ মানবতা যেখানে ঠাঁই পায়নি1 min read

Reading Time: 3 minutes

এপ্রিল ২০০৪ বিখ্যাত টিভি চ্যানেল সিবিএস এর মিটিং রুমে তখন চলছে তোলপাড় কারণ সদ্যই হাতে এসেছে ইরাকের আবু গারিব কারাগারের কিছু ভিডিও আর স্থির চিত্রছবি আর ভিডিওগুলোতে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা বন্দীদের সাথে করা অমানবিক অত্যাচারের চিত্র যদিও বেশ কিছু মাস ধরে মানবাধিকার সংগঠন এমনেস্টি আবু গারিবের বিষয়ে বেশ কিছু ক্যাম্পেইন করছে কিন্তু তা যে এত ভয়াবহ ছিল, ধারণা করতে পারেনি কেউই সিবিএস ভাবলো এই অন্যায় জানার অধিকার আছে সবার আর তাই তৈরি হল বিখ্যাত ডকুমেন্টারি – সিক্সটি মিনিটস II। আর তাতে পুরো পৃথিবী জানল আসলে কি হয়েছিল সেই চার দেয়ালের মাঝে

কি হয়েছিল আবু গারিবের বন্দীদের সাথে?

ইরাক আমেরিকান সৈন্যদের দখলের আসার পর পরই আমেরিকা ইরাকে তাদের প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলএই পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল ইরাকের কারাগারগুলোতে অপরাধী এবং সন্দেহভাজনদের নিয়ে আসাএই কারাগারগুলোর মধ্যে একটি ছিল আবু গারিব যা আগে থেকে বন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার আর বসবাসের নিম্ন মানের জন্য কুখ্যাত ছিলকিন্তু কে জানত, তা একদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাবেআবু গারিব ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ছিল মার্কিন অগ্রাসনের সময় এটিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করা হয় 

জেনিস কারপিনস্কি, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তাকে আবু গারিবসহ বাকি সামরিক কারাগারের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় কিন্তু একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সামরিক কর্মকর্তা (যিনি ১৯৯১ সালের গালফ ওয়ারে দায়িত্ব পালন করেছেন) হওয়া সত্বেও তার কারাগার চালনা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও ছিল না, না ছিল তার সাথে থাকা সৈন্যদের। 

পরবর্তী বছরগুলোতে, আবু গারিবের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন নানা রকম নিষ্ঠুর ও প্রশ্নবিদ্ধ অমানবিক অত্যাচার ও ইন্টারোগেশন পদ্ধতি বের করে, বিশেষ করে ২০০৩ এর অক্টোবর ও নভেম্বর এর দিকে

প্রতিটি ছবি দেখে বোঝা যায় যে নির্যাতন গুলো ইচ্ছাকৃত ও অবৈধভাবে করা হয়েছিল; Image Credit : wikidata.org

যদিও ২০০৪ এর জানুয়ারিতে যখন মেজর জেনারেল এন্টোনিও এম টাগুবা আবু গারিবের সম্পর্কে তদিন্ত চালাতে আসেন, তখন পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়৷ মার্চের শুরুতে যখন টাগুবার তদন্ত সম্পূর্ণ হয়, তখন সকল অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় এবং ছয়জন সৈন্যের বিরুদ্ধে কারাবন্দীদের সাথে অপরাধমূলক আচরণ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

কিন্তু নির্যাতনের আসল ছবি ও তথ্য জনগনের কাছ তখনো গোপন রাখা হয় তা অবশ্য ২৮ এপ্রিল ২০০৪ পর্যন্তই এরপর ইউএস প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি কংগ্রেসে এই রিপোর্ট এর বিস্তারিত তুলে ধরেনসেই সাথে সিবিএসও তাদের ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে সাথে সাথেই প্রকাশ হয়ে যায় আমেরিকান সৈন্যরা ঠিক কতটা নিষ্ঠুরতর আচরণ করতো কারা বন্দীদের সাথে কিন্তু তারচেয়ে বেশি হতবাক করে দেয়ার মত বিষয় ছিল বন্দীদের বেশিরভাগই, প্রায় ৭০-৯০% ছিল নিরপরাধ ইরাকি নাগরিক যারা ভুলক্রমে বা শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কারাবন্দী হয়েছিল। 

নিষ্ঠুরতার নমুনা

কারাবন্দীদের উপর চালানো কিছু কিছু নির্যাতনের উদাহরণ হলঃ

  • বন্দীদের উপর রাসায়নিক বাতি ভেঙ্গে ফসফরাস জাতীয় তরল তাদের গায়ে ঢেলে দেয়া
  • বন্দীদের নগ্ন করে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়া
  • চেয়ার, বা কাঠের হাতল দিয়ে মারপিট করা
  • পুরুষ বন্দীদের ধর্ষণের হুমকি দেয়া
  • নারী বন্দিদের ধর্ষণ করা ( যাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাদের পরিবার সম্মান রক্ষার্থে তাদের অনার কিলিং এর নামে হত্যা করে)
  •  একজন বন্দীকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিয়ে আহত করে পরে পুলিশের পাহারাদার দিয়ে ক্ষত সেলাই করানো হয়েছিল
  • পুরুষ বন্দীদের মাঝে একজন ছিল যার পায়ুপথে কাঠের লাঠি ঢুকানো হয়েছিল
  • কুকুর লেলিয়ে দিয়ে বন্দীদের ভয় দেখানো 

একজন বন্দীকে শরীরে একটি পাটাতনে ঘণ্টা ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল এবং তাকে বলা হয়েছিল পড়ে গেলেই কারেন্ট শক দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হবেপরবর্তীতে এই ছবিটি আবু গারিবের প্রতীকি হয়ে উঠেছিল

শরীরে ইলেক্ট্রিক তার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই কারা বন্দী; Image Credit: seattlegayscene.com

নগ্ন মানুষদের পিরামিড বানিয়ে হাসিমুখে ছবি তোলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।  

আবু গারিবের পরবর্তী দিনগুলো 

পরবর্তী মাসগুলোতে, আবু গারিব কারাগারে আরো কিছু তদন্ত চালানো হয়, আরো কিছু সৈন্য এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় কিছু লোক দেখানো ন্যায়বিচারও করা হয়, যেমন- পরবর্তী ১০ দিনে ৫০০ এর মত বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়, সামান্য কিছু কিছু সৈন্যদের শাস্তি দেয়া হয়। 

কিন্তু আবু গারিবের এই নিদর্শন তারপরো মুছে যায় নি বুশ প্রশাসনের ভিতরের অনেক মানুষ তারপরও আবু গারিবের নির্যাতন ও ইন্টারোগেশন পদ্ধতিকে হালাল করতে বিভিন আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়েছিল যেমন ২০০৪ এর ১১ মে, ইউএস প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি  Senate Appropriations Defense Subcommittee কে জানায় যে পেন্টাগনের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছে যে তাদের পদ্ধতিগুলো জেনেভা কনভেনশনের আইন অনুযায়ী সঠিক ছিল।

শেষ কথা

২০০৬ সালে ইরাকি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হয় আবু গারিব কারাগার। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর ২০০৯ সালে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে। এরপর ২০১৩ সালে পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয় এই অভিশপ্ত কারাগার। কিন্তু এর নিষ্ঠুরতার রেশ আজো রয়ে গেছেশুধুমাত্র দোষীদের শাস্তির উপরই পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার নির্ভর করে না বরং ভুক্তভোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই আসল ন্যায় বিচার প্রদান সম্ভব। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, এই কারাগারে নির্যাতনে প্রায় চার হাজার বন্দীর মৃত্যু হয়েছে।

লেখক- লাবিবা ফারজানা 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *