বাংলাদেশ

অপারেশন জ্যাকপট : একটি রাত এবং স্বাধীনতার স্বাদ 1 min read

আগস্ট ১৯, ২০২০ 6 min read

author:

অপারেশন জ্যাকপট : একটি রাত এবং স্বাধীনতার স্বাদ 1 min read

Reading Time: 6 minutes

দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলীয় শহর তুলন। তুলন ডকইয়ার্ডে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরোতে ৪৫ জনের একটি ছোট্ট দলের প্রশিক্ষণ চলমান। সেই দলটায় আরেকটা ছোট্ট গ্রুপ ছিল। সদস্য ১৩ জন। এই ১৩ জন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো বিদ্রোহ করবে। নিজ ভূখন্ডের উপর চলা অন্যায় আর শোষণের শেষ দেখবে। শেষ পর্যন্ত ১৩ জনের দলটা ৮ জন হয়েছিল। ফ্রান্স, স্পেন, রোম, জেনেভা… এরপর ভারত। দেশ মহাদেশ পাড়ি দিয়ে যারা স্বাধীন করতে এসেছিল এই বাংলাদেশকে। “‘আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।”- এরকম একটা ফর্মে যারা দাঁতে দাঁত চেপে স্বাক্ষর করে অন্ধকারে পানিতে ঝাপ দিয়েছিল! সেই দলটার কথা কজন জানি?

দেশ কিংবা স্বাধীনতা কেবল নিছক শব্দ নয়। এগুলো অনুভূতি আর অর্জন। ৭১ এর ১৬ অগাস্ট (১৫ অগাস্ট রাত ১২টায় পরদিন বিবেচনায়) কিছু পাগলাটে মানুষ নেমেছিল চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর আর নারায়ণগঞ্জের শীতল পানিতে। জীবনের মায়া একপাশে সরিয়ে যাদের মনে ছিল কেবল স্বাধীনতা। কাগজে কলমে তাদের সে অভিযানের নাম ছিল “অপারেশন জ্যাকপট।”

তুলন থেকে ভারত

পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশন সার্চলাইটের মত জঘন্য আর বর্বর হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে জানতে পেরে সাবমেরিনার মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার। কিন্তু একা তো পালানো যায় না। সাথে ছিল আরো ১২ জন বাঙালি। প্রতিবার প্রশিক্ষণ শেষে সাবমেরিন তীরে ভেড়ার সময় ওয়াহেদ একজন একজন করে বাঙালি ক্রুদের ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানান। পাকিস্তানি সহকর্মীরা যেন কিছুই না জানতে পারে সেজন্য এই সতর্কতা। কেননা এটি সুস্পষ্ট সামরিক বিদ্রোহ এবং দেশদ্রোহিতা।

ওয়াহেদ চৌধুরী ছিলেন পুরো দলের নথি রাখার সিন্দুকের নিরাপত্তার দায়িত্বে। তিনি সেখান থেকে ৪৫ জন ক্রু-এর পাসপোর্টই নিজের লকারে নিয়ে আসেন। কেননা, যেহেতু দেশে যুদ্ধ চলছে, তাই কেবল ১৩ জন বাঙালির পাসপোর্ট সরানো ছিল ঝুকিপূর্ণ। এবং তা সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতো। ওয়াহেদ চৌধুরীর সুস্পষ্ট পরিকল্পনার গুণেই সেবার ১৩ জনের মধ্যে ৮জন দেশের টানে সাড়া দিয়ে তার সাথে যোগ দেন। যদিও এক সময় পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় একজন শহীদ হন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের হাতে।

পাসপোর্ট নিয়ে ১/২জন করে তারা তুলন ছেড়ে চলে যান। কিন্তু সীমান্তে গিয়ে তারা জানতে পারেন, সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করতে হলে তাদের ভিসা প্রয়োজন। ৮ জনের এই বাঙালি দলকে সুইজারল্যান্ড যাবার পরামর্শ দেন একজন দক্ষিণ আফ্রিকান। যুদ্ধে ফ্রান্স পাকিস্তানের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা ছিল বেশি, তবে সুইজারল্যান্ড ছিল নিরেপেক্ষ। তাই সুইজারল্যান্ড ছিল সেসময় দেশে ফেরার নিরাপদ উপায়। পরে প্যারিসগামী ট্রেনে চড়ে স্পেনের লিওন এ নেমে যান তারা। পালিয়ে আসা সেই ৮ জন ছিলেন, মোঃ রহমতউল্লাহ, মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, মোঃ শেখ আমানউল্লাহ, মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোঃ আহসানউল্লাহ, মোঃ আবদুর রকিব মিয়া, মো আবদুর রহমান আবেদ এবং মোঃ বদিউল আলম।

লিওন হয়ে বার্সেলোনায় গিয়ে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে তাদের পাঠানো হয় স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে। কিন্তু আবারো সাহায্যের হাত বাড়ায় ভারত। মাদ্রিদের ভারতীয় দূতাবাসে খুব দ্রুত সময়েই ভারতের মাটিতে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়। স্পেন থেকে ইতালির রাজধানী রোমে গিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ছেড়ে আসা ভারতগামী বিমানে উঠবেন এমনই সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বিধি বাম!

শ্রমিক ধর্মঘটের জন্য বিমানটি দেরী করে সেদিন। অন্যদিকে গণমাধ্যমে তাদের পালিয়ে আসার খবরটি প্রকাশিত হলে পাকিস্তান দূতাবাস তাদের ফেরাতে উদ্যত হয়। ইতালির সাথে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক থাকায় দশ ঘণ্টা রোমে ওই বিমানের অপেক্ষা করার ঝুঁকি না নিয়ে তারা জেনেভায় চলে আসেন এবং এক ঘন্টার পরেই তারা উড়াল দেন ভারতের পথে।

সেক্টর নং ১০

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সব নৌচলাচল, বন্দর ও উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০ নম্বর সেক্টর যা ছিল মূল নৌবাহিনী নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের কোনো নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিল না। অপারেশন চলাকালে সেক্টরের কমান্ডারদের সহযোগিতায় নৌ-গেরিলাদের কাজ করতে হতো।

ফ্রান্স ফেরত আটজনের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে মোট ২০ জনের গেরিলা দল গঠন করে ভারতে তাদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেশে পাঠানো হলে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে তাদের আলাপ হয়। বিচক্ষণ কর্নেল ওসমানী কালক্ষেপণ না করেই তিনি তাঁদের নিয়ে নৌ–কমান্ডো বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সাথে তাদের দেয়া হয় কাজ করার অবাধ স্বাধীনতা। ২০ জনের দলটি ঘুরে ঘুরে বেছে নিতে থাকে যোগ্য গেরিলাদের।

প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ২৩ মে একটি গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এই প্রশিক্ষণ শিবিরের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় C2P। অন্যান্য সেক্টরের বিভিন্ন শিবির থেকে মে মাসের শুরুর দিকে প্রচুর যোদ্ধা জমা হতে থাকেন এখানে। একপর্যায়ে দলটিতে গেরিলা সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ জনে। দিনে ১৮ ঘন্টা প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শিবিরে তাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধু যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তিনি ছাড়া আর কেউ এই সম্পর্কে জানতেন না।

প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই বাছাই করা যোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয়, এটি একটি আত্মঘাতী অভিযান হবে। অপারেশনের সময় যেকোনো মূল্যে অভিযান সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল। সত্যিকার অর্থেই এতে ঝুকি ছিল খুব বেশি। বুকে মাইন বেঁধে নিয়ে এগুতে হবে ঠান্ডা কনকনে পানিতে। মাইন বিস্ফোরণ হতে পারে, এলার্ম বাজতে পারে, ধরা পড়তে পারে। বিপদের যেন শেষ নেই। নজরুলের সেই ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ পেরিয়েই সফল করতে হতো অপারেশন জ্যাকপটকে।

প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি এবং দুটো গান

নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এম এন সামানত। আর তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার জি এম মার্টিসসহ মোট ২১ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আটজন সাবমেরিনারও ছিলেন। প্রশিক্ষণের মোট দুটো অংশ ছিল। একেবারেই প্রয়োজনীয় এবং প্রাথমিক কিছু স্থলযুদ্ধ যেমন গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরকের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট(খালি হাতে যুদ্ধ) ইত্যাদি শিখতে হতো। আর জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের সাঁতার। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, পানির ওপরে নাক ভাসিয়ে টানা দীর্ঘ সময় সাঁতার, পানিতে সাঁতরে ও ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার ইত্যাদি।

এছাড়া ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে। টানা তিন মাসের লম্বা আর পরিশ্রম সাধ্য প্রশিক্ষণ শেষ হয় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। প্রশিক্ষণের শেষদিকে এসে প্রথমবারের মত আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হয়। একই সঙ্গে দুই সমুদ্র বন্দর (চট্টগ্রাম ও মোংলা) ও দুই নদী বন্দরে (চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ) আক্রমণ চালানোর জন্য চার সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়।

চার স্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মোট চারটি দল ভাগ করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম ও মংলার জন্য ৬০ জনের দুটি দল এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন করে আরও দুটি দল। চারটি দলের চারজন নেতা ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। দলের নেতাদের অভিযান পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ গোপনীয় পদ্ধতি যা দলের অন্যান্য সদস্যের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। আর আক্রমণের সংকেত ছিল দুটি বাংলা গান।

প্রথম সংকেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান’। এই গান বাজানোর অর্থ হল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ গানটি ছিল দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ এখন আক্রমণ করতেই হবে। পিছু হটবার আর রাস্তা নেই। হয় মারো, নয়ত মরো। একদিকে স্বাধীনতা, অন্যদিকে মৃত্যু।

চট্টগ্রাম বন্দরে আক্রমণ

পাক বাহিনীর বড় ঘাটি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। যেহেতু ভারতের আকাশ হয়ে বিমান আসা সম্ভব ছিল না। তাই তাদের সব অস্ত্রের চালান আসতো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই। তাই এই বন্দরে আক্রমণের ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি।

চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। হরিনা ক্যাম্প থেকে আসা ৬০ জনের দলকে ২০ জন করে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দুটি দল তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট বেজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু তৃতীয় দল কোন এক কারণে পৌছাতে ব্যর্থ হয়। সব মিলিয়ে বাকি দুই দলের ৪০ জনের মধ্যে এ অপারেশনে ৩১ জন কমান্ডো অংশ নেয়। ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে রাত সোয়া ১টায় তারা পানিতে নেমে জাহাজের উদ্দেশ্যে সাঁতরানো শুরু করে এবং বেশ দ্রুত নিজ নিজ বাছাই করা টার্গেট জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে সাঁতার কেটে সরে পড়ে। রাত ১ টা ৪০ মিনিটে প্রথম মাইন বিধ্বস্ত হয়।

একে একে সব মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়। এই বড় জাহাজ গুলো হলো  এমভি হরমুজ—এটি কেবল একদিন আগেই অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। প্রায় ৯৯১০ টন অস্ত্র ও গোলা–বারুদবাহী এই জাহাজটি ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙর করা ছিল। এম ভি আল-আব্বাস জাহাজে ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম ছিল। এই জাহাজটি ৯ আগস্ট ১২ নম্বর জেটিতে অবস্থান করছিল। এছাড়া ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর ৬—এটি ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল।

মোংলা বন্দর

২৭ জুলাই ৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন বাংলাদেশি বিশেষ কমান্ডো দল আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ভারতের কানিং মাতলার বন্দর থেকে মোংলা অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সুন্দর বনের গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কমান্ডো দলটি ১৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। ২৬০ জনের দলটি মোংলা বন্দর ও ডাংমারি বিলের পেছনে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে মোংলার দূরত্ব ডাংমারি বিলের মাঝ দিয়ে ৬ মাইল। আর নৌকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা।

১৫ আগস্ট ঠিক রাত ১২টায় কমান্ডোরা ১৫টি নৌকায় মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মোংলায় পৌঁছানোর সময় নির্ধারিত ছিল রাত ২টা। কিন্তু পথ পরিদর্শকের ভুল পরিচালনায় কমান্ডোরা অনেকটা সময় পরে সেখানে পৌছায়। ভোর সাড়ে চারটায় মোংলায় অপারেশন শুরু হয়। অপারেশন চলাকালে ২০০ জন সিঅ্যান্ডসি বিশেষ কমান্ডো দল হেভি মেশিনগান, মেশিনগান সহকারে তিনজনের ছোট ছোট দল করে প্রায় ৬৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে নৌ কমান্ডোদের কভার দিতে মোংলা বাঁধের পেছনে অবস্থান নেন।

সময়ের অভাবে শুধু ২৪ জন নৌ কমান্ডো এই অভিযানে অংশ নেন। ৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ২৪ জন নৌ কমান্ডো ৬টি বিদেশি জাহাজে মাইন লাগায়। ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে সেসব মাইন বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। এ অপারেশনে ছয়টি বিদেশি জাহাজই ধ্বংস হয় এবং ৩০ হাজার টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পশুর নদীতে ডুবে যায়।

এই অপারেশনে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন, ধারণা করা হয় তারা স্রোতের টানে ভেসে গেছেন অথবা শহীদ হয়েছিলেন।

চাঁদপুরের নদীবন্দর

চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশনে ১৮ জন নৌ-কমান্ডো অংশ নেন। এ গ্রুপের ১৮ জনকে তিনজন করে মোট ৬টি ছোট দলে ভাগ করা হয়। এই অভিযানে মাইন বিস্ফোরণে ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি জাহাজ সহ ছোট বড় আরও অনেকগুলো নৌযান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর

নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশনে মোট ৪টি জাহাজ ও বেশ কয়েকটি নৌযান নৌ কমান্ডোরা ধ্বংস করেন। এ অপারেশনে মোট ২০ জন কমান্ডো অংশ নেন। অপারেশনগুলোতে প্রায় ২৬টি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং আরও অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অপারেশন জ্যাকপট অবশ্য একদিনেই থামেনি। এরপর আরো ছোটবড় বেশ কিছু অভিযান চালানো হয়। সবখানে অবশ্য সাফল্য মেলেনি। চট্টগ্রামে এরপর আর কোন অভিযানই সফল হয়নি। সেখানে পাহারা অত্যাধিক বাড়ানো হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চারবার চেষ্টার পরেও দখল করা সম্ভব হয়নি।

সাফল্য এবং শহীদেরা

তালিকা মোতাবেক মোট ৫১৫ জন কমান্ডো সিটুপি (C2P) থেকে প্রশিক্ষণ নেন। আর অভিযান পরিচালনায় মোট আটজন কমান্ডো শহীদ হন, ৩৪ জন আহত হন। এছাড়া আগস্ট-ডিসেম্বরের মাঝে ১৫ জন কমান্ডো শত্রুর হাতে ধরা পড়েন। এ সময়ের মধ্যে নৌ কমান্ডোরা প্রায় ১২৬টি জাহাজ, কোস্টার ও ফেরি নষ্ট এবং ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট-নভেম্বর সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৬৫টি বিভিন্ন ধরনের নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ কমান্ডোরা। জেটি ও বন্দর অকার্যকর করে দেওয়া হয় এবং চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো নিজস্ব সামরিক নৌযান না থাকা সত্ত্বেও নৌ কমান্ডোরা নৌ পথকে একরকম নিজেদের দখলেই রেখেছিল।

শুধুমাত্র একটি ১৬ আগস্টের রাত না হলে হয়ত স্বাধীনতা আমাদের জন্য আজীবন অধরাই থেকে যেত। বুকে মাইন, চোখের সামনে বিশাল সব জাহাজ আর মস্তিষ্কের সবটা জুড়ে বাংলাদেশের পতাকা। রূপালী পর্দায় নয়, এসব নায়কের জন্ম হয়েছিল আমাদের মাটিতেই।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *