৬ জন সাধারণ নারীর অসাধারণ যাত্রাঃ যারা বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাস1 min read
Reading Time: 4 minutesমার্চ মাস এসেছে, সাথে এসেছে নারীদের জন্য উৎযাপনের দিন, বিশ্ব নারী দিবস। বিশ্বের কোণায় কোণায় নারীর স্বাধীনতা, স্বকীয়তা আর অর্জনকে তুলে ধরে সমান অধিকারের দাবীতে সোচ্চার সবাই।
নারীর অধিকারের লড়াইটা নতুন হলে যুগে যুগে নারীরা বহু সাহসীকতার কাজ করে ইতিহাসে রেখে গেছেন স্বাক্ষর। “ফিমেল ওয়েভ অফ চেঞ্জ” নামের এই বৈশ্বিক চলমান আন্দোলনে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সর্বত্রই আজ নারীদের এগিয়ে চলার গুঞ্জন।
এই মাহেন্দ্রক্ষণে আজ জেনে নিন ৬ জন সাধারণ নারীর কথা যারা তাদের অসাধারণ কর্ম দ্বারা যেমন নারী জাতিকে মহিমান্বিত করেছেন তেমনি বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাস।
১. এমিলিয়া ইয়ারহার্ট
প্রথম নারী হিসেবে এককভাবে প্লেন চালিয়ে আটলান্টিক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিমানচালনায় ইতিহাস গড়েন এই নারী। পরবর্তীতে তাঁর রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক আর আলোচনা থাকলেও ইয়ারহার্টের এই অসাধারণ অর্জন ভোলার মত নয়, সেও আবার সেই যুগে যখন বিমান চালনার মত কাজে নারীদের ভাবাও যেত না।
১৯৩২ সালে ইয়ারহার্ট নিউফাউন্ডল্যান্ডের হার্বার গ্রেস থেকে আয়ারল্যান্ডের ডেরি পর্যন্ত টানা ১৫ ঘন্টা বিমান চালিয়ে এই কাজে ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাক্তি হিসেবে নাম লেখান যা নারীদের প্রতি পুরোনো, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে মূখ্য ভুমিকা পালন করেছিল। এই বিমান যাত্রা সহজ ছিল না মোটেই। লম্বা যাত্রার ক্লান্তি, ফুটো হয়ে যাওয়া ফিউল ট্যাংক, একটি ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন যা থেমে থেমেই স্ফুলিং বর্ষণ করে- সব কিছুকে পাল্লা দিয়েই তিনি তাঁর যাত্রা সফল ভাবে সম্পন্ন করেন। তাঁর এই সাফল্য পরবর্তীতে বহু নারীকে উজ্জীবিত করেছে তাদের স্বপ্নের পথে পা বাড়াতে। যেমন ২০১৭ সালে এনি দিব্যা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী পাইলট হিসেবে বোয়িং ৭৭৭ চালান।
২. এথেনা গিবসন
টেনিস কোর্টে সেরেনা আর ভেনাস উইলিয়ামের জয়জয়কারের কথা কে না জানে। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান দুই বোন যেন টেনিস বিশ্বের রানি। কিন্তু দৃশ্যপট সবসময় এমন ছিল না। তাদের জন্য প্রথম শুরুটা করেছিলেন এথেনা নিয়েল গিবসন। উনি ছিলেন প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান নারী।
হিসেবে খেলা টেনিস খেলোয়াড়। সেটাও খেলেছিলেন উইম্বলডনে, যা বিশ্ব টেনিসের সবচেয়ে পুরোনো টুর্নামেন্ট। সেই ১৯৫০ সালে যখন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা প্রচুর বর্ণবাদের শিকার হতেন, সেই প্রতিকূল পরিবেশেও একজন নারী হয়ে এমন টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া সাহসীকতার কাজই বটে। পরবর্তীতে এই অসামান্য নারী খেলোয়াড় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী গলফার হিসেবে পিজিএ ট্যুরে অংশ নিয়ে গড়েন আরেক ইতিহাস।
খেলার মাঠে হোক বা মাঠের বাইরে, এথেনা গিবসন কখনোই তাঁর গায়ের রঙের কারণে হীনমন্যতায় ভোগেন নি যা আজো বহু নারীর আদর্শ।
৩. ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা
বেশিরভাগ মানুষই জেনে থাকবেন চাঁদে অবতরণকারী প্রথম ব্যাক্তির না। হ্যাঁ, নীল আর্মস্ট্রং। কিন্তু মহাকাশে যাওয়া প্রথম নারী মহাকাশচারী কে জানেন কি?
ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা। ভ্যালেন্টিনা একজন সোভিয়েত নভোচারী যিনি ১৯৬৩ সালে তিন দিনেরও কম সময় মহাকাশে বিচরণ করেন এবং এই সময়ে ৪৮ বার পৃথিবীর চারপাশ প্রদক্ষিণ করেন।
ভ্যালেন্টিনা সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অত্যন্ত দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁরা অসীম সাহসীকতা আর দৃঢ় মনোবল তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে। পরবর্তীকালে তাঁকে “Hero of Soviet Union “ এবং ইউনাইটেড নেশনস এর শান্তিতে গোল্ড মেডেল দ্বারা সম্মানিত করা হয়।
৪. মেরি কুরি
বিশ্বের প্রথম নোবেল জয়ী নারী মেরি কুরি পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম কণা আবিষ্কার করে রেডিওএক্টিভিটি শব্দের সাথে পৃথিবীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। নোবেল ছাড়াও তাঁর অসাধারণ বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য একাডেমিক পুরস্কার ও সম্মান।
বিজ্ঞানী ছাড়াও ছিলেন একজন মানবতাবাদী মহান নারী। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর অতুলনীয় গবেষণার মাধ্যমে ফ্রান্স হাসপাতালে জীবন রক্ষাকারী রেডিয়েশন টেকনিক এর মাধ্যমে অনেক প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। সে সময় তিনি নিজে শুধু কাজ করে যাননি, অন্য নারীদেরকেও সাথে যুক্ত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলেন যাতে তারাও অন্যদের কাজে এগিয়ে আসতে পারে।
৫. ডোলোরেস হুয়ের্টা
জীবিত কিংবদন্তি ডোলোরেস হুয়ের্টা মূলত কাজ করেছেন শ্রমিক অধিকার নিয়ে। লাতিন শ্রমিকদের বৈষম্য দূর করতে সেই ১৯৫০ থেকে তিনি কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি “Si, se puede” ( হ্যাঁ, আমরাই পারি) উজ্জীবিত করেছিল লাখো মানুষকে। তাঁর শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় ক্যালিফোর্নিয়ায় ফার্ম শ্রমিকদের নিয়ে, যেখানে তিনি কৃষি কাজ করেন এমন শ্রমিকদের অধিকার আদায় এবং ন্যায্য পারিশ্রমিকের জন্য একটি সংগঠণ তৈরি করেন যা ১৯৬৬ সালে ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্স নামে প্রচুর খ্যাতি লাভ করে।
একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ডোলরেস তাঁর সম্পূর্ণ জীবন শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ব্যয় করেছেন। তিনি তাদের ভোটের অধিকার, ন্যায্য পারিশ্রমিক, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে লড়ে গেছেন। এমনকি শেষ বয়সেও তিনি আইকন হিসেবে রয়েছেন মানুষের মনে।
৬. মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট
মার্গারেট ব্রুক হোয়াইট ছিলেন বিশ্বের প্রথম নারী ডকুমেন্টারি চিত্রগ্রাহক। তিনি ইউএস আর্মির সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছবি তুলে পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন চিত্রগ্রাহক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন এবং সেই সাথে ভবিষ্যত নারী প্রজন্মকে যুদ্ধকালীন চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করার পথ প্রদর্শন করেছেন। এই আধুনিক যুগেও যখন যুদ্ধকালীন নারী চিত্রগ্রাহক হাতে গোণা ক’জন তখন সেই সময়েও তাঁর এই সাহসী পেশা সব মেয়েদের জন্যই শিক্ষনীয়।
মার্গারেট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধস্থলের ছবিই শুধু তোলেন নি, জার্মানীর কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নাজিদের ভয়াবহতার গল্প যেন ক্যামেরার মাধ্যমে বলেছেন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজ ডিকি চ্যাপেল এবং ক্যাথেরিন লরিদের মত নারীরা এগিয়ে এসেছেন।