বলিউডের কারবার যে বদলাচ্ছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। এ বছরটায় কাজে আর সাজে ভালোই ভেল্কি দেখিয়েছে উপমহাদেশের এই বিরাট ইন্ডাস্ট্রি। তবে বলিউড আমূল পরিপাটি হয়ে যাবে সে আশাও বোকামি। ভালো-মন্দেই চলেছে এই উনিশ সালের বাণিজ্যিক হালচাল, পাশাপাশি বিতর্কের চুলোতেও বাতাস পড়েছে বেশ।
কবির সিং বিতর্ক
তেলেগু ব্লকবাস্টার ছবি ‘অর্জুন রেড্ডি’র হিন্দি রিমেক মুক্তি পায় এবছরের জুনে। শহিদ কাপুর ও কিয়ারা আদভানি অভিনীত ছবিটি বাজেটের ৬০ কোটি রুপির বিপরীতে আয় করে ৩০৮ কোটি রুপি। বাণিজ্যিক সফলতা পেলেও ছবির বিষয়বস্তু এবং সামাজিক বার্তা নিয়ে সরব ছিল গোটা বলিউড। নারীবিদ্বেষ এবং বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে উসকে দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল ছবিটি। বিতর্কে ঘি ঢালে এর পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাংগা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভালোবাসার মানুষের গায়ে আপনি যেভাবে ইচ্ছে হাত তুলতে পারেন। চড় মারা প্রেমেরই প্রকাশ।‘
নরেন্দ্র মোদির বায়োপিক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘PM Narendra Modi’র মুক্তির তারিখ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে এবছর। লোকসভা নির্বাচনের চারদিন আগে অর্থাৎ এপ্রিলের ৫ তারিখ মুক্তির কথা থাকলেও সেন্সর বোর্ডের হস্তক্ষেপে পিছিয়ে ১২ এপ্রিল করা হয়। ১১ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের পূর্বে যেকোনো বায়োপিক মুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে ‘Mary Kom’, ‘Sarbjit’ খ্যাত ওমাং কুমারের পরিচালনার এই ছবি মুক্তি পায় মে মাসের ২৪ তারিখে।
নরেন্দ্র মোদিকে একজন সৎ ও পরিপাটি রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থাপন করাই ছিল এই ছবির মূল লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়া টুডেকে সমালোচক অনন্যা ভট্টাচার্য বলেন, ‘ ছবিতে দেখানো হয়েছে গুজরাট দাঙ্গার সাথে মোদির কোন সম্পৃক্ততাই ছিল না। উল্টে বিরোধী পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সমস্ত দোষ। অথচ আমরা কিন্তু সত্যটা জানি।‘
সালমান খান- সঞ্জয় লীলা বানসালি বিবাদ
গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্জয় লীলা বানসালির জয়রথ চলছে। এদিকে একশো কোটি ক্লাবের দশাসই সব রেকর্ডও সালমানের ঝুড়িতে। সঞ্জয় লীলা তাই ভেবেছিলেন সালমান আর আলিয়া ভাটকে নিয়ে তাক লাগাবেন দর্শকদের। তবে ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। ‘Inshallah’ প্রোজেক্টে পারিশ্রমিক হিসেবে আকাশচুম্বী অর্থ চেয়ে বসেছেন সালমান। অন্যদিকে বানসালির মতে ছবির সাফল্যের সিংহভাগ বর্তায় পরিচালকের উপর। দুজনের দ্বিমতের প্রেক্ষিতে বানচাল হয়েছে ছবিটি।
ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ
বছরের আরম্ভ থেকেই ইতিহাস নির্ভর ছবির প্রকোপ ছিল বলিউডে। কঙ্কনা রানাউতের ‘মনিকর্ণিকা: কুইন অফ ঝাঁসি’, অক্ষয় কুমারের ‘কেসারি’ এবং সঞ্জয় দত্ত- অর্জুন কাপুর- কৃতি শ্যাননের ‘পানিপথ’ মুক্তি পায় এবছর। এর মধ্যে আশুতোষ গোয়াড়িকর পরিচালিত ‘পানিপথ’ এর বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলেছে রাজস্থানি কর্তৃপক্ষ। ইতিহাস বিকৃতি ও মহারাজা সুরাজমলকে নেতিবাচকভাবে দেখানোর অভিযোগে আন্দোলন করেছে তারা। এদিকে বিবিসি ও আল জাজিরাও বলিউডে আহমদ শাহ আবদালি, আলাউদ্দিন খিলজি প্রমুখ মুসলিম যোদ্ধাদের নেতিবাচক উপস্থাপনের সমালোচনাও করেছে।
পাকিস্তান-ভারত ব্যান
ফেব্রুয়ারি মাসে আবার অশান্ত হয়ে ওঠে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। তার উত্তাপ লাগে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেও। পুলওয়ামা আক্রমণের পর ভারত কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানে ছবি মুক্তি থেকে বিরতি নেয়। অবস্থার অবনতি হলে পাকিস্তান সিনেমা হলগুলো থেকে ভারতীয় ছবি প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলশ্রুতিতে ভারতে কর্মরত সকল পাকিস্তানি অভিনেতা ও গায়ককে নিষিদ্ধ করে ভারত।
দুই দেশের রাজনৈতিক কারণে রাহাত ফাতেহ আলি খান, আলি জাফর, মাহিরা খান, আতিফ আসলাম ও ফাওয়াদ খানের মতো ব্যস্ত তারকারা দ্রুত ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।
বিতর্কিত কাস্টিং
প্রগতিশীল ট্যাগ এঁটে ভালোই এগুচ্ছিল বলিউড। কিন্তু এতে বাগড়া দিলো কয়েকটি ছবির কাস্টিং বিতর্ক। ‘Bala’, ‘Ujda Chaman’, ‘Gone Kesh’ প্রভৃতি ছবির মূল প্রতিপাদ্য ‘চুল পড়া’ বা টাক নিয়ে হলেও চরিত্রগুলোতে কিন্তু টেকো কাউকে নেয়া হয়নি। বরং চুলসমেত অভিনেতাদেরই মেকআপ ও প্রস্থেটিকের সাহায্যে টেকো করা হয়েছে। অথচ বলিউডে কম কেশের অভিনেতার সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এছাড়াও ‘Bala’য় ভূমি পেদনেকারের ‘কৃষ্ণকলি’ সাজা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে।
তবে বেশি বিতর্কিত হয়েছে ‘Saand Ki Aankh’ এর কাস্টিং। ৬০ বছর বয়সী দুই ভারতীয় শ্যুটার চন্দ্রা তোমার ও প্রকাশি তোমারের গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিতে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন ভূমি পেদনেকার ও তাপসী পান্নু। ছবিতে তাদের পারফরম্যান্স বাহবা কুড়ালেও প্রশ্ন উঠেছে বয়স্ক চরিত্রের জন্য তরুণ অভিনেতাদের কাস্টিং নিয়ে। অভিনেত্রী নিনা গুপ্তা নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন এভাবে, ‘ বয়স অনুসারে চরিত্র না দেয়ার ফলে আমাদের বয়সী অনেক অভিনেত্রীই কাজ পাননা।‘ সোনি রাজদানও বিরক্তি ঝেড়ে বলেন, ‘ ওদের অভিনয় অসাধারণ হয়েছে। তা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কেন? কোন যুক্তিতে আপনি বয়স্ক চরিত্রে কমবয়সীদের কাস্ট করবেন?’
টাক নিয়ে হাকডাক
সুন্দরের পূজায় বলিউড বরাবরই মনোযোগী। আর সৌন্দর্যের গৎবাঁধা ধারণা বলতে তো রেশমি কেশ, পটলচেরা চোখ আর দুধে আলতা চামড়াই বোঝে লোকে। তবে এবছর কিন্তু সেই ভাবনার শেকল ভাঙা নিয়ে ধুন্ধুমার পড়ে গিয়েছিল।
আয়ুষ্মান খুরানার ‘Bala’ এবং সানি সিংয়ের ‘Ujda Chaman’ দুটোরি বিষয়বস্তু এক অর্থাৎ টেকো যুবকের আত্মকাহিনি। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। বিপদ বাড়ে যখন ‘Bala’র রিলিজ তারিখ এগিয়ে আসে ঠিক ‘Ujda Chaman’ এর আগের দিনই। বক্স অফিসে বিফল হওয়ার আশঙ্কায় ‘উজড়া চামান’ প্রযোজক কুমার মাঙ্গাত মামলা অব্দি ঠুকে দেন। অবশেষে ১ নভেম্বর মুক্তি পায় সেটি।
কঙ্গনায় নাখোশ মিডিয়া
‘মনিকর্ণিকা: কুইন অফ ঝাঁসি’ দিয়ে বছরটা শক্তভাবেই শুরু করেছিলেন কঙ্কনা। কিন্তু কঙ্কনা যেদিকে যায় বিতর্কের ফুল্কিও সেদিকেই ছড়ায়। বছরের দ্বিতীয় ছবি ‘জাজমেন্টাল হ্যায় কেয়া’ র নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল ‘মেন্টাল হ্যায় কেয়া’। কোর্টের নির্দেশে নাম পরিবর্তন করে এর পরিচালক প্রকাশ কোভেলামুরি। তবে এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রচারণাকালীন এক অনুষ্ঠানে কঙ্কনা সাংবাদিক জাস্টিন রাওয়ের সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন । কঙ্কনার বোন রাংগোলি চান্ডেল টুইটারে এ বিশয়ে বিশদ টুইটও করেন। টুইটে জাস্টিনকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অপমানজনক আখ্যা দিয়ে বিতর্ক জন্ম দেন তিনি। এ অবস্থায় বিনোদন সাংবাদিকদের এক অংশ কঙ্কনাকে বয়কট করে। পরবর্তীতে রাংগোলি তাপসী পান্নুকে ‘কঙ্কনার সস্তা কপি’ নাম দিয়ে ফের দুর্নাম কুড়ান।
সিএএ আন্দোলনে অবস্থান
নাগরিকত্ব আইন নিয়ে পুরো ভারত এখন উত্তপ্ত । সেই আঁচ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা বলিউডের মহারথীরা ভালোভাবেই করে চলেছে। খান, কাপুররা গা বাঁচিয়ে চললেও কঙ্কনা রানাউত, সুশান্ত সিং, কৃতি শ্যানন, জিসান আইয়ুব, স্বরা ভাস্কর, ঋত্বিক রোশান, রাহুল বোস,ফারহান আখতার, রিচা চাড্ডা, পরিনিতি চোপড়া, সাইফ আলি খান, শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ প্রমুখ ঠিকই এগিয়ে এসেছেন।
২৭ নভেম্বর অক্ষয় কুমার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘হিংসা ও আক্রমণের পথ পরিহার করে মুখোমুখি আলোচনায় বসুন।‘ অন্যদিকে আন্দোলনে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় ‘সাবধান ইন্ডিয়া’ শো থেকে বাদ পড়েছেন সুশান্ত সিং। পরিনিতি চোপড়াও একই কারণে বাদ পড়েছেন ‘বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও’ এর হরিয়ানা ক্যাম্পেইন থেকে।
এছাড়াও ‘দঙ্গল’ খ্যাত জাইরা ওয়াসিমের বলিউড ত্যাগ, অক্ষয় কুমারের কানাডিয়ান নাগরিকত্ব এবং মি টু আন্দোলনের খেই হারানো নিয়েও সরব ছিল জমকালো চলচ্চিত্রপাড়া। সময়ের সাথে বলিউড যেমন কনটেন্টের দিকে মনোযোগী হয়েছে তেমনি হয়তো ইমেজের দিকটাতেও খেয়াল রাখবে সমানতালে।