বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াল একটি দিন ছিল ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল। এই দিনে প্রায় এক লক্ষ আটত্রিশ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে মারা গিয়েছিল এবং নিজেদের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল প্রায় এক কোটির মত মানুষ। ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় আঘাত করেছিল এই ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় ২০ ফিট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল।
যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়
২২শে এপ্রিল, ১৯৯১। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি প্রথমে নিম্নচাপ রূপে নিজেকে প্রকাশ করলেও বাতাসের গতি এবং এই নিম্নচাপের পরিধি বৃদ্ধি পেতে পেতে ২৪শে এপ্রিল এটি সাধারণ একটি ঘূর্ণিঝড়ে রুপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে হতে যেন নিজেকে শানিয়ে নেয়ার সাথে সাথে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছিল এটি। পরবর্তীতে ২৮শে এপ্রিল এটির গতি প্রকৃতি প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ২৯ এপ্রিল রাতে ভয়াল তাণ্ডব করতে করতে আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায়। গতি প্রকৃতি অনুসারে একে ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। স্থলভাগে উঠে আসার পর ধীরে ধীরে এই ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমে আসতে থাকে এবং বাংলাদেশের স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াল তাণ্ডব করে অবশেষে ৩০ এপ্রিলের দিকে ঘূর্ণিঝড়টি বিলুপ্ত হয়।
এত সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ
এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় এক লক্ষ আটত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং এদের প্রায় সবাই চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলসহ আশেপাশের বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। এই ধরনের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে বাংলাদেশে আরো হয়েছিল, তবে কোনটাই এতটা ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে নি।
মূলত সচেতনতার অভাবের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৯৯৭০ সালে ভোলা অঞ্চলের দিকে একটু ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পরে সেই অঞ্চলে অনেক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে বেশীরভাগ মানুষই শুধুমাত্র সচেতনতা এবং ঘূর্ণিঝড় অতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে না এই আশায় আশ্রয়কেন্দ্রে সময়মত পৌঁছায়নি।
অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি
শুধুমাত্র এত সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমেই থেমে থাকেনি এই ঘূর্ণিঝড় বরং এর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও মানুষকে ভুগিয়েছিল দীর্ঘ দিন ধরে। তৎকালীন সময়ের হিসেব অনুযায়ী প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ে কর্ণফুলী নদীর পাশে বাঁধ ভেঙে যায় এবং সমুদ্র বন্দরে নোঙ্গর করা প্রায় ছোট বড় অনেক ধরনের জাহাজ নষ্ট হয়ে পরে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের ভিটা বাড়ি ভেঙে যায়। প্রায় এক কোটির মতো মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া একদম নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে তৎকালীন আবহাওয়া অফিসে কর্মরত আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন আমরা আশেপাশে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। তবে আমরা যে দৃশ্য দেখেছিলাম সেটা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। আমরা কেবল মাত্র কান্নার শব্দ শুনছিলাম আর চারপাশে যেদিকেই তাকাই শুধু লাশ আর লাশ”।
১৯৯১ সালে পতেঙ্গায় কর্মরত উইং কমান্ডার নুরুল হুদার ভাষ্যমতে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটি যুদ্ধ বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং বেশ কিছু হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী এই দুই বাহিনীর কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। নুরুল হুদার মতে, নিরাপদ অবস্থানে সরে যাওয়ার জন্য তারা সবাই মিলে অনেক মাইকিং করেছিলেন। তবে মানুষ তাদের মাইকিং শুনেও তেমন কোন পদক্ষেপ নেয় নি। তাদের অনেকেই বারবার বলছিল যে ঘূর্ণিঝড়ে কিছুই হবে না, আর এজন্য তারা সময় থাকতে থাকতে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে যাননি।
এত বড় ক্ষয়ক্ষতি, এত মানুষের মৃত্যু কখনই কেউ ভুলতে পারবে না। এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সামলিয়ে এবং স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চাপা দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসতে প্রায় কয়েক বছর সময় লেগে গিয়েছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের কবলে বাংলাদেশে এত মানুষ আর কখনই মারা যায়নি। সেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন যারা, আজীবন তাদেরকে সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করেছে।