চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্র ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করার প্রেক্ষিতে গুগল জানায়, হুয়াওয়ের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে কিছু সেবার আর কোনো আপডেট ভার্সন দেবে না তারা। নতুন হুয়াওয়ে স্মার্টফোনে গুগলের ইউটিউব, গুগল ম্যাপসের মতো অ্যাপগুলোও আর থাকবে না। এই খবরে পুরো বিশ্ব যেমন হতবাক তেমনি এর পরিণতি নিয়েও বেশ বিতর্ক চলছে।
গুগল কিভাবে মোবাইল কোম্পানি গুলোকে সাপোর্ট দিয়ে থাকে?
অপারেটিং সিস্টেম(ওএস) সাপোর্ট
একটি মোবাইলে যত ধরনের সিস্টেম কাজ করে,তাকে অপারেট করতে অথবা পরিচালনা করতে যে সফটওয়্যার প্রয়োজন হয়,তাই অপারেটিং সিস্টেম। গুগলের এন্ড্রোয়েড নামের একটি অপারেটিং সিস্টেম আছে। এই অপারেটিং সিস্টেমটি স্যামসাং, শাওমি, নোকিয়া থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলো স্মার্টফোন কোম্পানি ব্যাবহার করে থাকে। খুব নির্ভরযোগ্য এবং ব্যবহারকারী উপযোগী অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে এন্ড্রোয়েড বর্তমানে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। কয়েক হাজার অ্যাপ নিয়ে গঠিত অ্যাপ স্টোর, গোছানো ইউজার ইন্টারফেস, স্টান্ডার্ড সিকিউরিটির জন্য এর জনপ্রিয়তাও সবচেয়ে বেশি।
অন্য অপারেটিং সিস্টেমে নিজেদের এপ্লিকেশন ডেভেলপ করার পার্মিশন
নিজেদের অপারেটিং সিস্টেম এন্ড্রোয়েড ছাড়াও গুগল তাদের ইউটিউব ,জিমেইল , গুগল ম্যাপ এর মতো সুবিধাগুলো অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমে অ্যাপ আকারে ব্যবহারের সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন আইফোনের এপ স্টোরে ইউটিউব, জিমেইল এবং ক্রোমের মতো এপগুলা পাওয়া যায়।
কেনো যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের সিদ্ধান্ত?
চায়নার সবগুলো কোম্পানিই তাদের সরকারের অনুগত। চায়নার ন্যাশনাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলো দেশের প্রয়োজনে তাদের সব ধরনের তথ্য সরকারকে দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দিনের অভিযোগ হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে গুপ্তচরের কাজ করছে।
হুয়াওয়ের সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। ২০০৩ সালে আমেরিকার হার্ডওয়্যার ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি CISCO এর সার্ভার থেকে ডেটা চুরির অভিযোগ ওঠে হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে।
এরপর বেশ কয়েক বছর অবিরত হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ডেটা চুরির অভিযোগ আসতেই থাকে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেয় হুয়াওয়ের 5G নেটওয়ার্ক নিয়ে। ২০১৮ সালে জাপানসহ নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স হুয়াওয়ের 5G নেটওয়ার্কে নিরাপত্তা ইস্যু খুজে পায়। অন্যদিকে একই বছর ব্রিটিশ সরকার হুয়াওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রসেসে নিরাপত্তা ত্রুটি খুজে পেলে তাদের ২ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়। ২০১৯ সালে পোল্যান্ডে স্পাইয়িং এর অভিযোগে হুয়াওয়ের এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির সরকার।
হুয়াওয়ের মোবাইলের ব্যাপারে আমেরিকার বাজারে অনেক আগে থেকেই বিধি নিষেধ ছিল। আমেরিকার কোনো দাপ্তরিক কাজে হুয়াওয়ে মোবাইল ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। সব মিলিয়ে ট্রাম্প সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকার কোনো কোম্পানি থেকেই হুয়াওয়ে কোনো সাপোর্ট পাবেনা।
হুয়াওয়ের জন্য কি অপেক্ষা করছে?
হুয়াওয়ের নতুন অপারেটিং সিস্টেমের গুঞ্জন কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরপরই হুয়াওয়ের সিইও রেন ঝেংফেই ঘোষনা দিয়েছেন তারা অতি শীঘ্রই নতুন একটি অপারেটিং সিস্টেম আনতে যাচ্ছে।
বর্তমানে অ্যাপল ছাড়া প্রায় সব মোবাইল কোম্পানিগুলো এন্ড্রোয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, এন্ড্রোয়েড অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, রোম ডেভেলপমেন্ট এর উপর উপর ভিত্তি করে অনেক সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি হয়েছে। এন্ড্রোয়েড অপারেটিং সিস্টেমকে একটি স্টান্ডার্ড প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও ইউটিউব, গুগল ম্যাপের মতো গুগলের এমন কিছু ইনোভেনশন আছে পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত যার কোনো বিকল্প সৃষ্টি হয়নি। এই সুবিধাগুলোর জন্য স্বয়ং অ্যাপলকে পর্যন্ত গুগলের দ্বারস্থ হতে হয়। হুয়াওয়ের নতুন অপারেটিং সিস্টেম এন্ড্রোয়েডের এই অতি জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দিতে পারবে কিনা তাই এখন মূল প্রশ্ন। এছাড়াও নতুন একটি অপারেটিং সিস্টেমকে মানুষের সাথে পরিচয় করানো, নতুন অ্যাপ স্টোর বানানো এবং প্রচুর অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট কখনই একটি রাতারাতি প্রক্রিয়া নয়।
ইতিপূর্বে স্যামসাং মোবাইল কোম্পানি টাইজেন নামে তাদের নিজেদের একটি অপারেটিং সিস্টেম চালু করেছিল তবে সেটি মাত্র কয়েক বছরেই বিলীন হয়ে যায়। এক সময় মোবাইল ফোন বাজারের পুরোটা দখল করতে বসা নোকিয়া এন্ড্রোয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার না করায় রীতিমতো বিলীন হয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম মাঝে ব্যবহার করলেও তেমন সাড়া না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা এন্ড্রোয়েডে আসতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে হুয়াওয়ের 5G নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী আলোড়িত। আমেরিকার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক মেথড ব্যবহার করে। হুয়াওয়েকে ব্লাকলিস্টেড করা এর উপরও একটি প্রভাব ফেলতে পারে বৈকি।
আমেরিকা-চায়নার অর্থনীতির এই দ্বন্দ্ব কারো জন্যই যে সুফল বয়ে আনবে না তা যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে। সর্বশেষ তারা হুয়াওয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তিন মাসের জন্য শিথিল করেছে। এই সময়ের মধ্যে হুয়াওয়ে বিদ্যমান নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ ও সফটওয়্যার আপডেট দিতে মার্কিন কোম্পানিগুলোর দারস্থ হতে পারবে।
লেখক- রাফসান বিন রাজ্জাক
আরও দেখুন- যুক্তরাষ্ট্র চীন বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে বাংলা ইনফোটিউবের বিশ্লেষণ